ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

গোলাপ বানু কথা

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ১১ ডিসেম্বর ২০১৪

গোলাপ বানু কথা

সুমী খান ॥ গোলাপ বানু। জীবন সংগ্রামের দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে অর্জন করেছেন রোকেয়া পদক-২০১৪। জীবনযুদ্ধে জয়ী গোলাপ বানু বারিধারা মহিলা সমবায় সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী। সমিতির অন্যান্য বোর্ড মেম্বারের মতোই গোলাপ বানু ৫শ’ টাকা সম্মানী এবং ৫শ’ টাকা মোবাইল ভাতা পান। এখনও তিনি এ দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। ১৯৯৬ সালে ৫ হাজার টাকা নিয়ে বারিধারা মহিলা সমবায় সমিতির কাজ শুরু করে রাজধানীর ৬টি থানা এলাকার ৪৩ হাজার নারীকে স্বাবলম্বী করে তোলার মাধ্যমে ১শ’ সত্তর কোটি টাকার ফান্ড গড়ে তুলেছেন। এই প্রতিষ্ঠানে এখন ৪৫ জন স্টাফ কাজ করছেন। একজন সাধারণ পরিবারের নারীর এই অর্জন গর্বিত করেছে রাষ্ট্র এবং সমাজকে। এই কর্মবীরকে তাঁর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ৯ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোকেয়া পদক হিসেবে একটি স্বর্ণপদক এবং এক লাখ টাকা প্রদান করলেন। গোলাপ বানুর নাম আগে কখনই সেভাবে শোনা যায়নি। আর তাই তাঁকে নিয়ে অনেকের আগ্রহ। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে খোঁজ মেলে গোলাপ বানুর। তাঁর যোগাযোগের নম্বর মন্ত্রণালয় থেকে দিলেও সেই নম্বর বন্ধ পাওয়া গেল। বারিধারা মহিলা সমবায় সমিতির ম্যানেজার নিত্য অধিকারীর মাধ্যমে সমিতির ঠিকানা নিয়ে বুধবার দুপুরে এই প্রতিবেদক রাজধানীর ভাটারা, নূরের চালা এলাকায় হাজির হয়। নূরের চালা বাজারে চার কাঠা জমিতে সমিতির নিজস্ব ছয়তলা ভবনের ধাপে ধাপে নারীদের পদচারণা। অধিকাংশই ঋণ নিতে বা কিস্তির টাকা দিতে এসেছেন। বিউটি বেগমের সঙ্গে কথা হলো। সাত বছর এই সমিতির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক। ৭ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে স্বামীকে ব্যবসা শুরু করতে দিয়েছিলেন। নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করে এখন নতুন করে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিচ্ছেন। স্বামী এখন গাড়ির ব্যবসা করেন। এমন আরও অনেকে শিশু সন্তান নিয়ে ঋণ বই হাতে এসেছেন। এদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এবং সমবায়ের ইতিহাস, নানান অর্জনের ছবি দেখতে দেখতে নিত্য অধিকারীর সঙ্গে সমিতি ভবনের পঞ্চম তলায় এলেন গোলাপ বানু। বললেন, হাতে কোন ব্যাগ অথবা মোবাইল নিয়ে পথে বেরুনো কোনভাবেই পছন্দ নয় গোলাপ বানুর। মোবাইলে রিংটোন তার বিরক্তি ঘটায়। আর তাই মুঠোফোনটি বাড়িতেই রাখেন গোলাপ বানু। রাজধানীর শাহজাদপুর এলাকার সাধারণ কৃষক আলীমুদ্দিন বেপারীর ৬ সন্তানের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান গোলাপ বানুর জন্ম কোন্ সালে তিনি জানেন না। তবে বারিধারা মহিলা সমবায় সমিতির কাগজপত্রে গোলাপ বানুর জন্ম তারিখ ১৯৬৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর। ১৯৭৫ সালে কিশোরী গোলাপ বানুকে বাবা-মা রাজমিস্ত্রি মোহাম্মদ হাবিবুর রহমানের সঙ্গে বিয়ে দেন। হতদরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান হবার কারণে গোলাপ বানু স্কুলে যাবার কোন সুযোগ পাননি। সাধারণ এক রাজমিস্ত্রির স্ত্রী গোলাপ বানু কখনও পায়ে স্যান্ডেল পরেননি। পর পর তিন সন্তানের জন্মের পর তাদের মুখে খাবার তুলে দেয়া, তাদের শিক্ষার সুযোগ করে দেবার জন্য উপায় খুঁজছিলেন মনে মনে। সেই সময়ে ওয়ার্ল্ডভিশন থেকে বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র পরিচালনা করলে গোলাপ বানু পিছিয়ে যান লজ্জায়। জনকণ্ঠকে বললেন, ‘বয়স্ক শিক্ষায় আমি তখন বিশ্বাস রাখতে পারি নাই।’ অর্থিক অনটনের কারণে শৈশবে স্কুলে যাননি। তিন সন্তানের মা হবার পর নতুন করে পড়ালেখা করবেন কি করে? দ্বিধান্বিত গোলাপ বানুকে ওয়ার্ল্ডভিশনের কর্মকর্তারা বোঝালেন, ‘মানুষ বয়সের ভারে বৃদ্ধ হয়, পড়ালেখার ভারে নয়। পড়ালেখা না জানলে তার টিপসই নিয়ে তাঁকে পদে পদে ঠকাতে পারে সুযোগসন্ধানীরা।’ নিজের সাথে মনে মনে লড়াই করলেন গোলাপ বানু।এক সময়ে সিদ্ধান্ত নিলেন যেভাবে হোক, তাকে স্বাক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন হতেই হবে। বয়স্ক শিক্ষার ৬ মাসের কোর্সে তিন মাস পরপর দু’বার পরীক্ষা হতো। দু’বার ই ১২/১৩ জন ছাত্রীর মধ্যে প্রথম হলেন গোলাপ বানু। এতে ওয়ার্ল্ড ভিশন কর্মকর্তাদের আন্তরিক সহযোগিতা বেড়ে যায় গোলাপ বানুর প্রতি। সমিতির সদস্য হতে ২শ’ টাকা করে জমা দিতে বলা হলো ওয়ার্ল্ডভিশন থেকে। গোলাপ বানুসহ শাহজাদপুরের হতদরিদ্র নারীদের কাছে ২শ’ টাকা একেবারেই অধরা ছিল তখন। তাঁদের অসহায়ত্ব বুঝতে পেরে ওয়ার্ল্ডভিশনের পক্ষ থেকে পরামর্শ দেয়া হলো প্রতিদিন মুঠো চাল জমা করে তা বিক্রি করে টাকা জমানোর জন্য। সেভাবেই গড়ে উঠল সমিতি। সেই ধারাবাহিকতায় ৫শ’ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ পেতেন সমিতির সদস্যরা। এগিয়ে গেলেন গোলাপ বানু। শিশুদের স্পন্সরশিপ দিয়ে স্কুলে পড়ানোর ব্যবস্থা করা হতো। ছেলে হাবিবুর রহমানের ৫ বছর বয়স না হলে ওয়ার্ল্ডভিশওনের নিয়ম অনুযায়ী তাকে তালিকাভুক্ত করা যাচ্ছিল না। আর্থিক সামর্থ্য না থাকলেও মুসলিম পরিবারের নারীরা অনেকে তাদের সন্তানদের ওয়ার্ল্ডভিশনের প্রজেক্টে স্পন্সরশিপ নিয়ে স্কুলে পড়াতে ভয় পাচ্ছিলেন, যদি খ্রীস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়! কিন্তু গোলাপ বানু কোনভাবেই দমে যাবার মতো মা নন। তিনি তাঁর সন্তানকে স্কুলে পাঠাবেনই। জনকণ্ঠকে বললেন ,‘আমি মনে মনে বলছি, আল্লাহর এই দুনিয়ায় সব ধর্মই আল্লাহর। আমার সন্তানরে যদি খ্রীস্টানও করে দেয়, তবু আমি তারে পড়ামুই। কিন্তু আমরা যে যার ধর্ম পালন কইরাই নিজেরাও স্বাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন হইছি, আমাদের সন্তানদেরও শিক্ষিত করছি। এখন আমার কয়েকজন নাতি নাতনি। তারাও এইচএসসি পাস করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করমু তাদের।’ সেই সময়ে নিজের মতো যেন সন্তানদের নিরক্ষর জীবন টেনে নিতে না হয় সেই প্রতীজ্ঞায় গোলাপ বানু কাকুতি মিনতি করে তাঁর তিন সন্তানকেই পর্যায়ক্রমে স্কুলে পড়ানোর ব্যবস্থা করায় ওয়ার্ল্ডভিশনের স্পন্সরশিপে। তবে তার ছেলে এসএসসি পাস করলেও আর্থিক টানাপোড়েনের কারণে তিন মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছে, মেজো মেয়ে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছে এবং ছোট মেয়েকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়িয়ে তার পড়ালেখা বন্ধ করে দিয়েছেন গোলাপ বানু। এর মধ্যে ওয়ার্ল্ডভিশনের প্রজেক্ট বন্ধ করে তারা চলে যাবার সিদ্ধান্ত জানান সদস্যদের। এ কথা জানতে পেরে কাজ এগিয়ে নেবার পথ খোঁজেন ওয়ার্ল্ডভিশনের কর্মকর্তাদের কাছে। ওয়ার্ল্ডভিশনের প্রজেক্ট ম্যানেজার নিত্য অধিকারীকে ৪/৫ বছর কাছে থেকে দেখে তার সততা এবং আত্মবিশ্বাসে গোলাপ বানু ওয়ার্ল্ডভিশনের কর্মকর্তাদের প্রস্তাব দেন নিত্য অধিকারীকে ম্যানেজার করে স্থানীয়ভাবে কোন সমিতি করে দিতে। প্রস্তাবটি সুচিন্তিত কিনা জানতে চান ওয়ার্ল্ডভিশনের কর্মকর্তারা। দৃঢ়তার সঙ্গে গোলাপ বানু বলেন, এতবছরে ‘দাদারে যে সততা আর পরিশ্রমের সঙ্গে কাজ করতে দেখছি, আমাদের যত সহযোগিতা করতে দেখছি, তার বারিধারা মহিলা সমবায় সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে ১৯৯৬ সাল থেকে সাধারণ দরিদ্র নারীদের স্বাবলম্বী এবং স্বাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন করার উদ্যোগ নেন। গোলাপ বানু বারিধারা মহিলা সমবায় সমিতির প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৯৬ সালে। কুড়ি টাকার বেশি গুনতে পারতেন না। বোনের ছেলের কাছে গিয়ে বললেন, ‘তোরা এক শ’ টাকা কি করে গুনিস্ শেখাবি?’ সেই তিনিই এখন শত কোটি টাকার কাগজে স্বাক্ষর করেন। এখন লেখা দেখেই বুঝতে পারেন সব। শুধু তা-ই নয়, একসময় অর্থাভাবে ছেলেমেয়েদের মুখে তিন বেলা ঠিকমতো খাবার তুলে দিতে পারতেন না। তাদের লেখাপড়াও করাতে পারেননি। আর এখন তিনি নিজের গড়া সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে তিন তলা বাড়ি করেছেন। মাসে ৩০ থেকে ৩২ হাজার টাকা বাড়িভাড়া পান। একই সঙ্গে তাঁর সমিতি থেকেই ৪৩ হাজার নারী ঋণ নিয়ে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। রোকেয়া পদকের এক লাখ টাকা প্রসঙ্গে গোলাপ বানু বললেন, ‘এই পুরস্কার পাবার আগে বেগম রোকেয়া সম্পর্কে আমি কিছু জানতাম না। পরে আমার নাতি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য গাইড পড়তেছিল, তখন তার পড়াটা মনোযোগ দিয়া শুনছি। বুঝলাম কত বড় মানুষের নামে এই পুরস্কার। তাই টাকার চাইতেও এই পুরস্কারের সম্মানটারে বেশি গুরুত্ব দিই আমি।’ একই সঙ্গে বলেন, ‘এইডা সত্য যে, এক লাখ টাকা আমার কাছে অনেক টাকা। টাকা না থাকার যে কি কষ্ট সেইডা আমি জানি। ছনের কুঁড়েঘরে বৃষ্টি হইলেই পানি পড়ত। মুরগি যেমন তার পালকের নিচে ছানা আগলে রাখে, আমিও ওপরে পলিথিন দিয়া আমার ছোট ছোট চার ছেলেমেয়েরে বৃষ্টির পানি থেইকা সামলাইয়া রাখতাম।’ জনকণ্ঠকে গোলাপ বানু বলেন, এই সমিতি থেকে একদিন একটি বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তুলবেন, যাতে অসহায় নারীরা তাদের শেষ বয়সে আশ্রয় পান। একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অর্জন প্রাপ্তি তাকে নোবেল জয়ের স্বপ্নে উজ্জীবিত করেছে বলে জানালেন গোলাপ বানু।
×