ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দাউদ হায়দার

জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী জয়তু কবিতা, জয়তু মুক্তিযুদ্ধ

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৪

জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী জয়তু কবিতা, জয়তু মুক্তিযুদ্ধ

অবিচুয়ারি লেখায় পোক্ত নই। চটজলদি কিছু তথ্য উগড়ে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায় না। মৃতের ভালমন্দ বিচার-বিশ্লেষণও জরুরী। পাঠক জানবেন কতটা গুণ-অগুণে শক্ত বা নড়বড়ে ছিলেন সেই মানুষ, ব্যক্তিজীবনইবা কী রকম ছিল। চেনা যাবে তাঁকে, চেনানোই অবিচুয়ারির প্রাথমিক কাজ। - জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী বিষয়ে খুব বিষয়ে জানি নে। অধ্যাপক ছিলেন, কবিতা, প্রবন্ধ লিখেছেন, অনুবাদ করেছেন, সম্পাদনা করেছেন পূর্বমেঘ (সঙ্গে মুস্তফা নূর উল ইসলাম), দীপঙ্কর সাহিত্য পত্রিকা (দৈনিক সংবাদ থেকে প্রকাশিত)। পূর্বমেঘ যতটা আকাশ ছেয়ে ফেলে, পূর্ব পাকিস্তান আমলে, জ্ঞানবান ‘দীপঙ্কর’ স্বাধীন বাংলাদেশে কোন আলোড়নই তোলে না, হয়ত আমরা অ-জ্ঞান বলেই। কবিতা, প্রবন্ধ লেখা, অনুবাদ করা সবই সাহিত্য, নিষ্ঠার সঙ্গেই করেছেন জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। লিখেছেন সাম্প্রতিক সমাজ-রাজনীতি নিয়ে, সংবাদপত্রে। নিয়মিত কলাম নয় অবশ্য। তাঁর ভাবনা, যুক্তি, মতামত ইঁচড়ে-পাকা সবজান্তা রাজনীতিক, আমলা, সামাজিক গু-া তথা মস্তানরা আমল দেয়নি, পড়েনি হয়তোবা। অত জ্ঞানগম্যি আমাদের রাজনীতিবিদ, আমলা, মোড়লদের নেই। স্পষ্টকথা কেন শুনবে। শোনার জন্য, শুনে বোঝার জন্য শিক্ষিত হওয়া দরকার। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী নানাগুণে বহুমান্য। স্নিগ্ধ ব্যবহার। অনুচ্চকণ্ঠ, কিন্তু সুভাষণ, ভীষণ জোরালো। সুভদ্রতায় অমায়িক। মার্জিত রুচিবোধ। পা-িত্যে বিনয়ী। হিতৈষী। বন্ধুমহলে পরম সখ্য। বন্ধুদের নিয়ে গর্ব অতিশয়। বলেন একবার, সত্যজিত রায়ের অন্যতম পাঠ্য মুহম্মদ হাবিবুর রহমানের যথাশব্দ। হেসে বলি, যথাশব্দ উপহার দিয়েছিলুম সত্যজিতকে, ওঁর মৃত্যুর পরে এই তথ্য লিখেওছিলুম ভোরের কাগজের সাহিত্য সাময়িকীর পৃষ্ঠায়। Ñ ‘তোমার লেখা তোমাকেই শোনাচ্ছি।’ বলে স্মিত হাসি। মুহম্মদ হাবিবুর রহমান তাঁর প্রিয় বন্ধুকুলের একজন। বন্ধুর সাফল্যে বলীয়ান, মহীয়ান। বাংলাদেশে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন বিচারপতি মুহম্মদ হাবিবুর রহমান। পরিচালনা টিমে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীও, শিল্প-শিক্ষা-সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দেখভালে। বার্লিনে বলেন, যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ছিলাম, আমাকে চিঠি লিখলে, আমাদেরই দায়িত্বে কয়েকদিনের জন্য তোমাকে বাংলাদেশে নিয়ে যেতাম, ৩০ বছর না-দেখা বাংলাদেশ দেখতে। চিঠি না লিখে ভুল করেছ। তিন দিনের আতিথ্যে যেহেতু বার্লিনে, বলতেই পারেন, কোন দায়দায়িত্ব ছাড়াই। বলি, একই বয়ান শুনেছি শেলিভাইয়ের (মুহম্মদ হাবিবুর রহমান) মুখে, বার্লিনে এসেছিলেন যখন। সময়ও কাটাই আমরা। তাঁকেও বলেছি, আপনাকেও বলছি, বার্লিনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে চিঠি লিখেছিলুম আপনাদের (রাষ্ট্রদূতের কথা : ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে পাঠিয়েছি।) চিঠি না পাওয়ার হেতু নেই কোন। শেলিভাইয়ের যুক্তি, তোমার অগ্রজদেরও বলতে পারতে, আমার সঙ্গে দেখা করে অনুরোধ জানাতেন। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী এসেছিলেন জার্মানির যালে বিশ্ববিদ্যালয়ে, অধ্যাপক ডক্টর গোলাম আবু জাকারিয়ার আমন্ত্রণে। যালে থেকে বার্লিনে। জাকারিয়া ফোন করে বলেন, সার (জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী) বার্লিনে যেতে চান আপনার ওখানে। স্বাগত জানাই। জেনে নিই কোন ট্রেনে, কখন আসবেন। ছিলেন তিন রাত দুই দিন। সকাল থেকে হাঁটাহাঁটিতে ক্লান্ত নন আদৌ। মিউজিয়াম থেকে ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্য জায়গাগুলো দেখায় বাদ নেই, সব নয়। আবার আসার ইচ্ছে। বলেন, এই ইতিহাসমাখা শহর সাত দিন দেখেও শেষ করা যাবে না। কত রকম মিউজিয়াম, কনসার্ট হল, অপেরা হাউস, থিয়েটার, ফিলহারমোনিক, বইয়ের দোকান, গ্যালারি। এখানকার ফুটপাত লন্ডনের চেয়েও বড়। বার্লিনে নিশ্চয় বাংলাদেশের অনেক স্কলার আছেন, নানা বিষয়ে পড়ছেন, গবেষণা করছেন। এ সবই সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতায়। জয়তু মুক্তিযুদ্ধ। - মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর গৌরব, উচ্ছ্বাস। বঙ্গবন্ধুকে প্রণতি। ডয়েচে ভেলের জন্য ইন্টারভিউ করলুম। পনের মিনিটের ইন্টারভিউয়ে (প্রচারিত দশ মিনিট) বাংলাদেশের সমকালীন শিল্পসাহিত্যই মুখ্য, রাজনীতিও প্রসঙ্গক্রমে। জিয়াউর রহমান ও বিএনপির রাজনীতি। বলেন, জিয়াউর রহমানই বাংলাদেশের সেকুলার রাজনীতির হত্যাকারী, শিল্পসাহিত্য সংস্কৃতির হত্যাকারী, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মূলে। বাংলাদেশের মূল চেতনা, মূল্যবোধের ধ্বংসের নিপুণ কারিগর। তাঁর যা প্রাপ্য নয়, দেয়া হচ্ছে তাঁকে। ইতিহাস নিশ্চয় ক্ষমা করবে না। আশা করি জীবদ্দশায় ইতিহাসের সঠিক গতিপথ দেখতে পাব। শহীদজননী জাহানারা ঈমামের প্রতি সর্বদাই আমার বিনীত শ্রদ্ধা। ইন্টারভিউয়ে নয়, অন্য সময়, একটি কাফেতে, কফি খেতে খেতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন যোগ দেননি, এই প্রশ্নে যে উত্তর, রীতিমতন বিস্মিত। একজন অধ্যাপকের নাম করেই বলেন, তিনিই আমাকে ঢুকতে দেননি, বার বার বাধা দিয়েছেন। তিনি ইংরেজী বিভাগেরই। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর কথাই মেনেছেন, গুরুত্ব দিয়েছেন। তাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী বিভাগে অধ্যাপনার সুযোগ পাইনি। ঢাকায় ফিরে জনকণ্ঠে একটি লেখাও লিখেছেন বার্লিন নিয়ে, কাটিংও পাঠিয়েছিলেন। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর সঙ্গে পরিচয় ছিল না, দেখিওনি বাংলাদেশে। নামের সঙ্গে অবশ্য পরিচয় স্কুলে পড়াকালীন। ঢাকার ১৪/২ মালিবাগের বাসায় পূর্বমেঘ আসে, তিন মাস পর পর। পড়ি। বুঝি বা না বুঝি। তাঁর সঙ্গে পরিচয় কথা-সংঘাতে। আইসিসিআর (ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনস্ )-এর নিমন্ত্রণে সস্ত্রীক দিল্লিমুল্লুক বেড়িয়ে কলকাতায় এসেছেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের বিভাগীয় প্রধান (এবং কলা বিভাগের ডিন) অধ্যাপক ডক্টর নরেশ গুহ। বিভাগের সেমিনার হলে (লাইব্রেরি কাম সেমিনার হল) জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর বক্তৃতা। আয়োজক নরেশ গুহ। ক্লাসে-ক্লাসে নোটিস দিয়েছেন আগের দিন। বক্তৃতা ক্লাস ছুটির পরে, পাঁচটায়। হলভর্তি শ্রোতা। অধিকাংশই বিভাগের ছাত্রছাত্রী, অন্য বিভাগেরও অনেকে। শিক্ষক-শিক্ষিকাও। সেমিনারে যেমন হয়, বক্তৃতার পরে প্রশ্নোত্তর। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী বাংলাদেশের হালের কবিতা নিয়ে কথা বলছেন। ৯০ ভাগই শামসুর রাহমানের কবিতা নিয়ে। বাংলাদেশে যেন আর কোন কবি নেই। বাংলাদেশের কবিতায় শামসুর রাহমান বিশেষ স্কুল তৈরি করেছেন, তাঁরই স্কুলে আজকের বাংলাদেশের কবিতা আন্দোলিত। Ñ কী বললেন? কোত্থেকে আবিষ্কৃত এই তথ্য? কবির নাম করে, কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করুন। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী হতচকিত। কেউ প্রতিবাদ করবে, প্রশ্ন তুলবে, চ্যালেঞ্জ জানিয়ে প্রমাণ চাইবে, আশা করেননি নিশ্চয়। নরেশ গুহ পরিচয় করিয়ে দেন, ‘ওর নাম ..., আমাদের এমএ পর্বে ছাত্র, অনার্সও এখান থেকে। বাংলাদেশের সাহিত্য নিয়ে মাঝে-মাঝে সেমিনার করে।’ একজন ছাত্রীর কণ্ঠ ভেসে এলো, ‘বাংলাদেশের সাহিত্য নিয়ে জ্ঞান দ্যায়’। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীই মুহূর্তে পাল্টে দিলেন হাওয়া। বললেন, ‘ওকে নিয়ে কবিতা লিখেছি, আমার ছয় নম্বর কবিতা। যদিও ওর নাম কোথাও উল্লেখ নেই। ওর একটি কবিতা নিয়ে বাংলাদেশ যখন তোলপাড়, লিখি সেই সময়। ওর বয়স তখন অল্প, কিশোর। ‘সমস্বরে আবদার, পড়ুন, পড়ুন। জয়তু জয়তু কবিতা/পানা পুকুরেই তুললে/চকিত ঢেউয়ের ধিক্কার।/মশার আঁধার আড্ডায়/জাগালে হুলের হিংসা।/ভীরুভক্তির কিল্লা/কঁাঁপলো পাথরে পাথরে।/কবি কিশোরের গুলতির/ধারালো পাথর খ-ে/জাগালো প্রলয় কা-/ধুলোয় গড়ালো গোলিয়া।/আকাশে ছুটলো চীতকার।/জেগেছে আবার কংস/কাঁপায় দারুণ হল্লা/প্রতিহিংসার পল্লী।/শিকারে ছুটেছে হুলিয়া।/কালো শক্তির কিল্লা/ভাঙছে পাথরে পাথরে।/জয়তু জয়তু কবিতা/উপমায় উজ্জীবিত (জয়তু কবিতা। হৃদয়ে জনপদে। প্রকাশকাল ১৯৭৫। ঢাকা)। এই কবিতা আর তিনবার শুনতে হয়েছে। অন্নদাশঙ্কর রায়ের ফ্ল্যাটে, শান্তিনিকেতনে, বার্লিনে। লক্ষ্য করেছি, প্রতিপাঠে কণ্ঠ আরো আবেগঘন। বার্লিনে শুনিয়ে কিয়তক্ষণ চুপ। চোখ থেকে চশমা খুলে, নরম কণ্ঠে, ‘দোষ আমাদেরই। তোমাকে নিয়ে যেতে পারি না। কোন আন্দোলনও গড়ে তুলতে পারি না। বাংলাদেশের একমাত্র নাগরিক গোলাম আযম, হাইকোর্ট থেকে নির্দেশিত। এই সার্টিফিকেট শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া, শেলিকেও দেয়নি। তোমাকে কোন সরকার নেবে না, মুখে যতই গণতান্ত্রিক সবক বলুক, ধর্ম ও মোল্লাচক্করের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত। ওঁদের মুখে-চেহারায় মুখোশ ও ভড়ং। মাঝে-মাঝে নিজেকেই ধিক্কার দিই। তোমার কবিতায় যে বৈশ্বিক বেদনা, আজকের বিশ্বের নানা দেশের মানুষের। তোমার অবসিডায়ান যিনি অনুবাদ করেছেন, তিনিও হয়ত এই বেদনায় জারিত। দেখি, তাঁর চোখ ভেজা। বলি, রেড ওয়াইন খাবেন? - খাই না। শুনেছি স্বাস্থ্যের জন্য ভাল। আচ্ছা, তোমার অনুরোধে ডিনারে এক গ্লাস খাব। শান্তিনিকেতনে (সেবাপল্লীতে) অন্নদাশঙ্কর-লীলা রায়ের বাড়ি, নাম ‘ইতি’। প্রতিমাসেই যেতে হয়, থাকি তিন দিন বা পাঁচ দিন। ইচ্ছেমাফিক। বাড়ির দেখাশোনা, খেদমত, টেলিফোন, বিদ্যুতের বিল পরিশোধ, পরিচারক গণেশের বেতন শোধ এবং বাড়ির কাঁচকলা, মুলো, আম, পেয়ারা, ডাব, নিজের হাতে লাগানো শাকসবজি নিয়ে কলকাতায় ফেরা। বিশ্বভারতীর বাংলাদেশী ছাত্রছাত্রী বিকেলে বা সন্ধ্যায় হাজির। বারান্দায়, বাগানে বা ছাদে আড্ডা। সাদী (সাদী মোহাম্মদ। রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী) বন্ধুদের নিয়ে, সারাক্ষণ দেখভালে লিলি (গাঙ্গুলি। চয়নকে বিয়ে করে ইসলাম। রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়িকা।), চয়ন ইসলাম (ডক্টর মাযহারুল ইসলামের ছেলে)। লিলি-চয়নের দাদা হয়ে খবরদারি, বকাঝকাও করি। দুজনের হুঁশিয়ারি, ‘শাসন করলে খাবার আনবো না।’ দুজন স্নেহের, হুঁশিয়ারি শিরোধার্য। জমাট আড্ডা, আসরে সাত-আটজন। সাইকেল-ঘণ্টি বাজিয়ে জাহানারা নিশির প্রবেশ। গত মাসে পরিচয়। পয়লা পরিচয়েই কত যেন আপন। বললেন, সার আপনাকে ডেকেছেন। শুনে রসিকতা, তোমার এখানে সার কে। প্রত্যেকে দা (মাস্টারকে দা, মাস্টারনিকে দি, এমন কি উপাচার্যকেও দা সম্বোধন)। সারকে পাঠিয়ে দাও। জাহানারা নিশি ॥ বড্ডো দেমাক, পেকেছেন। আপনার মতো হাজার-হাজার ফালতু এখানে, এক্ষণি জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী সারকে গিয়ে বলছি। হাত ধরে বলি, ক্ষমো হে নারী, দোষ তোমারই। সারের নাম বলনি। সারকে বলব, নিশি বলেছে জিল্লু ডেকেছে। নিশি ॥ কি মিথ্যুক, কি মিথ্যুক। বলে, নিশির ভ্যা ভ্যা কান্না, আমি কখনও জিল্লু বলিনি। জাহানারা নিশি তখন শান্তিনিকেতনে প্রাণ, বাংলাদেশী ছাত্রছাত্রীর, বাংলাদেশের মান্য অতিথিদেরও। প্রত্যেকেই ওঁর আপন, আত্মিক। জাহানারা নিশিই অবলম্বন, ওঁকে ছাড়া অচল। এমন আপন, এমন বান্ধব দুর্লভ। নিজের সুখ বাদ দিয়ে পরের দুঃখে কাতর, সর্বংসহা ধরণী যেন। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী বিশ্বভারতীতে তিন মাসের ভিজিটিং প্রফেসর। তিন মাসে বারকয়েক দেখা, আসছেন অন্নদাশঙ্কর-লীলা রায়ের ইতি বাড়িতে, বিকেলে বা সন্ধ্যায়। আসছেন বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীও। দূরত্ব বজায় রেখেও আড্ডায় সামিল। বলেন, ছাত্র-শিক্ষকের এ রকম পরিবেশই চেয়েছি। ইংল্যান্ডে পড়াকালীন ছাত্র-শিক্ষকের মিলন, সমাবেশের কথা বলেন। বিশ্বভারতীতেও এই পরিবেশ, বাংলাদেশেও হওয়া উচিত। জাহানারা নিশি বলেন, সার, আপনারাই বাধা দেবেন, আপনাদের চিনি। চিঠি লিখছেন জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, পোস্টকার্ডে। তারিখ ৮/১২/৮৪। শান্তিনিকেতন থেকে। প্রীতিভাজনেষু, দাউদ, আশা করি আমার আগের চিঠি পেয়েছ। কলকাতায় না যওয়ার কারণ সেখানে আছে। ইতিমধ্যে শিবনারায়ণ রায় এখানে এলেন- ওঁর সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ করে স্থির হয়েছে আমি জানুয়ারির ৪ তারিখে কলকাতা যাব - তিন দিন (৪-৫-৬) থাকব। ওঁদের শনিবারের বৈঠকে কিছু বলব, বা পড়ব। এ ছাড়াও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে এবং ঝধষঃ-ষধশব-এ ওঁর বাড়িতে কলকাতার সাহিত্যিকদের মধ্যে কলকাতার কয়েকজনের সঙ্গে মিলবার ব্যবস্থা উনি করবেন। তোমাকে একটা কাজ করতে হবে - ঐ তিন দিনের জন্য ভারতীয় ভাষা পর্ষদ বা মহারাষ্ট্র নিবাসে আমার জন্য একটা কামরা নড়ড়শ করে রাখতে হবে, এবং আমাকে বেশ আগে জানিয়ে দিতে হবে, কি ব্যবস্থা হলো। মোট কথা, কলকাতায় আমার ঢ়ৎড়মৎধসসব ও থাকার ব্যবস্থা - দুটোই পাকা করে আমি যেতে চাই। আশা করি ভাল আছ। প্রীতি ও শুভেচ্ছা জেনো। (চিঠি ও চিঠির বানান দ্রষ্টব্য। হুবহু, যা লিখেছেন, মুদ্রিত। যেহেতু হাতের লেখা জড়ানো, শব্দও জড়িয়ে গেছে, পাঠকের ভুল হতেই পারে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ভুল বাংলা লেখেন। অবশ্যই নন। চটজলদি লিখতে গিয়ে ‘আমি যেতে চাই’ লিখেছেন। হবে যেতে চাই। মনে রাখবেন, রবীন্দ্রনাথও ভুল লিখেছেন, দ্রুত লেখায়। সবচেয়ে খারাপ উপন্যাস শেষের কবিতায় তিনটি বাক্যই ভুল। আমরা বলি, পোয়েটিক মিসটেকস্। কবির ভুল মান্য। ব্যাকরণের কোন নিয়মেই মান্যতা হয় না, রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন কাব্যের প্রয়োজনে, মানতেই হবে। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী মন ও মননে আপাদমস্তক, প্রতি ইঞ্চি কবি)। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ওঁর কবিতা সংগ্রহসহ কয়েকটি অনুবাদগ্রন্থ, শেক্সপিয়রের সনেটের অনুবাদ-গ্রন্থও উপহার দেন। অতিশয় বিনয়ী, জানতে চান অনুবাদ বিষয়ে। বলি, মূল ছেড়ে কেন অনুবাদ পড়ব। পড়লে নিশ্চয় ঝগড়া হবে। বার্লিনে, দুদিনে, ওঁর সান্নিধ্যে কেবল সাহিত্য, শিল্প, রাজনীতি নিয়ে তর্ক নয়, দুই প্রজন্মের চিন্তাভাবনার শৈল্পিক বিনিময়ও। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীকে কাছে পেয়ে ধন্য। জয়তু কবিতা, জয়তু মুক্তিযুদ্ধ। জয়তু জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। সরি, আর পাঁচজন বাঙালীর মতো আপনার ফালতু অবিচুয়ারি লিখতে পারলুম না, শিক্ষা ও কালচারে নিশ্চয় ঘাটতি। মার্জনাপ্রার্থী। মৃতকে বিনীত শ্রদ্ধা।
×