ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জাতীয় পতাকা বেচে জীবিকা

ফেরিওয়ালার পথচলা, উড়ছে লাল-সবুজের বিজয় নিশান

প্রকাশিত: ০৪:৪৭, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৪

ফেরিওয়ালার পথচলা, উড়ছে লাল-সবুজের বিজয় নিশান

তাহমিন হক ববি ॥ বাঙালীর জাতীয় জীবনে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিন আসে, যখন দেশপ্রেম আঞ্চলিক সীমানা পেরিয়ে বাঁধভাঙ্গা জোয়ার হয়ে দেখা দেয়। জাতীয় পতাকা হয়ে ওঠে ঐক্যের প্রতীক, আবেগের বহির্প্রকাশ। আর এই জাতীয় পতাকা মানুষের হাতে হাতে পৌঁছে দিতে কেউ কেউ পরিভ্রমণ করেন মাইলের পর মাইল। এ যেন আত্মার টান। দেশের এক প্রান্ত থেকে হেঁটে অন্য প্রান্তের নানা পেশা, নানা বয়সী মানুষের হাতে পৌঁছে দিচ্ছেন লাল-সবুজের পতাকা। চারদিকে লাল-সবুজের ফেরিওয়ালাদের পথচলায় উড়ছে বিজয়ের নিশান, যেন ভিন্ন পরিবেশ। বিজয়ের মাস ডিসেম্বর ঘিরে উত্তর জনপদের রংপুর, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারীসহ অন্য জেলাশহর, গ্রামগঞ্জের পথে-ঘাটে চলছে লাল-সবুজের পতাকা বিক্রির ধুম। ফেরিওয়ালাদের কাঁধে নানা আকারের জাতীয় পতাকা। ছোট ছোট লাল-সবুজের ভালবাসায় সিক্ত হয়ে উঠেছে উত্তর জনপদের জীবন। তাদের পথচলায় বর্ণিল হয়ে উঠেছে পথ-ঘাট। লাল-সবুজের এই ফেরিওয়ালারা এসেছেন মুন্সীগঞ্জ থেকে। প্রায় সাড়ে চার শ’ কিলোমিটার দূরত্ব। এতটা পথ পেছনে ফেলে এসে উত্তর জনপদে হেঁটে হেঁটে বিক্রি করছেন আবেগের লাল-সবুজের পতাকা। লাল-সবুজের পতাকা কাঁধে নিয়ে তারা কেবল জীবিকার পথই বেছে নেননি, এ পেশার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি। ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় দিবস, ২১ ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এবং ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সারাদেশে পতাকা বিক্রির ধুম পড়ে যায়। বিশেষ করে উত্তাল মার্চ আর বিজয়ের ডিসেম্বর এলেই বাঙালীর মনেপ্রাণে জেগে ওঠে দেশাত্ববোধ। লাল-সবুজের ভালবাসায় বর্ণিল হয়ে ওঠে সবকিছু। শুধু জাতীয় পতাকা নয়, পোশাক পরিচ্ছদেও দেখা যায় লাল-সবুজের ছোঁয়া। আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক লাল-সবুজে উদ্বেলিত হয়ে পড়ে পুরো জাতি। লাল-সবুজের এ পতাকা আমাদের শেখায় দেশ ও জনগণের পক্ষে কথা বলা, বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের পরিচিত করে স্বাধীন সার্বভৌম অকুতোভয় জাতি হিসেবে, সাহস যোগায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার। এবারে বিজয় দিবসকে সামনে রেখে উত্তরের নীলফামারী, রংপুর, পঞ্চগড়, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার প্রতিটি এলাকা জাতীয় পতাকা ফেরিওয়ালাদের পথচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে। গত বছরের তুলনায় এবারে বিজয় দিবস, হানাদার মুক্ত দিবস এবং ছিটমহলসহ উত্তরের জেলাগুলোতে পতাকা ফেরিওয়ালার সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়েছে। বিক্রিও হচ্ছে প্রচুর। মুন্সীগঞ্জ থেকে আসা ফেরিওয়ালা রুস্তম আলী জানান, এবারে চাহিদার কারণে ফেরিওয়ালার সংখ্যাও বেড়েছে। রংপুর বিভাগের আট জেলার বিভিন্ন স্থানে ‘হানাদারমুক্ত দিবস’ ছাড়াও বিজয় দিবসের র‌্যালির জন্য প্রচুর ছোট-বড় পতাকা বিক্রি হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ছিটমহলেও অনেক পতাকা বিক্রি হয়েছে। তিনি জানান, গত বছর ছিটমহলে জাতীয় পতাকা বিক্রি না হলেও এবার বেশ হয়েছে। মুন্সীগঞ্জের লোহজং উপজেলার হলুদিয়া গ্রামের গোলাম মোস্তফা। নীলফামারীতে এসেছেন তিনি জাতীয় পতাকা বিক্রি করতে। তাঁর সঙ্গে কথা হলে তিনি গর্ব করে বলেন, ডিসেম্বরের শুরুতেই এই অঞ্চলে জাতীয় পতাকা বিক্রি করতে এসেছি। পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া থেকে ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, রংপুর, কুড়িগ্রাম ঘুরে নীলফামারী এসেছি। সবখানেই জাতীয় পতাকার চাহিদা প্রচুর। দেশের মানুষ এখন স্বাধীনতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার। সবাই এখন লাল-সবুজের পতাকা, মাথায় বাধার জন্য লাল-সবুজের ফিতা কিনতে আগ্রহী। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় ছোট ছিলাম। এখন জাতীয় পতাকা বিক্রি করে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি। তাই পতাকা বিক্রিকেই পেশা হিসেবে নিয়েছি। প্রতিবছর বিজয়ের মাস, ২১ ফেব্রুয়ারি ও ২৬ মার্চ দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে ঘুরে পতাকা বিক্রি করি। বাঁশের লাঠির সঙ্গে বিভিন্ন মাপের পতাকা বেঁধে হেঁটে হেঁটে বিক্রি করতে ভালই লাগে। তিনি বলেন, সংসারে অভাবের কারণে পড়ালেখাও তেমন করতে পারিনি। ছোট ছিলাম বলে মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারিনি, তবে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনেছি। লাল-সবুজের এ পতাকার জন্যই মানুষ যুদ্ধ করেছে। ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছে, দুই লাখ মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছেন। এত কিছুর বিনিময়ে যে পতাকা, সেই পতাকা বিক্রি করতে পারাটাও সম্মানের ব্যাপার। ঢাকার নবীনগর এলাকা থেকে আসা মুন্না মিয়া জানান, বিজয় দিবস উপলক্ষে এমনিতেই ছোট-বড়, মাঝারি সাইজের জাতীয় পতাকা প্রচুর বিক্রি হয়। তারা নিজেরাই এ পতাকা তৈরি করেন। বিভিন্ন জাতীয় দিবসের আগে তাঁরা বিভিন্ন মাপের পতাকা তৈরি করে। জাতীয় পতাকা বিক্রি করে তাঁরা যেমন আত্মতৃপ্তি পান, তেমনি এই পতাকা তাঁদের সংসারের ভরণপোষণের খরচ যোগায়। লাল-সবুজের ফেরিওয়ালারা জানান, ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত শহর-বন্দর, গ্রামগঞ্জের পথে-ঘাটে নানা আকারের লাল-সবুজের পতাকা ফেরি করে বিক্রির পর তারা ফিরে যাবে নিজ নিজ এলাকায়। আবার ২১ ফেব্রুয়ারি আর ২৬ মার্চ এলে তারা ফের বেরিয়ে পড়বে লাল-সবুজের চেতনা ছড়িয়ে দিতে।
×