ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

যুক্তরাষ্ট্রের সংগঠন কোয়ালিশন ফর জিএসপির রিপোর্টে উদ্বেগ;###;স্থগিতাদেশের এক বছরে মার্কিন ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত কর দিতে হয়েছে ৬৭২ মিলিয়ন ডলার

জিএসপি সুবিধা স্থগিত ॥ মার্কিন অর্থনীতিতে নতুন সঙ্কট

প্রকাশিত: ০৩:৪১, ১১ ডিসেম্বর ২০১৪

জিএসপি সুবিধা স্থগিত ॥ মার্কিন অর্থনীতিতে নতুন সঙ্কট

এম শাহজাহান ॥ বাংলাদেশে প্রভাব না পড়লেও জিএসপি সুবিধা স্থগিত করার পর যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি নতুন সঙ্কটের মধ্যে পড়েছে। জিএসপি এ্যালায়েন্সের আওতায় বাংলাদেশসহ বিশ্বের ২২টি দেশকে রফতানিতে বিশেষ সুবিধা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। প্রায় এক বছরের বেশি সময় ধরে এই সুবিধা স্থগিত করে দেয়া হয়েছে। এতে করে অতিরিক্ত করের ফাঁদে পড়ে লোকসানের মুখে পড়ছেন দেশটির আমদানিকারকরা। পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় কমে গেছে বিক্রি। ফলে দেশটির খুচরা বিক্রেতারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আবার কোন কোন কোম্পানি খরচ কমাতে গিয়ে শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত করতে বাধ্য হচ্ছে। এর ফলে দেশটির কর্মসংস্থানেও পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। এ কারণে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র নিজে দেশের স্বার্থেই চলতি ডিসেম্বরের রিভিউ শুনানিতে বাংলাদেশের অবস্থানপত্রের ওপর ইতিবাচক মন্তব্য প্রদান করবে। ফলে জিএসপি সুবিধা ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের। ‘লস্ট সেলস, ইনভেস্টমেন্ট এ্যান্ড জবস ॥ ইমপ্যাক্ট অব জিএসপি এক্সপিরেশন আফটার ওয়ান ইয়ার’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসা-বাণিজ্যের এই উদ্বেগজনক তথ্য তুলে ধরেছে মার্কিন কোম্পানিগুলোর সংগঠন কোয়ালিশন ফর জিএসপি। ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের দূতাবাস থেকে প্রতিবেদনটি সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। জানা গেছে, কোয়ালিশন ফর জিএসপির জরিপ প্রকাশের পর মার্কিন নীতি নির্ধারণে ভূমিকা রাখে এমন প্রভাবশালী কংগ্রেসম্যানদের ওপর এক ধরনের চাপ তৈরি হয়েছে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নেয়ার ব্যাপারে। এ ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য বাঁচাতে যত দ্রুত সম্ভব জিএসপি স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নেয়ার জন্য অন্তত ৬২০টি আমেরিকান কোম্পানি মার্কিন কংগ্রেসকে অনুরোধ জানিয়েছে। জিএসপি স্থগিতাদেশের কারণে গত আগস্ট মাসে মার্কিন আমদানিকারকদের ৫৮ মিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত কর প্রদান করতে হয়েছে। এ কারণে ২০১৪ সালের মধ্যে এই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে না নিলে এই ব্যয় বেড়ে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। মার্কিন কোম্পানিগুলোকে প্রতিদিন ২ মিলিয়ন ডলার করে অতিরিক্ত কর দিতে হচ্ছে। এর ফলে স্থগিতাদেশের এক বছরে কর বাবদ ৬৭২ মিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয়েছে ব্যবসায়ীদের। ৪০টি প্রদেশের বিভিন্ন কোম্পানিকে এক মিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত কর দিতে হচ্ছে। এতে করে দেশটির ছোট কোম্পানিগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শওকত আলী ওয়ারেসী জনকণ্ঠকে বলেন, জিএসপি স্থগিত হওয়ার পর দেশের তৈরি পোশাক রফতানির ওপর কোন নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। তবে যেসব পণ্য রফতানিতে এতদিন জিএসপি সুবিধা পাওয়া যেত সেখানে কিছুটা ক্ষতির আশঙ্কা থাকলেও পোশাকে নেই। কারণ পোশাক রফতানিতে আগেও জিএসপি সুবিধা পাওয়া যায়নি। জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি সুবিধা স্থগিত করলেও আগামী ২০২১ সালের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সরকার ও উদ্যোক্তারা যৌথভাবে রোডম্যাপ বাস্তবায়নে কাজ শুরু করেছে। রফতানি বাড়াতে প্রচলিত মার্কেটের পাশাপাশি অপ্রচলিত মার্কেটের দিকে বেশি নজর দেয়া হচ্ছে। পোশাকের ডিজাইন, ফ্যাশন ও গুণগত মান উন্নয়ন বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন উদ্যোক্তারা। শ্রমিকদের দক্ষ করে তুলতে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে শ্রমিকদের জন্য মজুরি বোর্ড গঠন করেছে সরকার। নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত ও শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে ইতোমধ্যে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এ ছাড়া গার্মেন্টস পল্লী স্থাপনসহ স্বল্পসুদে ব্যাংক ঋণের সুবিধা দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার। এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি সুবিধা স্থগিত করায় তার কোন প্রভাব পড়েনি বাংলাদেশে। উপরন্তু যেসব পণ্য বিশেষ সুবিধায় দেশটিতে রফতানি হতো চলতি বছরে সেসব পণ্যের রফতানির পরিমাণ আরও বেড়েছে। অন্যদিকে জিএসপি স্থগিতের ফলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে চীন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমিশনের (ইউএসআইটিসি) বরাত দিয়ে সম্প্রতি ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে সরকারের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে এসব কথা বলা হয়েছে। তবে জিএসপি সুবিধা স্থগিত হওয়ার পর যেসব দেশ বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে উজবেকিস্তান, প্যারাগুয়ে, লেবানন, মিসর, তিউনিশিয়া এবং ইউক্রেন। এসব দেশের রফতানির পরিমাণ কম হওয়ায় তারা মার্কিন বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। অপরদিকে, জিএসপি সুবিধা স্থগিত হওয়ার পরও প্লাস্টিক, সিরামিকস ও তামাক রফতানি ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র না হলে জিএসপি পাওয়া যাবে ॥ রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র না হলে আবারও জিএসপি সুবিধা পাওয়া যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। এ্যাকশন প্লানের ১৬টি শর্ত পূরণ করতে সক্ষম হবে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে ১৪টি শর্তপূরণ করা হয়েছে। বাকি ২টি শর্তও পূরণ হওয়ার পথে। কিন্তু জিএসপি নিয়ে নতুন সমস্যা তৈরি হয়েছে। এ্যাকশন প্লান বাস্তবায়নের চেয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে ইউএসটিআরের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি। ফলে সব শর্তপূরণ হওয়ার পরও জিএসপি ফিরে পাওয়া যাবে কী না সেটাও এখন দেখার বিষয়। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া বাংলাদেশ এ্যাকশন প্লানের ১৬টি শর্ত পূরণের অগ্রগতি পুনর্মূল্যায়ন করা হচ্ছে। শর্তগুলোর অধিকাংশ পূরণ হওয়ায় সরকার আশা করছে, জিএসপি ফিরে পাবে বাংলাদেশ। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র না হলে জিএসপি সুবিধা ফিরে পাবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এ্যাকশন প্লানের ১৬টি শর্ত পূরণ হওয়ার পথে। তিনি বলেন, গার্মেন্টস শিল্পে বাংলাদেশ এক নম্বর হওয়ার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাই এ শিল্পের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করতে দেশী-বিদেশী এমনকি প্রতিযোগী দেশগুলোর চক্রান্তকারীরাও কারসাজি করছে। এদিকে, চলতি ডিসেম্বর মাসে জিএসপি রিভিউ শুনানিতে এই অবস্থানপত্রের ওপর ইউএসটিআর চূড়ান্ত মতামত প্রদান করবে। শর্তপূরণে বাংলাদেশের যে অগ্রগতি তাতে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রফতানিতে জিএসপি পুনর্বহাল হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
×