ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

নাদিরা মজুমদার

ভরে যাক পৃথিবী ঝকঝকে আলোয় !!!

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ৬ ডিসেম্বর ২০১৪

ভরে যাক পৃথিবী ঝকঝকে  আলোয় !!!

সামু আকাসাকি, হিরোশি আমানো এবং শুজি নাকামুরা- তিন জাপানী, তাঁদের মধ্যে প্রধান মিল হলো যে তাঁরা তিন জনই নীল আলো-নিক্ষেপে সক্ষম ‘ডায়োড’, ইংরেজীতে ‘লাইট-এমিটিং ডায়োড‘ (সংক্ষেপে : লেড বা এলইডি) আবিষ্কার করে তাবত পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দেন। তাঁরা যদি তাই পদার্থবিদ্যার জন্য ২০১৪ সালের নোবেল পুরস্কারটি পান, সেটাই হবে সঠিক সিদ্ধান্ত! ২০১৪ সালের পদার্থবিদ্যার পুরস্কারটি তাঁদের সম্মিলিতভাবে দেয়া হয়েছে। কেবল পুরস্কারের অর্থই (৮ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রাউন) তিন জনের মধ্যে ভাগাভাগি হবে, তবে যার যার নাম লেখা সোনার মেডেল ও অনন্যসুন্দর ডিজাইনকৃত ডিপ্লোমা তিন জনেই পাবেন। এই তিন বিজ্ঞানীর মধ্যে আকাসাকি ও আমানো জাপানের নাগোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এবং নাকামুরার জন্ম, লেখাপড়া ইত্যাদি জাপানে, তবে বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক এবং ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্টা বারবোরার প্রফেসর। নীল আলো বিচ্ছুরণে সক্ষম লেড আবিষ্কার করে এত হৈচৈ সৃষ্টির কারণ কি, দেখা যাক! সুবিধা-অসুবিধার যোগবিয়োগ করে বলতেই হয় যে উপকারিতার বিচারে ‘নীল লেড’ আলোর জগতে বিপ্লব ঘটিয়েছে। কারণ, সত্যিকারের নির্মল সাদা আলো তৈরিতে তিনটি রঙের-লাল, সবুজ ও নীলের সংমিশ্রণ হতে হবে, সংমিশ্রণ ছাড়া হতে পারে না। অন্যভাবে, সাদা আলো পেতে হলে, এই তিনটি রঙের সুষম সংমিশ্রণ হতেই হবে। গত অর্ধ শতাব্দী ধরে লাল ও সবুজ রঙের স্মার্ট ‘ডায়োড’ আমাদের ছিলই, (গত দুই দশক ধরে ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল’ টাইপের নীল-ডায়োডও ছিল), ছিল না নিখুঁত যুৎসই নীল আলো-নিক্ষেপে সক্ষম স্মার্ট নীল ডায়োড। অবশেষে নীল লেড তৈরিও সম্ভব হওয়াতে, ঝলমলে ঝকঝকে সাদা আলো সৃষ্টি সম্ভব হচ্ছে। এই তিন বিজ্ঞানী ডিসেম্বর মাসের দশ তারিখে যখন পুরস্কার গ্রহণ করবেন, তখন উৎসব হলটি তাঁদেরই আবিষ্কারের ঝকঝকে সাদা আলোয় ভরে থাকবে। স্টকহোমের বাড়িগুলোর জানালা থেকে লেডের আলো উঁকিঝুঁকিও দেবে! আকাসাকি, আমানো ও নাকামুরা হবেন পৃথিবীর প্রথম বিজ্ঞানী, যাঁরা তাঁদের আবিষ্কারের তাৎক্ষণিক আস্বাদ পাবেন। অনুমান করা যায় যে তাঁরাও ভারি রোমাঞ্চিত হবেন! আকাসাকি, আমানো ও নাকামুরা যে মুহূর্তে ‘সেমিকন্ডাক্টর’ থেকে নিঃসৃত উজ্জ্বল নীল আলোর রশ্মি পেলেন, সেই মুহূর্ত থেকে দীপন-প্রযুক্তির (ইলিউমিনেইশন টেকনোলজি) জগতে মৌলিক রূপান্তরের দরজাগুলো গেল খুলে। বিংশ শতাব্দিতে আমরা আলো জ্বালিয়েছি ‘ফিলামেন্ট’য়ের বাল্ব দিয়ে, একবিংশ শতাব্দীর আলো জ্বলবে ‘লেড’ বাতির। সাদা লেড বাতি যে উজ্জ্বল সাদা আলো নিঃসরণ করে, তা যেমন দীর্ঘস্থায়ী, আবার বিদ্যুতশক্তিরও প্রচুর সাশ্রয় হয়। ফিলামেন্ট দিয়ে তৈরি যে বাল্ব আমরা ব্যবহার করি, তার ক্ষমতা বা পাওয়ার যেমন ‘ওয়াট’ একক দিয়ে প্রকাশ করা হয়, লেডের দৃশ্যমান আলোকোজ্জ্বল সাদা আলোর প্রবহনকে (লিউমিনাস ফ্লাক্স) ‘লিউমেন’ (সংক্ষেপে:এলএম) একক দিয়ে প্রকাশ করা হয়। বিশ্বের মোট বিদ্যুতশক্তির প্রায় এক-চতুর্থাংশ ব্যয় হয়ে থাকে আলো জ্বালানোর কাজে। লেড আলো কম বিদ্যুতে জ্বলতে পারে বলে শক্তি-সঞ্চয় হবে। বা এমনকি গ্রাম-গঞ্জের আনাচে কানাচে, যেখানে বিদ্যুত-গ্রিড নেই, সেখানে সস্তায় স্থানীয় সৌর-শক্তি ব্যবহার হতে পারে। ফলে, বিশ্বের আরও দেড় বিলিয়ন মানুষ রাতের আঁধারে, কুপি বা হ্যারিকেনের বদলে, বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালাতে পারবে। আয়ুর দিক দিয়েও এই আলোক-উৎস দীর্ঘস্থায়ী, যেমন : তুলনা করে বলা হচ্ছে যে লেড বাতি যখন এক লাখ ঘণ্টা টিকে থাকতে পারছে, একই পরিস্থিতিতে আমাদের পরিচিত ফিলামেন্টের বাল্ব টিকে থাকে, বড়জোর এক হাজার ঘণ্টা এবং ফ্লোরেসেন্ট আলো দশ হাজার ঘণ্টা। তাছাড়াও, পরিবেশ-বন্ধুসুলভ সে। ফিলামেন্ট লাগে না বলে প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ হচ্ছে, ফ্লোরেসেন্টের বাতির মতো পারদ ব্যবহার নেই বলে বিষাক্ত গ্যাসের নিঃসরণমুক্তও বটে। নোবেল পুরস্কার পাওয়া এই সাদা লেড আলো তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন তীব্রতা সম্পন্ন (ইনটেনসিটি) রংকে সংযোজন বা সংমিশ্রণ করে। স্কুলের বিজ্ঞান ক্লাসে আমরা পড়ি যে সাদা আসলে কোনো রংই নয়, বরং দৃশ্যমান আলোর সব ক’টি কম্পনের উপস্থিতি মাত্র। অন্যভাবে, দৃশ্যমান সাতটি আলোর পুরো বর্ণালিটিই হলো সাদা আলো এবং মনে রাখার সহজ কায়দা হিসেবে বলি ‘ভিবজিওর’(ঠওইএণঙজ)। কিন্তু সাতটি নয়, বর্ণালির মাত্র তিনটে স্বতন্ত্র কম্পন বিশিষ্ট আলোককে (বর্ণালিতে প্রত্যেকের কম্পন পরস্পরের কাছ থেকে দূরে হতে হবে) সংমিশ্রণ করেও সাদা আলো তৈরি সম্ভব। অর্থাৎ, যে কোন তিনটে রংকে (বা কম্পনকে) সঠিক তীব্রতায় মিশিয়ে সাদা আলো পাওয়া যাবে এবং এই তিনটে রংকে বলা হয় আলোর আদি রং। এই আদি রঙের একাধিক সেট রয়েছে। তবে বহুল পরিচিত সেট হলো লাল-সবুজ-নীল। এই তিন রং যখন সঠিক তীব্রতায় সংমিশ্রিত হয়, তখনই আমরা সাদা আলো পাই। সহজে মনে রাখার জন্য খুব সাদামাটা সমীকরণ হতে পারে, এ রকম : লাল+সবুজ+নীল=সাদা। আমরা যদি আদি রঙের, দুটোর বা তিনটিরই, তীব্রতাকে নানাভাবে অদলবদল করে মেশাই তো কি হবে? তার মানে, হরেক রঙের আলোর রং তৈরি হবে। এই কারণেই টেলিভিশন সেটের ও কম্পিউটার মনিটরের জন্য লাল, সবুজ ও নীল রঙের আলো-নিঃসরণক্ষম ফসফর ব্যবহার হয় (অবশ্য ইদানীং লেড টিভি, মনিটর তৈরি হচ্ছে)। সঠিক তীব্রতা সম্পন্ন লাল, সবুজ আর নীল রঙের আলো মেশানোর আগে দুটো করে দুই রঙের আলো নিয়ে রং মেশানোর খেলা করলে কেমন হয়? যেমন : লাল আর সবুজ আলোকে যদি মেশানো হয়, আমরা পাব হলুদ রং, লাল আর নীল আলো সংমিশ্রণ করলে হবে ম্যাজেন্টা রং, এবং সবুজ ও নীল আলো সংমিশ্রিত হলে তৈরি হবে সবুজাভ নীল বা ফিরোজা রঙের আলো। দুটো করে আলো মিশিয়ে যে তিনটে নতুন রঙের আলো পাওয়া গেল- হলুদ, ম্যাজেন্টা ও ফিরোজা, এদেরকে গৌণ বা সেকেন্ডারি রঙের আলো বলা যেতে পারে। কারণ, সম তীব্রতার দুটো আদি রঙের আলো মিশিয়ে তাদের সৃষ্টি হচ্ছে। [জঞঋ নড়ড়শসধৎশ ংঃধৎঃ: }ঢ়৩[জঞঋ নড়ড়শসধৎশ বহফ: }ঢ়৩ যে কোন দুই রঙের আলোকে সম তীব্রতায় সংমিশ্রণ করে যদি সাদা আলো পাওয়া যায়, তখন দুই আলোককে পরস্পরের পূরক রং বলা হয়। অতএব, আমরা বলতে পারি যে আদি লাল আলোকের পূরক আলো হলো ফিরোজা রঙের আলো। কারণ, সবুজ ও নীল রঙের আলো সংমিশ্রিত হয়ে তৈরি হচ্ছে ফিরোজা রঙের আলো, আবার লালের সঙ্গে সবুজ ও নীল মেশালে হচ্ছে সাদা আলো। অর্থাৎ, সংক্ষেপে বলতে পারি যে প্রতিটি আদি রঙের আলোর পূরক হিসেবে একটি গৌণ রঙের আলো থাকে। এই তিনটে আদি রঙের আলোকে সংমিশ্রণ করে আমরা যে হরেক রঙের আলো তৈরি করি, তাকে বলা হয় রঙের সংমিশ্রণ বা কালার এডিশন। ভাগ্য ভাল যে আলোর এই এডিটিভ গুণাবলী রয়েছে। লেড-লাইটিংয়ে রঙের সংমিশ্রণ বা কালার এডিশনই ব্যবহার হচ্ছে। সনাতন আলোক-ব্যবস্থা মাত্র এক ধরনের সাদা আলো তৈরি করছে, কিন্তু লেডের সাদা আলো তিন রঙের আলো-ভিত্তিক। ফলে, লেড যে দীপন-প্রযুক্তির সূচনা করল, ফলশ্রুতিতে, আমরা লাল-সবুজ-নীল বিন্যাসের প্রতিটি লেডের তীব্রতার রকমফের ঘটিয়ে নির্দিষ্ট গুণগত তাপমাত্রার সাদা আলো তৈরি করতে পারব। অর্থাৎ, লেড-আলো, সাদা আলোই বটে, কিন্তু রংভিত্তিক বলে রং নিয়ে ‘খেলা’র সীমাহীন সুযোগ রয়েছে। যেমন : আমরা দিনের আলো যে তরঙ্গ- দৈর্ঘ্যে ভাল দেখতে পাই, সেটি বর্ণালির সবুজ অংশে বিদ্যমান। আবার গোধূলি বেলায়, যে আলোকে ভাল দেখি আমরা সেটি বর্ণালির নীল অংশে। ফলে, আমাদের প্রয়োজনের সঙ্গে, আলোক বিষয়ে আমাদের ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য উপলব্ধির সঙ্গে, সুন্দর খাপ খাইয়ে নেয়ার বা সঙ্গতিপূর্ণ সাদা আলোক সৃষ্টির প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন লেডের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে। যেমন : দক্ষ-লেড (অ্যাডাপটিভ-লেড) গাড়ি, এ্যারোপ্লেন ইত্যাদির যন্ত্রপাতির প্যানেল আলোকিতকরণের সময় পরিবেশগত পারিপার্শি¦কতার বদলে, আসল গুরুত্ব দেবে রঙের নির্ভরযোগ্যতা ও সঙ্গতিপূর্ণতার প্রতি, আবার অফিস-আদালতের আলোকিতকরণে রঙের খেলা হবে ভিন্নতর। একইভাবে, লাল-সবুজ-নীল, এই তিন আলোর তীব্রতার রকমফের ঘটিয়ে ভিন্ন তাপমাত্রার সাদা আলো একদিন আমাদের বাসাবাড়িকে আলোকিতকরণও স্ট্যান্ডার্ডে পরিণত হবে। হধফরৎধযসধলঁসফধৎ@মসরষ.পড়স
×