ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৪

ঢাকার দিনরাত

মুখরিত কল্লোলিত বিজয় উৎসব ষোলোই ডিসেম্বর বিজয় দিবস উদ্্যাপনের এক সপ্তাহ বা তারও চেয়ে বেশি সময়ের আগেই ঢাকায় শুরু হয়ে যায় বিজয় উৎসব। গান, কবিতা ও নাটক উৎসবের উপাদান হলেও নানা কথামালায় মুখরিত হয়ে থাকে এ উৎসব। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শত্রুপক্ষ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে মাতৃভূমিকে দখলমুক্ত করার গভীর তৃপ্তি ও আনন্দ থেকে উৎসারিত হয় এ উৎসব। যদিও উৎসবের নেপথ্যে থাকে স্বজন হারানোর বেদনা ও ব্যাপক ক্ষতির ক্ষত। দুঃখশোক ক্ষোভ ও যন্ত্রণা উজিয়ে কখনও কখনও উপচে পড়ে বিজয়গৌরবের সুখ। ঢাকার প্রতিটি অঞ্চলে, পাড়া-মহল্লায় বিজয় দিবসকে ঘিরে আয়োজিত হয় আলোচনা সভা ও আনন্দোৎসব। এইসব আয়োজন গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, আজকের নবীন প্রজন্ম এ থেকে পূর্বপুরুষদের গৌরবগাথা ও অর্জন সম্বন্ধে প্রত্যক্ষভাবে জানতে পারে। একই সঙ্গে স্বাধীনতার জন্য স্বদেশের বিপুল ত্যাগস্বীকার সম্পর্কেও ধারণা লাভ করে। বিশেষ করে একাত্তরের কোন যোদ্ধা স্বয়ং যখন স্মৃতিচারণ করেন তখন সেই কথকতা থেকে তরুণরা পেয়ে যায় সত্যের শাঁস এবং কান্নার ভেতরে লুকানো পান্না। প্রতিবছরই বিজয় উৎসব নতুন নতুন উদ্দীপনা ও অঙ্গীকার নিয়ে উপস্থিত হয়। ঢাকায় বড় পরিসরে বিজয় উৎসবের আয়োজক সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। ১৯৯০ সাল থেকে প্রতি ডিসেম্বরে এ বিজয় উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এবারের সেøাগানÑ ‘যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি হচ্ছে ধার্য, গণহত্যাকারী সংগঠনের বিচার অনিবার্য।’ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে উৎসবের উদ্বোধন হলেও ঢাকাজুড়ে এগারোটি স্থানে নির্মিত হয়েছে উৎসবমঞ্চ। এবারই প্রথমবারের মতো উৎসবের ভেন্যু হিসেবে সংযুক্ত হয়েছে উত্তর ঢাকার উত্তরার রবীন্দ্রসরণি এবং দক্ষিণ ঢাকার তথা পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক। দেশের দেড় শ’ সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রায় তিন হাজার সংস্কৃতিকর্মী এবারের উৎসবে অংশ নিচ্ছেন। উৎসবে থাকছে পথনাটক, গণসঙ্গীত, কবিতা আবৃত্তি, নৃত্য, গান, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শিল্পীদের পরিবেশনা, প্রামাণ্যচিত্র ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনী এবং শিশু-কিশোরদের পরিবেশনা। দনিয়া ও মীরপুরে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী চলছে। ঢাবির টিএসসিসংলগ্ন সোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বরে ‘ওরা ১১ জন’, আগামী, হুলিয়া, গেরিলাসহ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিখ্যাত চলচ্চিত্রসমূহ দেখার জন্য যথেষ্ট ভিড় হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি, মুটে-মজুর, রিক্সাওলারাও এসব চলচ্চিত্র উপভোগ করছেন। শ্রেণীবিভেদ ভুলে আবার যেন সেই একাত্তরের আলোয় সম্মিলিতভাবে স্নাত হওয়া। আজ বিজয়দিবসে সকালে শহীদ মিনার থেকে বিজয় শোভাযাত্রা বের হবে সদ্য প্রয়াত শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর আঁকা মুক্তিযোদ্ধার প্রতিকৃতি নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এবার সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে। ‘মানবাধিকার দিবস থেকে বিজয় দিবস’ শীর্ষক এ আয়োজনে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা, গান, নৃত্য, আবৃত্তি, পথনাটক সবই রয়েছে। তবে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলোÑ প্রাথমিক ও উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন পরিবেশনা। মহাবিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা তাদের অভিভাবকদের মুখ থেকে শোনা যুদ্ধের গল্প শুনিয়েছে উপস্থিত শ্রোতাদের। এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাতে হয়। গণহত্যা ও নির্যাতনের প্রামাণ্য দলিল এসব ছবির দিকে তাকানো যায় না। এত করুণ এত বীভৎস্য! একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানী সেনা আর তাদের এদেশীয় বান্ধব রাজাকার, আলবদর, আলশামসের নারকীয় কীর্তি! মানুষের খ- বিখ- দেহ পড়ে আছে রাজপথে, খোলা মাঠে। মাংসলোভী কাকদের ওড়াউড়ি। ঠুকরে ঠুকরে খাওয়া। দল ধরে মানুষ ছুটছেন, নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। তারা প্রায় সহায় সম্বলহীন, বিষাদমাখা মুখ কারও; কারও মুখে ফুটে উঠেছে ভয়ার্ত অভিব্যক্তি। মানবতার এমন লাঞ্ছনা বাংলাদেশ দেখেনি আগে। বর্বরোচিত নির্যাতন, নারকীয় গণহত্যা। অকাট্য প্রামাণ্য দলিল। এই আলোকচিত্রসমূহ প্রদর্শিত হচ্ছে শাহবাগস্থ জাতীয় জাদুঘরে। প্রদর্শনীর শিরোনাম দেয়া হয়েছে ‘১৯৭১ : গণহত্যা ও নির্যাতন।’ আজ বিজয় দিবসে প্রদর্শনীটি শেষ হয়ে যাবে সন্ধে সাতটায়। তাই এ বছরের মতো শেষ সুযোগ গ্রহণের অনুরোধ জানাই। শুধু আলোকচিত্র নয়, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক শিল্পকর্মও প্রদর্শিত হচ্ছে। বিশেষ করে চিত্রকর হাশেম খানের একগুচ্ছ শিল্পকর্ম প্রদর্শনীটিকে অন্যতর মাত্রা দিয়েছে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ব্যবহার্য দ্রব্যাদিও আছে প্রদর্শনীতে। মুনীর চৌধুরীর ডায়েরির একটি পাতা, মেহেরুন্নেসার কবিতাও পড়ার সুযোগ হলো প্রদর্শনীতে গিয়ে। মানুষ দল বেঁধে যাচ্ছেন এসব অবলোকন করতে। দেখতে দেখতে থমকে দাঁড়াচ্ছেন, মন্তব্য করছেন। কান খোলা রাখলে এসব ক্রোধ ও হাহাকারের শব্দগুলো শোনা যায়। বুকের ভেতরকার নিঃশব্দ ক্রন্দন শুধু অনুভবে বুঝে নিতে হয়। আজকের ছেলেমেয়েরা ‘মন্তব্য খাতায়’ যেসব কথা লিখেছে তা পড়লে চোখ ভিজে আসে, মন আশ্বস্ত হয়। একাত্তর যারা দ্যাখেনি তারা যথার্থই অনুভব করতে পারছে একসাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে; মায়ের সম্ভ্রমের বিনিময়ে পাওয়া মানচিত্রকে। আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে নারীদের সংগঠন নারীপক্ষের এবারের আয়োজনটি কিছুটা ব্যতিক্রমী। এবারও মুক্তিযুদ্ধে হারানো স্বজনদের শ্রদ্ধা জানিয়ে শহীদ মিনারে মোমবাতি প্রজ্বলন কর্মসূচী পালন করেছে সংগঠনটি। ‘আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার’ শিরোনামে নারীপক্ষের এই আয়োজনের সূচনা ১৯৮৮ সালে। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘বীরাঙ্গনা গাথা।’ অনুষ্ঠানে সংগঠনটির পক্ষ থেকে বলা হয়, সম্প্রতি সরকার বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, তারা মুক্তিযোদ্ধাদের মতো সরকারী ভাতা পাবেন। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে এখনও বেঁচে থাকা বীরাঙ্গনারা অর্থকষ্ট থেকে কিছুটা মুক্তি পাবেন। আমরা এজন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। তবে আমরা মনে করি, নাম বা উপাধি বদলালে তাদের প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে না। তাদেরকে দেয়া বীরাঙ্গনা উপাধির যথাযোগ্য মর্যাদা ও সম্মান রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিরাজগঞ্জের তিন বীরাঙ্গনার বক্তব্য উপস্থিত শত শত মানুষকে অশ্রুসজল করে তোলে। রণাঙ্গনের স্মৃতিদগ্ধ বীরাঙ্গনারা একাত্তরের রণাঙ্গনক্ষেত্র ছিল সমগ্র বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধকালে নির্যাতনের স্মৃতি বীরাঙ্গনাদের প্রতিদিন দগ্ধ করে চলেছে। তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যেই বীরাঙ্গনা খেতাবে তাঁদের ভূষিত করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর এই সদিচ্ছার প্রতি কি সমাজ পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে? জানায়নি বলেই ৪৩ বছর ধরে গঞ্জনা লাঞ্ছনা আর অপমানের ভেতর সেই বীরমাতাদের বাস। বিলম্বে হলেও জাতির দায় শোধ করার উদ্যোগ নিয়েছে বর্তমান সরকার; বীরাঙ্গনাদের স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। বলাবাহুল্য, এটি প্রাথমিক দায় শোধ। বীরাঙ্গনাদের আগামী দিনগুলো স্বাভাবিক স্বস্তিময় করা গেলেই শুধু তাঁদের প্রতি জাতির ঋণ কিছুটা শোধ করা সম্ভব হবে। বীরাঙ্গনাদের কল্যাণেও নাগরিক পর্যায়ে কিছু কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। রাইজিং পাথ অব হিরোইনস নামের বীরাঙ্গনাদের অধিকার রক্ষায় সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছে যুক্তরাজ্যে। এর পরিচালক হলেন জনকণ্ঠের প্রাক্তন সাংবাদিক শাহমিকা আগুন। তাঁর সংগঠন এবং বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের যৌথ উদ্যোগে, মূলত পারভীন সুলতানা ঝুমার উদ্যোগে জাতীয় প্রেসক্লাবে একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। মূল প্রতিপাদ্য হলোÑ ‘শেষ হোক বীরাঙ্গনাদের বেদনার দিন- বীরাঙ্গনারাও মুক্তিযোদ্ধা।’ মুক্তিযোদ্ধা বিষয়কমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সিরাজগঞ্জ থেকে আগত ক’জন বীরাঙ্গনা তাঁদের নিগ্রহের ইতিহাস তুলে ধরেন। উপস্থিত ছিলেন খ্যাতিমান কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। তিনি কিছু গঠনমূলক প্রস্তাব উত্থাপন করেন। যার ভেতর রয়েছে, বীরাঙ্গনা ও তাঁদের সন্তানদের জন্য কোটা প্রথা চালু, ট্যাক্স প্রবর্তন, আইন প্রয়োগের মাধ্যমে কটূক্তি বন্ধে উদ্যোগ নেয়া ইত্যাদি। প্রত্যেক বীরাঙ্গনাই বক্তব্য দিতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন, তাঁদের কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে পড়ে। শ্রোতারাও আবেগবিহ্বল হয়েছেন বারবার। বীরাঙ্গনা হাজেরার কথার সময় সভাস্থলে বিরাজ করে পিনপতন নিস্তব্ধতা। ৪৩ বছরের আশাহীনতার কুয়াশা ভেদ করে তাঁর কণ্ঠে হঠাৎ ঝরে পড়ে আশাবাদের জ্যোৎস্না। কথা শেষ করে মঞ্চ থেকে নামার সময় সাংবাদিক আবেদ খান তাঁকে সান্ত¡না ও অভয় দিলে বীরাঙ্গনা হাজেরা তাঁকে জড়িয়ে ধরেন। এমন দৃশ্য দেখে কার না কান্না পায়। যুদ্ধের জীবন্ত স্মারক যুদ্ধশিশু সুধীর কথা শেষ না করেই চোখ মুছতে মুছতে মঞ্চ থেকে নেমে যান।
×