ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জিহাদীদের রাষ্ট্রীয় মদদ ‘ভাল তালেবান’ ধারণার সৃষ্টি করেছিল ॥ স্কুল হামলায় তা বদলে যেতে পারে, আশা গার্ডিয়ানের

পাকিস্তানে জঙ্গী লালন বন্ধ হবে কি?

প্রকাশিত: ০৩:০৬, ২২ ডিসেম্বর ২০১৪

পাকিস্তানে জঙ্গী লালন বন্ধ হবে কি?

পাকিস্তান রাষ্ট্র দশকের পর দশক ধরে জিহাদীদের মদদ যুগিয়ে এসেছে। এতে দেশটিতে কারা আসল দুশমন তা নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দেয়- সৃষ্টি হয় ‘ভাল তালেবানের’ ধারণার। কিন্তু সর্বশেষ স্কুল হামলার ঘটনা সেই ধারণার পরিবর্তন ঘটাতে পারে। বিশ্লেষণ গার্ডিয়ান অনলাইনের। পেশোয়ারের আর্মি পাবলিক স্কুলে মঙ্গলবার পরিচালিত হামলায় বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিরাই কেবল ঐ বীভৎস্য ঘটনার কথা স্মরণ করছেন না। সমগ্র জাতিই শিশুভর্তি একটি হলে বন্দুকধারীদের নির্বিচারে বুলেট ছোড়া এবং পরে অন্যদেরও হত্যা করার চাক্ষুস বর্ণনা শুনে যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়েছেন। ঐ ঘটনায় ১৩২ শিশু-কিশোর নিহত হয়। বুধবার পাকিস্তান সেনাবাহিনী বহু টেলিভিশন ক্রুকে ঘটনাস্থলে বিচরণ করার অনুমতি দেয়। এর উদ্দেশ্য ছিল, তাদেরকে আত্মঘাতীদের বোমা হামলায় বিধ্বস্ত রুমগুলোর চবি, শুকিয়ে যাওয়া রক্তে ঢাকা-পড়া মেঝের ছবি এবং সাত সন্ত্রাসীর আকস্মিক হামলার বেদনাদায়ক চিহ্নগুলো সম্প্রচারের সুযোগ দেয়া। শিক্ষাবিদ রিফাদ হাসান বলেন, সেনাবাহিনী এমন এক মনোভাব সৃষ্টির চেষ্টা করছে, যা পাকিস্তান অর্জন করতে পারেনি : সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়ার জাতীয় ঐকমত্য। তিনি বলেন, সেনাবাহিনী এরই মধ্যে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, যদি না ঐসব লোককে নিষ্ক্রিয় করা হয়, তা হলে পাকিস্তানে কখনও শান্তি আসবে না বা এটি কখনও কোন স্বাভাবিক দেশ হবে না; তবে সেনাবাহিনী সেই বিষয়টি বোঝাতেই এ মর্মান্তিক ঘটনাকে কাজে লাগাচ্ছে। যে সমস্যার কারণে ২০০১ সাল থেকে ৫০ হাজার লোকের প্রাণহানি ঘটেছে, সেই সমস্যা মোকাবেলায় পাকিস্তানকে যে উৎসাহিত করা প্রয়োজন, সেটা ভেবে বাইরের মানুষ বিস্মিত হন। কিন্তু দশকের পর দশক ধরে জিহাদী দলগুলোর প্রতি রাষ্ট্রীয় মদদদান এবং সেইসঙ্গে হিংসাশ্রয়ী দলগুলোর মোকাবেলা করতে রাজনীতিকদের অনীহা পাকিস্তানের শত্রু কারা তা নিয়ে জাতিকে বিভ্রান্তির মুখে ঠেলে দেয়। মঙ্গলবারের হামলার পর রাজনীতিকরাও অনেক সাধারণ মানুষ আসলে তালেবানই ঐ নৃশংস হামলা চালিয়েছে বলে তারা মনে করেন কিনা প্রকাশ্যে সেই প্রশ্নের জবাব দিতে অনিচ্ছুক হন। অথচ দেশটির ইসলামী আন্দোলনের প্রতিভূ তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) এর দায়দায়িত্ব স্বীকার করতে এক মুহূর্তও বিলম্ব করেনি। জুমার নামাজের সময় সামান্যসংখ্যক মোল্লাই ‘তালেবান’ শব্দটি উচ্চারণ করেন। অনেকে ঐ হামলার জন্য অস্পষ্ট পশ্চিমা ষড়যন্ত্রকে দোষারোপ করেন। রাজধানী ইসলামাবাদের এক সমৃদ্ধ এলাকার একটি সাধারণ মসজিদের ইমাম মুসল্লিদের উদ্দেশে বলেন, আল্লাহ বিদেহী রুহের মাগফিরাত করুন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারগুলোকে সাহস দিন। এরপর তিনি বলেন, আল্লাহ মুসলিমদের বিভক্ত করার লক্ষ্যে ইহুদী ও কাফেরদের ষড়যন্ত্র নস্যাত করে দিন। এরূপ কথাবার্তাকে পাকিস্তানী সাংবাদিক ইজাজ হায়দার ‘অন্যের কাঁধে দোষ চাপানো’ বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, যখন আপনি বলবেন এখানে আমাদের এক সত্যিকারের সমস্যা রয়েছে তখন অন্যপক্ষ বলবে, আফগানিস্তানে আমেরিকানরা কি করছে? বা ‘পাশ্চাত্য জগত কি করবে’, বা ইসরাইলীরা কি করছে। তিনি বলেন, এটি চরমপন্থী মানসিকতারই অংশ, যা সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে বদ্ধমূল। অনেকে ১৯৮০-এর দশকের সামরিক শাসক ও কট্টর ইসলামপন্থী জিয়াউল হককে দোষারোপ করেন। তিনি আফগানিস্তানে পাকিস্তানী আধিপত্য কায়েমে এবং ভারত শাসিত কাশ্মীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তানের পক্ষে লড়াইয়ে জঙ্গীদের ক্রমবর্ধিত সংখ্যায় কাজে লাগান। মার্কিন ও সৌদি অর্থে অগণিত চরমপন্থী ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করা হয়। এরূপে সৃষ্ট ‘মুজাহিদ’দের আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েতদের বিতাড়িত করেছিলেন ইসলামের এমন বীর হিসেবে তুলে ধরা হয়। স্কুলশিশুরা তখন থেকে পাঠ বইতে জিহাদের প্রশংসা এবং হিন্দু ও ভারতের বিরুদ্ধে কুৎসা পাঠ করে এসেছে। পাকিস্তান ১৯৯০-এর দশকে ঐ কৌশলের পুনরাবৃত্তি করে। পাকিস্তান ভারত শাসিত কাশ্মীরে বিদ্রোহ উস্কে দিতে জিহাদীদের পাঠায় এবং মোল্লা দল তালেবানকে ব্যাপকভাবে সহায়তা দেয়। তালেবান ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে। এমনকি আল কায়েদা ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে হামলা চালানোর পরও পাকিস্তান তালেবানকে পরিত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানায়। অথচ পাকিস্তান নামে পশ্চিমা শক্তিগুলোর মিত্র ছিল। পশ্চিমারা আফগানিস্তানে ইসলামাবাদের বশংবদ তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করে। পাকিস্তান তালেবানকে আশ্রয় দিয়েই চলে। ‘ভাল তালেবান’ ও ‘খারাপ তালেবানের’ মতো অদ্ভুত কথা পাকিস্তানের জনমনে এক দশক ধরে গভীর বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে এবং পশ্চিমা শক্তিকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। যেমন হিলারি ক্লিনটন ২০১১ সালে ইসলামাবাদের উদ্দেশে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন, আপনারা আপনাদের উঠানে সাপ রেখে সেগুলো কেবল আপনাদের প্রতিবেশীদের কামড়াবে বলে প্রত্যাশা করতে পারেন না। কেউ কেউ এখন পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত এর শিক্ষা পেয়েছে বলে আশা করার মতো সাহসী হয়ে উঠছেন। দেশটির অস্থায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরতাজ আজিজ স্কুল হামলাকে ‘আমাদের ৯/১১’ এবং এক ‘গেম চেঞ্জার’ বলে অভিহিত করেন। এটি কোন কোন দলের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো এবং অন্যদের বাদ দেয়ার নিষ্ফলতাই শেষ পর্যন্ত তুলে ধরেছে। বুধবার প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ বলেন, ‘ভাল’ ও ‘খারাপ’ তালেবানের মধ্যে কোন পার্থক্য করা হবে না।
×