ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রক্তদানে সেঞ্চুরি করতে চাই- বললেন দেশের সর্বোচ্চ রক্তদাতা জাকারিয়া

প্রকাশিত: ০৪:৪৭, ২০ ডিসেম্বর ২০১৪

রক্তদানে সেঞ্চুরি করতে চাই- বললেন দেশের সর্বোচ্চ রক্তদাতা জাকারিয়া

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ‘আমি বাজান লেখাপড়া জানি না, রোগী নিয়ে সারাদিন কাজ করতাম। পিজি হাসপাতালেও কাজ করেছি। একদিন আমার সামনে একটা এক্সিডেন্ট হলো জরুরী রক্ত দিতে হবে- বাধ্য হয়ে রক্ত কিনে দিতে হলো। তখন এক ডাক্তারের পরামর্শে আমিও রক্তদানে অনুপ্রাণিত হলাম; সেই থেকে শুরু। দীর্ঘ ২৯ বছর ধরে রক্ত দিয়ে চলছি। মঙ্গলবার বিজয় দিবসে রক্ত দেয়ার পর আমার ৯৭ বার রক্ত দেয়া পূর্ণ হলো। রক্ত দিয়ে আমি সেঞ্চুরি করতে চাই।’ -কথাগুলো একটানে বলছিলেন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রক্তদাতা খুলনার জাকারিয়া বিশ্বাস। এক ব্যাগ নয়, গুনে গুনে ৯৭ ব্যাগ রক্ত দিয়েছেন খুলনার বটিয়াঘাটা থানার ঝিনাইখালী গ্রামের মোহাম্মদ জাকারিয়া বিশ্বাস, যা দেশের ইতিহাসে বিরল। রক্তদানকে উৎসাহিত করতে ১৯৮৬ সাল থেকে স্বেচ্ছায় রক্ত দিয়ে যাওয়া এই মহৎ ব্যক্তির বয়স এখন ৫৮। সহধর্মিণী হারিয়ে তিনি একা। থাকেন একমাত্র মেয়ের সংসারে। একাকিত্বে থাকা এই পরোপকারী মানুষটি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘মানুষকে ভালবেসে আমার সকল নিসঙ্গতা দূর হয়ে গেছে।’ স্বেচ্ছায় রক্তদানকে উৎসাহিত করতে তরুণ প্রজন্মের সমন্বয়ে বহু সংগঠন যেমন কাজ করছে তেমনি রয়েছে প্রতিষ্ঠিত ও সুনাম কুড়ানো বহু সংগঠনও। তবু রক্ত দানে কিছু কিছু মানুষ এখনও নেতিবাচক হলেও জাকারিয়া বিশ্বাস এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম, সুযোগ পেলেই ছুটে যান দেশের নানা প্রান্তে। এই ব্যতিক্রমী মানুষটি খুলনার স্থানীয় জেকেজি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নৈশপ্রহরীর চাকরি করতেন, তাতে তিনি উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। স্কুল থেকে পাওনা ১৬ বছরের বেতন নেননি, বরং দুরবস্থায় থাকা স্কুলের ফান্ডে দান করেছেন পুরো বেতনের টাকা! সেই টাকা ও শহরের কিছু মানুষের সরকারী-বেসরকারী সহায়তায় নির্মিত হয়েছে স্কুলের পাকা বিল্ডিং। এলাকার উন্নয়নেও তিনি সাধ্যমতো যথেষ্ট ভূমিকা রেখে চলছেন। নিজের প্রতিষ্ঠিত জাকারিয়া ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন ছাড়াও তারই হাত ধরে খুলনায় শুরু হয় সন্ধানীর রক্তদান কার্যক্রম। তার প্রতিষ্ঠিত জাকারিয়া ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘দেখেন বাবা, কোন কাজ করতে চাইলে অর্থের প্রয়োজন হয়, আমার সেটা নেই। প্রতিটি প্রতিষ্ঠিত মানুষ অনেক কষ্ট করে বড় হয়েছেন, আশা করি আমার প্রতিষ্ঠানটিও কষ্টে কষ্টে বড় হবে। মানুষ ভালবেসে পাশে দাঁড়ালে কষ্ট কিছুটা কম হবে।’ জাকারিয়ার সমাজসেবামূলক ওই প্রতিষ্ঠানের কাজ হবে রক্ত পরীক্ষা, ওষুধ বিতরণ, ফ্রি এ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস, পানির কল স্থাপনসহ সামাজিক বিভিন্ন কর্মকা-। রক্ত সংরক্ষণে রাখার জন্য একটি ফ্রিজের প্রতিশ্রুতিও পেয়েছেন তিনি। রক্তদানে সর্বোচ্চ রেকর্ড অর্জন করায় মানবতাবাদী জাকারিয়া বিশ্বাসের থলিতে ইতোমধ্যে জুটেছে বেশ কয়েকটি পুরস্কার, পরিচিতি লাভ করেছেন জাতীয় পর্যায়েও। বহুগুণে গুণান্বিত খুলনার অজপাড়াগাঁয়ের এই মানুষটি রক্তদানে সর্বোচ্চ রেকর্ড অর্জন করার স্বীকৃতিস্বরূপ এখন পর্যন্ত পেয়েছেন মোট পাঁচটি পুরস্কার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় সর্বোচ্চ স্বেচ্ছায় রক্তদাতা সম্মাননা ২০১২, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের উদ্যোগে বিশ্ব রক্তদাতা দিবসের সম্মাননা ২০১৪, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে বোয়ান আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে হামদর্দের পক্ষ থেকে সম্মাননাসহ আরও দুটি। মোট ৯৭ বারের মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ৪৫, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যালে ২৬, খুলনার সন্ধানীতে ১৭, যশোরে ৪ ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিতে ৪ বার এবং সর্বশেষ মঙ্গলবার শাহবাগে বিজয় দিবসের এক অনুষ্ঠানে রক্ত দিয়ে দেশের ইতিহাসে এই বিরল রেকর্ডের কৃতিত্ব অর্জন করেন জাকারিয়া। জনকণ্ঠের কাছে অনেকটা উচ্ছ্বাস নিয়ে ব্যক্তিজীবনে কাঠমিস্ত্রির কাজ করার ফাঁকে জাকারিয়া নিজের বর্ণিল অধ্যায়ের বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছিলেন। আয়লা ও সিডরে আক্রান্ত নিজ এলাকা বাদেও পুরো বিশ্ব নিয়ে ভাবেন জাকারিয়া। তিনি বলেন, মানুষ মানুষের জন্য; বিপদের সময় সব মানুষের পাশে সবারই দাঁড়ানো উচিত। দীর্ঘদিন রক্তদানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পাভেল বাবু বলেন, ‘আমার জানামতে ৪৪ বার রক্তদাতাকে সর্বোচ্চ রক্তদাতা ভাবতাম। এখন জানছি জাকারিয়া বিশ্বাসের কথা। আসলে তিনি একজন যোদ্ধা। তিনি অনুকরণীয় ও বিরল কৃতিত্বের অধিকারী, তাকে স্যালুট!’ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘নিশ্চিতভাবেই তিনি একজন বিরল দৃষ্টান্ত, মানুষ মানুষের জন্য এমনভাবে কাজ করতে পারে ভাবতেই গর্ব লাগে। এখনও মানুষের জন্য মানুষ আছে তা আবারও প্রমাণিত।’
×