ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

যাচাই বাছাই না করেই ফোরজির তরঙ্গ বরাদ্দের প্রক্রিয়া শুরু

প্রকাশিত: ০৫:০৬, ৯ ডিসেম্বর ২০১৪

যাচাই বাছাই না করেই ফোরজির তরঙ্গ বরাদ্দের প্রক্রিয়া শুরু

ফিরোজ মান্না ॥ দেশের বাজার যাচাই না করেই এবার ফোরজি (চতুর্থ জেনারেশন) ফোনের তরঙ্গ বরাদ্দ দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ফোরজির জন্য রাখা ৭০০ মেগাহার্টজ তরঙ্গ কিভাবে হাতিয়ে নেয়া যায় সে কাজটিই করছে একটি চক্র। এই তরঙ্গের দাম কি হবে তা বিটিআরসি নির্ধারণ না করলেও লাইসেন্স দেয়ার কাজ শুরু করে দিয়েছে। এমনকি ফোরজির গাইড লাইনও তৈরি করা হয়নি এখনও। এমন পরিস্থিতিতে বিটিআরসি ফোরজি নিয়ে কাজ শুরু করায় টেলিকম বিশেষজ্ঞরা অনেকটা অবাক হয়েছেন। তাদের কথা থ্রিজির বাজারই এখন পর্যন্ত দেশে তৈরি হয়নি। এ অবস্থায় ফোরজি লাইসেন্স নিয়ে বিটিআরসি কিভাবে কাজ করছে। সূত্র জানিয়েছে, বিশ্বব্যাপী ফোরজির তরঙ্গের দাম থ্রিজির (তৃতীয় প্রজন্মের ফোন) চেয়ে অনেক বেশি। দেশে থ্রিজি তরঙ্গ বিক্রি করা হয়েছে অনেক কম দামে। এখন ফোরজি তরঙ্গ নিয়ে চলছে নানা কথা। এই তরঙ্গ কত দামে বিক্রি করা হচ্ছে মন্ত্রণালয় ও বিটিআরসি কোন তথ্যই দিতে পারেনি। থ্রিজি লাইসেন্স নেয়ার এক বছরের মাথায় দেশের সব অঞ্চলে নেটওয়ার্ক স্থাপনের কথা থাকলেও চারটি অপারেটরের কেউই এখন পর্যন্ত সারাদেশে থ্রিজির নেটওয়ার্ক স্থাপন করতে পারেনি। অথচ ফোরজি লাইসেন্স দেয়ার বিষয়টি কেন আলোচনায় তুলে নিয়ে আসছে। কারা এর পেছনে কাজ করছে তাও রহস্যজনক। তবে বিটিআরসি বলছে, দেশে থ্রিজি চালুর পরই ফোরজি লাইসেন্স দেয়ার কাজ শুরু করা হবে। আগের ঘোষণা অনুযায়ীই কাজ করা হচ্ছে। এখানে কোন প্রভাবশালী চক্রের হাত নেই। এদিকে একটি প্রভাশালী চক্র ফোরজি লাইসেন্স ইস্যু করার জন্য বিটিআরসিকে উৎসাহিত করছে। বিটিআরসির কিছু কর্মকর্তাও এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। ফোরজি লাইসেন্স এই সময় ইস্যু করা হলে সরকারের বিপুল অঙ্কের টাকার ক্ষতি যাবে। কারণ থ্রিজি লাইসেন্স ইস্যু করার সময়ই অনেক কম দামে তরঙ্গ বিক্রি করা হয়েছে। ফোরজি বিশ্বের সবচেয়ে দামী তরঙ্গ। এই তরঙ্গ ব্যবহারের ক্ষেত্র তৈরি না করেই তড়িঘড়ি নিলামে তোলার চেষ্টা চলছে। দেশী প্রভাবশালীদের নেপথ্যে রয়েছে বিদেশী কয়েকটি প্রভাবশালী টেলিফোন অপারেটর। এসব অপারেটর এই মুহূর্তে ৭০০ মেগাহার্টজের তরঙ্গ নিতে পারলে কয়েক বছর পর কয়েকশ’ গুণ দাম বেড়ে যাবে। তখন তারা নিজেদের মতো করে তরঙ্গ বিক্রি করতে পারবে। শক্তিশালী সিন্ডিকেট ফোরজি তরঙ্গ নিলামের অবৈধ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত টেলিকম সেক্টরের কিছু ব্যবসায়ী, মন্ত্রণালয় ও বিটিআরসির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী। তরঙ্গ বরাদ্দ নেয়ার জন্য একটি বড় অঙ্কের টাকার বাজেটও তৈরি করেছে তারা। সূত্র মতে, থ্রিজির নিলামে বড় ধরনের কমিশন বাণিজ্য হয়েছে। চার মোবাইলফোন অপারেটরের কাছে বিক্রি করা হয়েছে মাত্র পাঁচ হাজার কোটি টাকায়। এখানে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা সরকারের ক্ষতি হয়েছে। দেশে তরঙ্গ সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির অভাব থাকায় বিটিআরসি যে দর ঠিক করছে সেই দরেই তরঙ্গ বিক্রি করা হচ্ছে। বিটিআরসিতে কয়েক অভিজ্ঞ কর্মকর্তা থাকলেও মন্ত্রণালয়ে কোন বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা নেই। যে কারণে তরঙ্গ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। মূলত সে কারণেই দেশে থ্রিজির বাজার তৈরির আগেই ওই তরঙ্গ বিক্রি করা হয়েছিল নামমাত্র মূল্যে। যদি বাজার তৈরি করে কয়েক বছর অপেক্ষা করে থ্রিজি তরঙ্গ বিক্রি করা যেত, তাহলে আরও এক হাজার কোটি টাকার বেশি আয় হতো সরকারের। ফোরজি লাইসেন্স বিষয়ে বিটিআরসির চেয়ারম্যান সুনীল কান্তি বোসের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। তবে বিটিআরসির এক কর্মকর্তা বলেন, দেশে এখনই ফোরজি নেটওয়ার্ক তৈরি করার অবস্থা নেই। তাছাড়া বাজারও নেই। কারণ থ্রিজির বাজারই তৈরি করতে পারেনি অপারেটররা। এখন আবার ফোরজি লাইসেন্স দেয়ার চেষ্টা চলছে। এটা কোন অবস্থাতেই ঠিক হবে না। এতে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফোরজি তরঙ্গ বিশ্বের সবচেয়ে দামী তরঙ্গ। এই তরঙ্গ এখনই বরাদ্দ দিলে ভবিষ্যতে আর কোন তরঙ্গ বিটিআরসির হাতে থাকবে না। এমনিতেই বিটিআরসির বেশিরভাগ ক্ষমতা এখন ডাক ও টেলিযোগাযোগের হাতে চলে গেছে। ফোরজি লাইসেন্স বিষয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, মন্ত্রণালয় এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত কিনা তা বলা যাচ্ছে না। টেলিকম বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ফোরজির তরঙ্গ নিলামে ওঠানোর আগে আইটিইউর (ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন) সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত। এছাড়া মূল্য নিয়েও আলোচনা করা উচিত। এমন মূল্য ঠিক করতে হবে যাতে প্রতি মেগাহার্টজ তরঙ্গের মূল্য কোনক্রমেই যেন থ্রিজির চেয়ে কম না হয়। বরং থ্রিজির চেয়ে অনেক বেশি হতে হবে। টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, বিটিআরসি যা ইচ্ছা তা করছে। ফোরজির বাজার নিয়ে আলোচনা করতে গেলে অনেক বিষয় বিবেচনায় আনতে হবে। পূর্ববর্তী বিডব্লিউএ (ব্রডব্যান্ড ওয়্যারলেস এ্যাকসেস) ও থ্রিজি নিলামের আগে নিলাম গাইডলাইনের খসড়া করা হয়। এই গাইডলাইন করতে গিয়ে মার্কেটের বর্তমান অবস্থা, প্রবৃদ্ধি প্রবণতা, মূল্য, নিলাম পরবর্তী প্রভাব এবং গ্রাহক নিয়ে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। কিন্তু ৭০০ মেগাহার্টজের তরঙ্গ নিলামের আগে কোন গবেষণাই করা হচ্ছে না। অথচ ফোরজি তরঙ্গ নিলামের প্রক্রিয়া প্রায় শেষের পথে। এখন সরকারের শীর্ষ মহলের অনুমতি পেলেই তরঙ্গ বরাদ্দ দেয়ার কাজ শুরু করবে বিটিআরসি। থ্রিজি তরঙ্গ ৮০০, ৯০০ ও ১৮০০ মেগাহার্টজ ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু ৭০০ মেগাহার্টজ তরঙ্গ ফোরজির জন্য রেখে দেয়া হয়েছিল। এই তরঙ্গ বরাদ্দ দেয়া হলে বড় অঙ্কের বাণিজ্য হবে বলে টেলিকম বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। তারা বলছেন, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দামের তরঙ্গ হচ্ছে ফোরজি। তাই এটা বিক্রি করতেও উচ্চমানের কমিশন আদান-প্রদান হবে। বিটিআরসি সূত্র জানিয়েছে, দেশের বেশিরভাগ মানুষ গরিব এবং সাধারণ জীবনযাপন করে। তাদের এখনও থ্রিজি ব্যবহার করার জন্য দামী হ্যান্ডসেট কেনার ক্ষমতা হয়নি। এ কারণে থ্রিজি গ্রাহকের সংখ্যাই বাড়ছে খুবই ধীরগতিতে। অপারেটরদের উচিত এখনও টুজি তরঙ্গ রেখে দেয়া। অপারেটররা যদি তাদের টুজি তরঙ্গের পরিমাণ কমিয়ে ফেলে তাহলে ভয়েস কোয়ালিটি চরমভাবে খারাপ হবে। বিষয়টি অপারেটরদের জন্য লাভজনক। কিন্তু গ্রাহকদের জন্য চরম ভোগান্তির কারণ হবে। থ্রিজি গাইডলাইন অনুসারে সব বিডার সর্বোচ্চ তিনটি ব্লক ক্রয়ের কথা ছিল। কিন্তু গ্রামীণফোন দুটি ব্লক নিয়েছে, বাকি সব অপারেটর একটি করে ব্লক কিনেছে। অথচ এখন তারা নিলামের এক বছরের মাথায় নতুন পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে। তারা এখন ফোরজি তরঙ্গ বরাদ্দ নেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। দেশে বাজার আছে কি না আছে তা দেখার কোন প্রয়োজন নেই তাদের। ফোরজির তরঙ্গ হাতে নিতে পারলেই অপারেটরদের লাভ। কারণ ভবিষ্যতে এই তরঙ্গের দাম আকাশচুম্বী হবে। সেই সময় তারা ইচ্ছেমতো ব্যবসা করতে পারবেন। টেলিকম বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশে এখনও ফোরজি টেলিফোন চালু করার বাজার তৈরি হয়নি। উন্নত দেশগুলোতে ফোরজি ফোন চালু হলে সেখানেও গ্রাহকরা ব্যয় বহন করতে পারছেন না। অনেকে ফোরজি ছেড়ে দিয়ে থ্রিজি ও টুজিতে ফিরে এসেছে। এখনই দেশে ফোরজি চালু করা হলে অল্প কিছু মানুষ এই সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। বাকি গ্রাহকরা এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন। তবে লাভবান হবেন অপারেটররা। তারা পরে এই তরঙ্গ ব্যবহার করে মনোপলি ব্যবসা করে যাবে। তখন আর কারও কিছু বলার থাকবে না।
×