ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শ্যালা নদীর মোহনায় দেখা মিলছে শুশুক ইরাবতী ডলফিনের

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৪

শ্যালা নদীর মোহনায় দেখা মিলছে শুশুক ইরাবতী ডলফিনের

বাবুল সরদার, বাগেরহাট থেকে ॥ তেলবাহী ট্যাঙ্কার ডুবে সুন্দরবনের শ্যালা নদীসহ সংলগ্ন এলাকায় পরিবেশ বিপর্যয়ের পর পরিস্থিতি ক্রমশ স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। পশুর ও শ্যালা নদীর মোহনায় দুর্লভ ইরাবতী ও শুশুকসহ ছয় প্রজাতির ডলফিনের দেখা মিলছে, তবে সংখ্যায় কম। এখনও বনের কাছাকাছি রয়েল বেঙ্গল টাইগার বা হরিণ তেমন দেখা যাচ্ছে না। পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আমীর হোসাইন চৌধুরী জানান, শ্যালা, পশুর, দুধমুখী, করমজল ও ঢাঙমারী এলাকা ডলফিনের বিচরণক্ষেত্র হিসেবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাড়ে তিন লাখ লিটার ফার্নেস ভর্তি ট্যাঙ্কার ডুবির পর কয়েকদিন এখানে ডলফিন দেখা যায়নি। তবে গত দুই/তিন দিন ধরে আবার ডলফিন, শুশুক ও ইরাবতী ডলফিন দেখা যাচ্ছে। গত এক সপ্তাহ ধরে সুন্দরবনের নিয়মিত পরিদর্শন শেষে অনেকে জানান, ক্ষতিকর তেলের ধকল কাটিয়ে নদী খালে প্রাণের স্পন্দন ধীরে ধীরে ফিরতে শুরু করছে। তবে বাঘ, হরিণ কাছাকাছি বনে দেখতে না পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ফার্নেস অয়েল অপসারণে অনেক লোকের আনাগোনা ও সুপেয় পানির অভাবে বন্যপ্রাণী বনের গহীনে চলে যেতে পারে। স্থানীয় জেলেরা জানান, গত কয়েকদিন তাঁরা ডলফিন ও শুশুক খুব কম দেখছেন। তবে, কোন ডলফিনের মৃতদেহ দেখতে পাননি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবনের পশুর ও শ্যালা নদীর মোহনা ও তার আশপাশের এলাকা ডলফিনের প্রজননের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটিকে অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়। ডলফিন মিষ্টি পানির ওপর নির্ভরশীল এবং এখানকার নদীর গভীরতা ডলফিনের বেঁচে থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এ দুর্ঘটনায় ডলফিনের ওপর কি প্রভাব পড়বে বা সেখানে কী পরিমাণ মাছ পাওয়া যাবে তার ওপর নির্ভর করবে বলে গবেষকেরা মনে করেন। স্বস্তিতে কুমির প্রজনন কেন্দ্র ॥ সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে তেলবাহী ট্যাঙ্কার ডুবির পর অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রে। পশুর নদীর পাশে গড়ে তোলা সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের এই প্রজনন কেন্দ্রের চৌবাচ্চায় নদী থেকে পানি তুলতে হয়। নদীর পানিতে তেল ভাসতে থাকায় পানি তোলা যায়নি কেন্দ্রটিতে। এক বার পানি তোলায় ৭টি কুমিরের বাচ্চার মুখে ক্ষত দেখা দেয়। এর ফলে কয়েক দিন পানি পরিবর্তন করতে না পারার ফলে প্রজনন কেন্দ্রের কুমির ছানাগুলোকে মলমূত্রের মধ্যে বসবাস করতে হয়েছে। হরিণ ও বানরকে পানির কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে বলে সেখানকার বনরক্ষীরা জানান। জোয়ার ভাটার টানে ও বনবিভাগের তেল অপসারণ অভিযানের কারণে নদীর পানি তেলমুক্ত হওয়ায় আবারও আগের মতো প্রজনন কেন্দ্রে নদীর পানি তোলা সম্ভব হচ্ছে বলে জানিয়েছেন করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ফরেস্ট রেঞ্জার আব্দুর রব। বনের গভীরে তেল সংগ্রহ শুরু ॥ অয়েল ট্যাঙ্কার দুর্ঘটনাকবলিত ঘটনাস্থল সুন্দরবনের শ্যালা নদীর মৃগামারী এলাকার তেমন তেল না পাওয়ার কারণে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বনের গভীরে আন্ধারমানিক ও তাম্বুলবুনিয়া এলাকায় তেল সংগ্রহের কাজ শুরু হয়েছে। বনবিভাগের নিয়োজিত শ্রমিকেরা এ এলাকার গাছ, লতাপাতা, ঘাস ও মাটিতে লেগে থাকা তেল সংগ্রহ করছে বলে জানান চাঁদপাই রেঞ্জের স্টেশন অফিসার আবুল কালাম আজাদ জানিয়েছেন। মন্ত্রী আসছেন আজ ॥ আজ শুক্রবার পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু শ্যালা নদীতে তেলবাহী ট্যাঙ্কার ডুবির ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসছেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব, পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক, প্রধান বন সংরক্ষকসহ উর্ধতন কর্মকর্তারা থাকবেন বলে বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মুঃ শুকুর আলী জানিয়েছেন। রবিবার তদন্ত প্রতিবেদন ॥ এদিকে তদন্ত কমিটির প্রধান বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নুরুল করিম সাংবাদিকদের জানান, তদন্ত প্রতিবেদন প্রায় চূড়ান্ত হয়েছে। ররিবারের মধ্যে তা জমা দেয়া হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পরিবেশ দূষণের কথা যতটা ভাবা হয়েছিল ততটা হয়নি। এখনও কোন জলজপ্রাণী মারা যাওয়ার খবরও আসেনি। বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে তেল দ্রুত অপসারণে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ আমদানি, সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে নৌ-চলাচল বন্ধ এবং ক্ষয়ক্ষতি নির্ণয়ের গবেষণার কথা বলা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। ৬৫ হাজার ৫শ’ লিটার তেল সংগ্রহ ॥ গত ৭ দিনে সুন্দরবনের শ্যালা নদী ও আশপাশের খাল থেকে সংগ্রহ করা ৬৫ হাজার ৬শ’ লিটার ফার্নেস অয়েল ক্রয় করেছে পদ্মা অয়েল। গত শুক্রবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত স্থানীয় এলাকাবাসী এ তেল সংগ্রহ করেছে। বন বিভাগের সহায়তায় স্থানীয় মানুষ সনাতন পদ্ধতিতে পানি থেকে তেল আহরণ অব্যাহত রেখেছেন। কন্ট্রোল রুম ॥ সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ বাগেরহাটে একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ (কন্ট্রোল রুম) স্থাপন করা হয়েছে। এই নিয়ন্ত্রণ কক্ষ নিয়মিত সব কিছু তদারকি করছে। অপরদিকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত বন অধিদফতরের খুলনা অঞ্চলের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা রয়েছে। বন বিভাগের ডিএফও আমীর হোসাইন চৌধুরী আরও বলেন, স্থানীয় মানুষের সহায়তায় সনাতন পদ্ধতিতে পানি থেকে তেল আহরণ অব্যাহত রয়েছে। দুই শতাধিক নৌকা নিয়ে শ্যালা নদী এবং এর আশপাশের খালে ছড়িয়ে পড়া তেল তারা আহরণ করছেন। নদীর পানির রং প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে, এখন তেল ভাসতে দেখা যাচ্ছে না বলে তিনি উল্লেখ করেন। ত্রাণ ও আর্থিক সহায়তার আশ্বাস ॥ সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে তেল সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত এবং ক্ষতিগ্রস্ত জেলে-বনজীবীদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হবে বলে জানিয়েছেন মংলা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোঃ নাহিদুজ্জামান। তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে তেল সংগ্রহ করছে এমন প্রায় আড়াই শ’ শ্রমিকের নামের তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রণয়নের কাজ চলছে।
×