ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জোবায়ের আলী জুয়েল

বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকী

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১০ ডিসেম্বর ২০১৪

বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকী

স্বদেশী যুগের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ এক যুবকের নাম ছিল প্রফুল্ল চাকী। ১৮৮৮ সালের ১০ ডিসেম্বর বগুড়া জেলার শিবগঞ্জের বিহার গ্রামে এক মধ্যবিত্ত হিন্দু কায়স্থ পরিবারে প্রফুল্ল চাকীর জন্ম। পিতা রাজনারায়ণ ও মাতা স্বর্ণময়ী দেবী। পিতা ছিলেন বগুড়ার নওয়াব পরিবারের একজন কর্মচারী। প্রফুল্ল চাকী মাত্র দু’বছর বয়সে পিতাকে হারান। চার ভাই-দু’বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। মাতা কর্তৃক লালিত-পালিত প্রফুল্ল চাকী তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা গ্রামের স্কুলেই শুরু করেন। রংপুরের গুপ্তপাড়ায় দুর্গাদাস নাগের বাসায় থেকে রংপুর জিলা স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে পড়াশোনা করতেন। ১৫ বছর বয়সে ১৯০৩ সালে ‘বান্ধব সমিতিতে’ যোগ দিয়ে বিপ্লবী গোপন সংগঠনের কার্যক্রমে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ছাত্রদের রাজনীতি করা সে সময় নিষিদ্ধ ছিল। তা সত্ত্বেও প্রফুল্ল চাকী ছাত্ররাজনীতি করে গেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের উদ্বুদ্ধ করেন। জিলা স্কুল কর্তৃপক্ষ সে কারণে তাঁর পাঁচ টাকা জরিমানা করেন। এতে সে সময় ছাত্র- সমাজ বিক্ষুব্ধ হয়। জরিমানার টাকা না দিয়ে ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনি দিতে দিতে প্রফুল্ল চাকী জিলা স্কুল পরিত্যাগ করে নবপ্রতিষ্ঠিত জাতীয় বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ঠিক এমনই এক সন্ধিক্ষণে ‘যুগান্তর’ গ্রুপের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বিপ্লবী বারীন্দ্র কুমার ঘোষ রংপুর ভ্রমণে আসেন। বারীন্দ্র কুমার ঘোষের সঙ্গে প্রফুল্ল চাকীর পরিচয় হয়। চাকী বারীন্দ্র ঘোষের মনে গভীর দাগ ফেলতে সক্ষম হন। এরপর ১৯০৭ সালে বারীন্দ্র কুমার ঘোষ যখন কলকাতায় গোপন বোমা কারখানা গড়ে তোলেন তখন তিনি প্রফুল্ল চাকীকে কলকাতায় নিয়ে যান। ‘বন্দে মাতরম’ পত্রিকার সম্পাদক অরবিন্দ ঘোষের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের মামলা চলছিল কিংস ফোর্ডের এজলাসে। অরবিন্দের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য অন্যতম সম্পাদক ও প্রখ্যাত দেশনেতা, বিপিন চন্দ্র পালকে নানাভাবে চাপ দেয়া হয়। বিপিন চন্দ্র পালের উক্তি ‘ইংরেজ আদালতে দাঁড়িয়ে এই মামলার সাক্ষ্য দিতে আমার বিবেকে বাঁধে। তাই আমি শপথও নেব না, সাক্ষ্যও দেব না।’ আদালত অবমাননার দায়ে বিপিন চন্দ্রকে ছয় মাসের কারাদ-ে দ-িত করলেন ক্রুদ্ধ কিংস ফোর্ড। এজলাসেই উঠল জনতার কণ্ঠে বিপিন চন্দের নামে সমবেত জয়ধ্বনি। পুলিশ বাহিনী অকথ্য নির্যাতন শুরু করলেন জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে। পুলিশের অমানসিক আচরণ দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল পনেরো বছরের এক সাহসী কিশোর সুশীল সেন। পরের দিন তাঁকে হাজির করা হলো কিংস ফোর্ডের আদালতে। নিষ্ঠুরমনা কিংস ফোর্ড আদেশ দিলেন ‘ওর যত বছর বয়স, তত ঘা : বেত লাগাও ওর পিঠে। গুনে গুনে পনেরো ঘা’ কঠিন, বেত পড়ল পনেরো বছরের বালক সুশীল সেনের ওপর। যন্ত্রণায় সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। কিংস ফোর্ডের হিংস্র পশুর মতো আচরণ দেখে শিউরে উঠল সবাই। বিপ্লবীদের এক গোপন সভায় শ্রী অরবিন্দ (আইসিএস) রাজা সুবোধ চন্দ্র মল্লিক ও আইসিএস চারু চন্দ্র দত্ত এই তিনজন কিংস ফোর্ডের মৃত্যুদ- ঘোষণা করলেন। স্বেচ্ছাচারী কিংস ফোর্ডের আর বেঁচে থাকবার অধিকার নেই। কিংস ফোর্ডকে হত্যা করার প্রথম চেষ্টা করা হয়, তাঁর নামে একটি ‘বই বোমা’ পাঠিয়ে। একখানা বড় বইয়ের মাঝখানে জায়গা করে বোমাটা এমনভাবে রাখা হয়েছিল, যাতে বইটা খুললেই বোমাটা ফেটে যাবে। বইখানা একটি ফিতে দিয়ে বাঁধা ছিল। বইটা খুললেই সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণ। কিংস ফোর্ড থাকতেন কলকাতার টালিগঞ্জের এক বাড়িতে। সেই বাড়িতে একদিন সন্ধ্যাবেলা বইটা তার হাতে দিয়ে আসা হলো। কিন্তু কী আশ্চর্য বইখানা না খুলেই তিনি সেটা তাঁর আলমারিতে তুলে রেখে দিলেন। এটি অদৃষ্টের নির্মম এক পরিহাস। বেয়ারার পোশাকে যিনি এই বইটি দিতে যান তিনি ছিলেন বিপ্লবী দলের এক সদস্য পরেশ মৌলিক। এবারের কিংস ফোর্ডকে হত্যার দায়িত্ব প্রথমে দেয়া হয়েছিল ঐ বেতের মার খাওয়ার বালক সুশীল সেনকে। পরে তার পরিবর্তে ঐ মহাভার অর্পণ করা হয় উনিশ বছর বয়সী প্রফুল্ল চাকীর ওপর। প্রফুল্ল চাকী অগ্নিযুগের বিপ্লবী বীর বারীন্দ্র কুমার ঘোষের সংস্পর্শে আসেন এবং পরবর্তীতে অরবিন্দ ঘোষের ‘যুগান্তর’ দলে যোগ দেন। বাংলার তখনকার ছোট লাট ব্যামফিল্ড ফুলার ছিলেন হিংস্রতার প্রতিমূর্তি। অত্যাচারী ফুলারকে হত্যার পরিকল্পনা করেন বারীন্দ্র। এ ব্যাপারে তাঁর সহযোগী ছিলেন হেমচন্দ্র কানুনগো ও বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকী। ধুবড়ি থেকে রংপুরে আসার পথে রেললাইনের ব্যাটারি লাগানো বোমা পেতে ছোট লাটের ট্রেন উড়িয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। যদি বোমা না ফাটে তাহলে লণ্ঠন দেখিয়ে গাড়ি থামিয়ে ফুলারকে গুলি করে মারার কথা। ফুলার অসমের ধুবড়ি গিয়েছিলেন রংপুরের ওপর দিয়ে ঠিকই ট্রেনে। ফেরার পথে ভূতছাড়া আজকের মীরবাগ স্টেশনে তাকে বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়ার সব পরিকল্পনা পাকা। এরপর প্রফুল্ল চাকী নিযুক্ত হলেন বাংলার অন্যতম ছোট লাট ফ্রেজার হত্যা প্রচেষ্টার সঙ্গে। এক সময় এই ফ্রেজারই ছিলেন লর্ড কার্জনের মরামর্শদাতা এবং বঙ্গভঙ্গের দুর্বুদ্ধি এই ফ্রেজারের মাথা থেকেই বেরিয়ে ছিল। পরে ফ্রেজার আবার মেদিনীপুর জেলাকে দ্বিধাবিভক্ত করার পরিকল্পনা করেন যদিও শেষ পর্যন্ত সে প্রস্তাব কার্যকর হয়নি। তবু বিপ্লবীদের কাছে ফ্রেজার দেশের পরম শত্রুরূপে গণ্য হয়েছিলেন। মৃত্যুই এর একমাত্র শাস্তি। নারায়ণগড়ে রেললাইনে ডিনামাইট বসিয়ে দু’দুবার ফ্রেজারের ট্রেন উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়। কিন্তু প্রতিবারই ভাগ্যগুণে বেঁচে যান ফ্রেজার। এসব দুঃসাহসী অভিযানের অন্যতম নায়ক চাকীর ওপর কিংস ফোর্ড হত্যার ভার পড়ল। যেমন দৃঢ়চেতা তেমনই নির্ভীক উনিশ বছরের এই উজ্জ্বল তরুণটি। ১৯০৬ থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত যে কয়টি গুপ্তহত্যা হয়েছে তার প্রতিটির নায়ক ছিলেন এই প্রফুল্ল চাকী। এমন গুরুদায়িত্ব পালন করার জন্য যোগ্য ব্যক্তি এই প্রিয় শিষ্যটিকে নির্বাচন করেন বিপ্লবী বারীন্দ্র কুমার। পরবর্তীতে সর্বসম্মতিতে নির্বাচন করা হলো দীনেশ রায় এবং দুর্গাসেনকে। অর্থাৎ প্রফুল্ল চাকী এবং ক্ষুদিরাম বসুকে। দু’জনেরই ছদ্মনাম। তারা দু’জনে বোমা ও রিভলবার সঙ্গে নিয়ে অতি সাবধানে মজাফ্ফরপুরে রওনা হলেন। যে বোমাটি ক্ষুদিরামকে দেয়া হলো সেটি ১৫নং গোপীমোহন দত্ত লেনে তৈরি হয়েছিল। বোমাতে কাঠের হাতল ছিল। বারীন্দ্র ঘোষ প্রফুল্লের ব্যাগেও ঢুকিয়ে দিলেন আরেকটি বোমা। মজাফ্ফরপুর এসে দুই তরুণ আশ্রয় নিলেন একটি ধর্মশালা মন্দিরে। তারপর মজাফফ্রপুর এজলাসে গিয়ে কিংস ফোর্ডের গতিবিধির ওপর তারা সজাগ দৃষ্টি রাখলেন। কিংস ফোর্ড কখন অফিস পৌঁছেন, কখন অফিস থেকে বাসায় ফেরেন, কখন ক্লাবে যান ইত্যাদি। তারা উভয়েই বুঝতে পারেন রাত ৮টায় ইউরোপিয়ান ক্লাব থেকে গাড়িতে চড়ে কিংস ফোর্ড সাধারণত বাড়ি ফেরেন। ঐ সময়টাকে তারা বোমা মারার উপযুক্ত সময় বলে বিবেচনা করলেন। ১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল সেখানকার ইউরোপিয়ান ক্লাব থেকে বহির্গত ফিনট গাড়িতে কিংস ফোর্ড আছেন ভেবে তারা উভয়েই বোমা ছুড়ে মারেন। ওই গাড়িতে কিংস ফোর্ড ছিলেন না। দুর্ভাগ্য পিছনে পিছনে ফিরছিল প্রফুল্ল চাকী। এ গাড়িতে যাচ্ছিলেন পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর নন্দলাল চট্টোপাধ্যায়। প্রফুল্ল ভাবলেন বাঙালী-স্বদেশীও হবেন বুঝি বা। ভাব জমে উঠল কথায় কথায় সকাল বেলা জাহাজে গঙ্গা পার হতে হবে। কুলি না পেয়ে নন্দলাল দারোগা অস্বস্তিবোধ করছেন দেখে প্রফুল্ল তার মালপত্র মাথায় করে বয়ে নিয়ে গেলেন। অপর পাড়ে পৌঁছে গেলেন। বাঙালী হয়ে বাঙালীকে ধরিয়ে দিলেন? তাহলে দেখুন বাঙালী কত সহজে মরতে পারে। প্রফুল্ল চাকী চকিতে রিভলবার বের করে নন্দলালকে তাক করে গুলি ছুড়লেন। সিংহভূমের কুখ্যাত এই সাব-ইন্সপেক্টরের আরও কয়েকদিনের পরমায়ু ছিল। বেঁচে গেলেন তিনি। তখন নিজের দিকে তাক করে ধরা পড়ার পূর্বমুহূর্তে মাথায় পর পর দু’বার রিভলবারের গুলি ছুড়ে আত্মহননের পথ বেছে নিলেন প্রফুল্ল চাকী। লুটিয়ে পড়ল তার দেহ মোকামঘাট স্টেশন প্লাটফর্মে। দিনটি ছিল ১৯০৮ সালের ১ মে। আত্মীয়স্বজনদের শনাক্ত করার জন্য পুলিশ এক কোপে কেটে ফেলল প্রফুল্ল চাকীর গলা। তারপর মু-ুটা স্পিরিটে ডুবিয়ে পাঠিয়ে দিল বঙ্গদেশে। প্রফুল্লর মা স্বর্ণময়ী দেবী দেখে জানালেন এটা তার ছেলের মু-ু। বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকীর আত্মত্যাগ তাই বিফলে যায়নি। লেখক : গবেষক।
×