ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বুদ্ধিজীবী হত্যার দুই ফাঁসির আসামি ফেরত আনার উদ্যোগ

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৪

বুদ্ধিজীবী হত্যার দুই ফাঁসির আসামি ফেরত আনার উদ্যোগ

শংকর কুমার দে ॥ বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলার মৃত্যুদ-াদেশপ্রাপ্ত ফাঁসির আসামি চৌধুরী মাইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামানকে বিদেশ থেকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বর্তমানে চৌধুরী মাইনুদ্দিন আছে যুক্তরাজ্যে ও আশরাফুজ্জামান আছে যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক হিসেবে। গত বছর বুদ্ধিজীবী দিবসের আগে তাদের বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলায় ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। তাদের বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় দেয়ার পর গত এক বছর ধরে তাদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে মামলার নথি গায়েব করে দেয়ার মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলাটি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন প্রথমবার সরকার ক্ষমতায় এসেই বুদ্ধিজীবী হত্যার মামলা সচল ও বিচারের আইনী প্রক্রিয়া চালু করার মধ্য দিয়ে এই দুই বুুদ্ধিজীবী হত্যাকারী চৌধুরী মাইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামানের ফাঁসির রায় হয়। তাদের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিস জারি করা হয়েছে। চৌধুরী মাইনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামানকে বিদেশ থেকে ফিরিয়ে আনার কূটনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে বলে জানা গেছে। গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুরের বেজড়া ভাটরা (চিলেরপাড়) গ্রামের মৃত আজহার আলী খানের ছেলে আশরাফুজ্জামান খান এবং ফেনী জেলার দাগনভুঞার চানপুর চৌধুরী বাড়ি (জগতপুর ফালিজেরঘাট) গ্রামের মৃত দেলোয়ার হোসেন চৌধুরীর ছেলে চৌধুরী মাঈনুদ্দিন। আলবদর বাহিনীর লন্ডন প্রবাসী চৌধুরী মাঈনুদ্দিন ও নিউইয়র্ক প্রবাসী আশরাফুজ্জামানÑ এই দুই জনের উপর বুদ্ধিজীবী নিধনের উপর ডেভিড বার্গম্যান ওয়ার ক্রাইম ফাইল ডকুমেন্টারি নির্মাণ করে তা লন্ডনের টুয়েনটি টুয়েনটি টেলিভিশন চ্যানেল ফোরের প্রচার করেছে। এ দুই জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষে ১৬টি অভিযোগ দাখিল করা হয়। গণহত্যা, হত্যা, অপহরণ, নির্যাতনসহ ৫ ধরনের অভিযোগে চৌধুরী মাঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ জন শিক্ষক, ৬ জন সাংবাদিক ও ৩ জন চিকিৎসকসহ ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে অপহরণ ও হত্যার অভিযোগে বিচারের রায়ে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, ’৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর রাতে দৈনিক ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক সিরাজ উদ্দিন হোসেন এবং পিপিআইয়ের চীফ রিপোর্টার সৈয়দ নাজমুল হককে তাদের বাসা থেকে অপহরণ করা হয়। ১১ ডিসেম্বর ভোর রাতে দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার চীফ রিপোর্টার আ ন ম গোলাম মোস্তফা, ১২ ডিসেম্বর বিবিসির সংবাদদাতা ও সাবেক পিপিআইয়ের জেনারেল ম্যানেজার নিজাম উদ্দিন আহমদ, ১৩ ডিসেম্বর তারিখে দৈনিক শিলালিপি পত্রিকার সম্পাদিকা সেলিনা পারভীন এবং ১৪ ডিসেম্বর দৈনিক সংবাদের যুগ্ম সম্পাদক শহীদুলা কায়সারকে অপহরণ করা হয়। একইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, ড. আবুল খায়ের, ড. সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. সিরাজুল হক খান, অধ্যাপক ফয়জুল মহি, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, মুনীর চৌধুরী এবং একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক চিকিৎসক ডাঃ মোহাম্মদ মর্তুজাকে অপহরণ করা হয়। ১৫ ডিসেম্বর বিশিষ্ট চক্ষু চিকিৎসক ডাঃ আলিম চৌধুরী এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বিশিষ্ট কার্ডিওলজিস্ট ডাঃ ফজলে রাব্বীকে অপহরণ ও নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। অপহƒত সাংবাদিকদের মধ্যে সেলিনা পারভীনের অর্ধগলিত লাশ রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে একাত্তর সালের ১৮ ডিসেম্বর পাওয়া যায়। অন্য সাংবাদিকদের লাশের সন্ধান পাওয়া যায়নি। দুই বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ছাত্রসংঘের সদস্যদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গড়ে তোলা হয়। অভিযুক্ত দু’জন ছাত্রজীবন থেকে ইসলামী ছাত্রসংঘের সক্রিয় সদস্য হিসেবে এবং পরবর্তী সময়ে হাইকমান্ডের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নেন। মাঈনুদ্দীন আলবদর বাহিনীর ‘অপারেশন ইনচার্জ’ এবং আশরাফুজ্জামান ‘চীফ এক্সিকিউটর’ বা ‘প্রধান জলাদ’ ছিলেন। তাদের নেতৃত্বে আলবদরের একটি সশস্ত্র দল পরিকল্পিতভাবে ঢাকার বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ করে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করে। তারা স্বাধীনতার ঊষালগ্নে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে তুলে মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের নির্যাতন ক্যাম্পে নিয়ে যেতেন। সেখানে আটকে রেখে তাদের ওপর নির্যাতন করা হতো। তারপর মিরপুর ও রায়েরবাজার ইটখোলা বধ্যভূমিতে নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে লাশ ফেলে দিতেন। রমনা থানায় দায়ের করার বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলার বাদী ফরিদা বানুর বর্ণনা অনুযায়ী ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের আগ মুহূর্তে ১৪ ডিসেম্বর পাক হানাদারদের দোসর এদেশীয় আলবদর বাহিনী দেশের শ্রেষ্ট সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। বাদী ফরিদা বানুর ভাই অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সিনিয়র লেকচারার ও মুহসীন হলের হাউস টিউটর ছিলেন। ’৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সকালে ঘাতকরা মুহসীন হলের সংলগ্ন বাসায় গিয়ে তার ভাইকে না পেয়ে হলের দিকে যায়। ঘাতকরা হলের সামনে গিয়ে তার ভাইকে পেয়ে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। এ সময় ঘাতকরা হলের দারোয়ান আবদুর রহিমের চোখ গামছা দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়। এরপর থেকে তার ভাই আর ফিরে আসেনি। হলের ছাত্র বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন। পরবর্তীতে তিনি জানতে পারেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ ছাড়াও অধ্যাপক ড. মোঃ মুর্তজা, ড. আবুল খায়ের, অধ্যাপক রশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক সিরাজুল হক, ড. সন্তোষ ভট্টাচার্যসহ আরও অনেককেই ধরে নিয়ে গেছে পাক হানাদার বাহিনীর দোসর আলবদর বাহিনীর সদস্যরা। সেই বুদ্ধিজীবীরা আর তারা ফিরে আসেননি। গত বছরের ২ মে দু’জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এরপর তাদের ট্রাইব্যুনালে হাজির হতে দুটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এরপরও তারা হাজির না হওয়ায় গত ২৭ মে তাদের পলাতক ঘোষণা করে ট্রাইব্যুনাল। তাদের পক্ষে রাষ্ট্রীয় খরচে আব্দুস শুকুর খান ও সালমা হাই টুনিকে আইনজীবী নিয়োগ দেয় ট্রাইব্যুনাল। অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনা করেন প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী ও প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাদের অনুপস্থিতিতেই মৃত্যুদ-াদেশ রায় ঘোষণা করেন।
×