১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ নিয়ে বিরূপ কিংবা নেতিবাচক ভাবনা কেউ যদি ভাবেন তাহলে তাঁকে দোষ দেয়া যাবে না কিন্তু সেই ভাবনার কারণে মুক্তিকামী নিরপরাধ মানুষকে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ এবং লুটতরাজের শিকারে পরিণত করাটাই মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং যার বিচার এই মুহূর্তে বাংলাদেশে চলছে। এর মাঝে অনেকবার বিজয় দিবস এসেছে, আমরা পালন করেছি প্রতিটি বিজয় দিবস, কেবলমাত্র ১৯৭৫ এবং ৭৬ সালে বিজয় দিবস পালিত হয়নি এ দেশে। কেন হয়নি, সে প্রশ্ন তুললে যে কথাগুলো বেরিয়ে আসবে তা থেকে আমরা আজকের বাংলাদেশকে ব্যাখ্যা করতে পারি খুব সহজেই। আজকে আরেকটি বিজয় দিবসের আগ মুহূর্তে কেন এ রকম একটি নিবন্ধ লিখছি সে প্রশ্নের উত্তর আশাকরি পাঠক নিবন্ধ শেষে পাবেন; কিন্তু শুরুতেই যে কথাটি বলতে চাইছি তাহলো, বিগত ৪৩ বছরেও আমরা কিছু জটিলতা কাটিয়ে উঠতে পারিনি, যার সবই মূলত রাজনৈতিক। হ্যাঁ, কিছু সামাজিক দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়েও আমরা যাচ্ছি কিন্তু সেগুলোর স্বরূপ গোটা বিশ্বে একই রকম, একদিকে প্রযুক্তির শনৈঃ শনৈঃ আরেকদিকে জীবন-যাপনের অপার্থিব সত্য, এই দু’য়ের দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে দেশে দেশে সমাজব্যবস্থাকে যেতে হচ্ছে, একটির সমাধান বেরুচ্ছে তো আরেকটি তৈরি হচ্ছে, হয়ত একেই সভ্যতার গতিময়তা বলে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক যে জটিলতা সম্পর্কে আজকে আলোকপাত করতে চাই, তা কিন্তু চাইলেই নিরসন সম্ভব এবং সেটা সম্ভব হলে আখেরে বাংলাদেশেরই লাভ, আর কারো নয়।
বাঙালী না বাংলাদেশীÑ এই দ্বন্দ্বের একটি বিচারিক সমাধান আমরা জেনেছি এবং তা নিয়ে বিতর্ক বন্ধ হয়েছে বলা যায়। কিন্তু ধর্মভিত্তিক যে জাতীয়তাবাদের দিকে বাংলাদেশ ক্রমশ ঝুঁকেছে তাতে অচিরেই বাঙালিত্বের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র-ছবিটি বিলীন হতে যাচ্ছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। জাতিত্বে বাঙালী, নাগরিকত্বে বাংলাদেশী, এই পরিচয় ছাপিয়ে একজন সেনা শাসকের ভয়ঙ্কর চেতনাপ্রসূত বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে প্রশ্রয় দেয়ার পরিণাম যে শুভ হতে পারে না তা নিয়ে আমাদের অনেকেরই মাথাব্যথা নেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এর দায় নিতে হবে আমাদেরই, সে কথাও কিন্তু সত্য। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক এই ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবোধকে অস্বীকার করার মধ্য দিয়েই আমরা একাত্তরে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম। যে কোন যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতেই দেশ গড়াটা প্রাথমিক ও জরুরীতম কাজ হয়ে ওঠে বিজয়ী পক্ষের কাছে, এদেশেও তাই-ই হয়েছিল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে পরাজিত পক্ষ দেশে-বিদেশে ষড়যন্ত্র-ব্রিগেড গড়ে তুলছিল তা টের পাওয়া গেলেও তাদের দমন করার মতো হাতিয়ার মজুদ ছিল না। স্বাধীনতার এত বছর পর এসে একথা স্বাভাবিকভাবেই মনে পড়ে যে, মুক্তিযুদ্ধের মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজ কেন এত উতলা হয়ে উঠেছিল নিজের হিস্যা বুঝে নেয়ার জন্য? কেন সময় দেয়া হয়নি বঙ্গবন্ধুকে? স্বাধীন বাংলাদেশ তো ‘লুটের মাল’ ছিল না, ছিল একটি জাতীয়বোধের চেতনা থেকে জন্ম নেয়া অবয়ব। তার শরীর আর মন পুষ্ট হওয়ার আগেই প্রতিবিপ্লবী চক্র কিভাবে জায়গা করে নিয়েছিল এদেশে, তা এক বিপন্ন বিস্ময়। এই বিস্ময়ের ঘোরের ভেতরই দেশের ভেতর অসংখ্য ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। বঙ্গবন্ধু দেশ গোছাতে ব্যস্ত আর এই ব্যস্ততার ফাঁক দিয়ে যার যার আখের গোছানোর চেষ্টা চলছে এবং বিরোধীরা শুরু করেছে বঙ্গবন্ধুবিরোধী, দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র। এই বিরোধীদের সফলতা এসেছিল ঘরের শত্রু বিভীষণদের মদদেই। জাতি হিসেবে আমাদের খাটো হয়ে যেতে হয় সেই সময়টার কথা ভাবলে, যে সময়ে সকলের সম্মিলিত প্রয়াসের প্রয়োজন ছিল বাংলাদেশের জন্য সে সময় সম্মিলন শব্দটিই যেন এদেশে নির্বাসনে গিয়েছিল। যেন এদেশ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে, এক্ষুণি লুটে-পুটে না খেলে আর ভাগে পাওয়া যাবে না। ভাগের মা যেমন গঙ্গা পায় না তেমন ’৭৫-এ বাঙালী জাতি যখন পিতৃহীন হলো তখন এদেশে বিজয় দিবসটা উদ্্যাপনের কোন মানুষ থাকল না আর। এই ব্যাপারটা মাথায় রাখলেই আমাদের কাছে স্পষ্ট হয় যে, আমরা কতটা বিপজ্জনক অবস্থার ভেতর পড়েছিলাম ’৭৫-এ।
এ দেশের অবস্থা এতটাই খারাপ হয়েছিল যে, সেনাবাহিনীর ভেতর থেকে যখন অস্ত্রের জোরে, অর্থের জোরে রাজনৈতিক দল গঠিত হলো তখন এ দেশের চিহ্নিত বিপ্লবীদের অনেকেই গিয়ে সেখানে হত্যে দিয়ে পড়লেন। এর অর্থ এই যে, এদের প্রত্যেকের অতীত রাজনীতি হয় ভ-ামি ছিল, নয় ছিল সুযোগের অভাবে সৎ থাকার মতো। আমার মনে হয়, এই দু’টো বাক্যই সত্য সেই সব বামপন্থী, নীতিবাগিশ নেতাকর্মীদের জন্য, যারা দলে দলে জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক প্ল্যাটফরমে গিয়ে জড়ো হয়েছিলেন। আজকাল জাসদ নিয়ে কথা বললেই নানাজনে নানারকম গোস্্সায় আক্রান্ত হন। কিন্তু এ কথা তো সত্য যে, ’৭৫-এর নির্মমতার পথ পরিষ্কার করেছিল জাসদ, জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখলের সুযোগ করে দিয়েছিল জাসদ এবং এ দেশে অপরাজনীতির উদ্বোধনীটিই ঘটেছিল জাসদের হাতে। জাসদ আর চৈনিক বাম মিলে যে নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফরমটিকে শক্তিশালী করা হয়েছিল এ দেশে তারা আজকে যে বিশালত্ব অর্জন করেছে তার জন্য এ দেশের সুশীল বিবেকও যে কম দায়ী নয়, সে কথাটি আমাদের এখন বলতেই হবে, কারণ আজকে না বললে আমাদের আগামী শঙ্কামুক্ত হবে না।
দল হিসেবে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে এবং গোটা পাকিস্তান আমল ধরে এই স্বাধীনতার লক্ষ্য নিয়েই কাজ করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের শুরুতে দেশ পরিচালনায় অনভিজ্ঞ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের ভুল-ভ্রান্তিকে কেউ ক্ষমার চোখে দেখেনি, এমনকি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার পুরস্কারস্বরূপও নয়। বরং মনে করেছে একা আওয়ামী লীগ দেশটাকে লুটে-পুটে খাচ্ছে, তাদেরকে যে প্রকারেই হোক টেনে নামাতে হবে কিন্তু আওয়ামী লীগকে টেনে নামানোর পর সে স্থলে কাকে বসানো হবে তার কোন প্রস্তুতি কারোরই ছিল না। ফলে সেখানে স্বাভাবিকভাবেই ঢুকেছে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি, যারা আওয়ামীবিরোধী রাজনীতির ভেতর কপট ধর্মরূপ বক সেজে বসেছিল। জিয়াউর রহমান ও কর্নেল তাহেরের ভেতরকার সম্পর্কের সমীকরণ করলে অন্তত আমার কাছে এ রকম সত্যই স্পষ্ট হয়। ’৭৬ থেকে ৮১ বাংলাদেশে কী ঘটেছে বা বাংলাদেশ কেমন চলেছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত লেখার সুযোগ আজকে নেই কিন্তু এ কথা আজকে বলতেই হবে যে, মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত অর্জন এই চার বছরে ধুলোয় মিশেছে, এ দেশ কেবল চেয়ে চেয়ে দেখেছে, করার কিছুই তার ছিল না। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু আওয়ামী লীগকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছে, এ দেশ আর বাঙালী জাতির মতোই, সুতরাং দলটির পক্ষে প্রতিবাদী হওয়াও খুব সহজ ছিল না। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, সেই সময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কারা ছিলেন। শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিকালে আওয়ামী লীগ যাদের হাতে ছিল তাদের অনেককেই দেখা গেছে অবস্থানচ্যুত হতে, পরবর্তীকালে। প্রশ্ন হলো, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুজনিত ক্ষতি গোটা জাতি যেখানে এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি সেখানে আওয়ামী লীগের মতো একটি বহুত্ববাদী রাজনৈতিক দলের পক্ষে সে ক্ষতি পুষিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ানো কতটা সহজ ছিল? ছিল যে না তার প্রমাণ ২১ বছর পথে পথে হেঁটে শেখ হাসিনার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন।
মজার ব্যাপার হলো, এই ২১ বছরে দেশের মানুষের ভেতরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দল হিসেবে আওয়ামী লীগকেও পরিবর্তিত হতে হয়েছে। বৈশ্বিক রাজনৈতিক বলয়ে পরিবর্তন হয়েছে একাধিকবার। তার প্রভাবও পড়েছে দলটির ওপর। আপোসকামিতা বলি আর বুর্জোয়া রাজনীতির প্রভাব বলি, আওয়ামী লীগকে নানা ক্ষেত্রে পিছিয়ে আসতে হয়েছে। প্রতিযোগী প্রতিদ্বন্দ্বী যদি হয় ষড়যন্ত্রকারী, খুনী, লুটেরা শ্রেণী তাহলে তাদের সঙ্গে লড়তে গিয়ে মাদার তেরেসা-গণতন্ত্রী হলে চলে কি না সে প্রশ্নও তোলা যায়। কিন্তু এসব প্রশ্নের পরও আওয়ামী লীগের কাছে মানুষের চাওয়ার বিশালত্ব ও গুরুত্ব বিচারে দলটির যে কোন বিচ্যুতিকেই কোনভাবে মেনে নেয়া যায় না। দেশের বর্তমান বিচারে যে রাজনৈতিক জটিলতার কথা বলতে চেয়েছি তার সঙ্গে আওয়ামী লীগের বিচ্যুতি যেমন জড়িত তেমনই জড়িত এদেশে আওয়ামী-বিরোধিতার নামে দেশবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক শিবিরের উল্লম্ফনও। এই শেষোক্তদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উগ্র ধর্মান্ধ রাজনৈতিক শক্তি, যারা ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ধরে বাঙালীকে তার বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দিতে চাইছে। ২০১৩ সালে সেই বিপর্যয়ের খানিকটা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি এবং এখনও আতঙ্কিত হতে হয় ৫ মের সেই ভয়াবহতার কথা স্মরণ করে। এই মুহূর্তে এ সকল প্রগতিবিরোধী, দেশবিরোধী শক্তিসমূহ একত্রিত হয়েছে ক্ষমতা দখলের জন্য। বঙ্গবন্ধুকে যেমন সরানোর জন্য ডান-বাম-ধর্ম-সেনা-পরাজিত সকল পক্ষ একত্রিত হয়েছিল, এখনও শেখ হাসিনার সরকারকে সরানোর জন্য সকলে প্রস্তুত রণসাজে। রাজনীতির এই জটিলতর সময়ে আমাদের বিবেকবান মানুষেরা এখনও বসে আছেন নিজেদের ‘গুরুত্বকে’ হাতের মুঠোয় নিয়ে। তাঁরা কেউ নত হয়েছেন অর্থের কাছে, কেউ শক্তির কাছে, কেউ ক্ষমতালোভী হয়ে উঠেছেন কেউ বা কেবলমাত্র ব্যক্তিগত অসূয়াপ্রবণ হয়ে নোংরা রাজনীতির সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। আবারও একাত্তরপরবর্তী দেশ-কাল-বাস্তবতায় আমরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করতে যাচ্ছি কি না সে প্রশ্ন উঠেছে। আগেই বলেছি যে, বঙ্গবন্ধুর সরকারকে আমরা সে সুযোগ এবং সে ছাড় দেইনি বলেই আমরা ৭৫-এ এসে হারিয়েছি বঙ্গবন্ধুকে এবং পিছিয়েছি অর্ধশতক। আবারও সেই মাহেন্দ্রক্ষণে এসে আমরা দাঁড়িয়েছি যেখান থেকে দেখতে পাচ্ছি যে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থ আমাদের আটকে রাখছে অপশক্তির জালে, মেঠো ইঁদুরেরও যে শক্তি আছে আমাদের জাতীয় বিবেকদের সেই শক্তিটুকু নেই এই অদৃশ্য জাল কেটে বেরিয়ে আসার সে কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। এমন তো বিপন্ন জটিলতর রাজনৈতিক সমীকরণ নিয়েই আমরা উদ্্যাপন করতে যাচ্ছি আরেকটি বিজয় দিবস। আজকে তাই এটুকুই আশাবাদ, যেন এই জটিলতা কাটিয়ে আমরা বিজয় দিবস উদ্যাপন করতে পারি ভয়হীন, নিঃসঙ্কোচে।
১৫ ডিসেম্বর, ২০১৪
[email protected]