ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ডেভিড বার্গম্যান তারেক খালেদা কেউ আলাদা নয়

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ৬ ডিসেম্বর ২০১৪

ডেভিড বার্গম্যান তারেক খালেদা কেউ আলাদা নয়

মুহম্মদ শফিকুর রহমান টা বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। এ মাসে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের বিজয়গাথার আনন্দ যেমন আছে, তেমনি আছে স্বজন হারানোর বেদনা। এ মাসের ১৬ তারিখ পাক হানাদার সামরিক জান্তা স্বাধীন বাংলার মাটিতে অবনত মস্তকে আত্মসমর্পণ করেছিল, তেমনি মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ বাঙালী শহীদ ও ৪ লাখ মা-বোন চরম আত্মত্যাগ করেছিলেন। বিজয়ের পূর্ব মুহূর্তে তিন শতাধিক দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবীকে ঘর থেকে, কর্মস্থল থেকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় সহযোগী জামায়াত-শিবিরের ঘাতক বাহিনী আলবদর আলশামস। কী নির্মম ছিল সেই হত্যাকাণ্ড- যিনি লেখক বা সাংবাদিক ছিলেন হত্যা করার আগে তাঁর আঙ্গুল কেটে ফেলা হয়েছিল, যিনি শিক্ষক বা গায়ক ছিলেন তাঁর জিহ্বা কেটে ফেলা হয়েছিল, যিনি চোখের ডাক্তার ছিলেন তাঁর চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছিল, যিনি হার্টের ডাক্তার ছিলেন তাঁর বুক চিরে কলজে বের করে তবেই হত্যা করা হয়েছিল। আনন্দ-বেদনার মাস এই ডিসেম্বর। আসুন আমরা যেমন বিজয়ের আনন্দ উপভোগ করি, তেমনি সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সেই অগ্রজ শহীদদের স্মরণ করি, সেই আত্মত্যাগী মা-বোনদের স্মরণ করি। প্রণতি জানাই। স্মরণ করি যে মানুষটির জন্ম না হলে এ বাংলা স্বাধীন হতো না, সেই আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। স্মরণ করি মুজিবনগর সরকারের ৪ জাতীয় নেতাকে। একই সঙ্গে যারা সে দিন দেশের সঙ্গে গাদ্দারি করেছিল তাদের ঘৃণা করি। ধিক্কার জানাই। একটা প্রচলিত কথা আছে শীত এলে পাগলের উপদ্রব বাড়ে। তেমনি বিজয়ের মাস ডিসেম্বর এলে কিছু ব্যক্তির আনাগোনা শুরু হয়। যারা পথে-ঘাটে কাঁটা বিছিয়ে এদেশের মানুষের আনন্দ-মিছিল রুদ্ধ করতে চায়। কিন্তু তারা জানে না, বাঙালী বিজয়গাথা এত বিশাল, এত আনন্দময় যে, তাতে কেউ নিরানন্দ দিয়ে ম্লান করতে পারবে না। পারবে না আত্মত্যাগের ক্ষত সহজেই মুছে দিতে। সে বিদেশী ষড়যন্ত্রকারী হোক আর দেশী অপশক্তিই হোক। এই তো ডিসেম্বরের শুরুতে ডেভিড বার্গম্যান নামে এক বিদেশী সাংবাদিককে (তথাকথিত) চলমান মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের প্রক্রিয়া নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য করায় কারাদণ্ড দিয়েছে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। মঙ্গলবার আদালতের কার্যক্রম চলাকালীন সময়ে তাকে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কারাভোগ করতে হয়েছে। একই সঙ্গে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়েছে। অনাদায়ে আরও ৭ দিন তাকে কারাভোগ করতে হবে। কে এই বার্গম্যান? আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী ও বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেন ও বাংলাদেশের নারী অধিকার আন্দোলনের নেত্রী ড. হামিদা হোসেনের কন্যা ব্যারিস্টার সারা হোসেনের স্বামী। শোনা যায় জাতে ব্রিটিশ এবং দীর্ঘদিন ধরে ড. কামাল হোসেনের বাড়িতে স্ত্রী-সন্তানসহ বসবাস করে চলেছেন। তাঁর চেহারা সুরত কতখানি আকর্ষণীয় কিংবা ব্যারিস্টার সারা হোসেনের স্বামী হওয়ার মতো কী যোগ্যতা তাঁর আছে, কী লেখাপড়া করেছেন, সে সব সারা বলতে পারবেন। তবে যদ্দুর জানি তিনি টিভি টক শো স্টার নূরুল কবির সম্পাদিত ইংরেজী দৈনিক নিউএজ পত্রিকায় বিশেষ প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেন। তাঁর স্ত্রী ব্যারিস্টার সারা হোসেনও বাবা-মার মতোই সেলিব্রেটি, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী। ১৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী আবুল কালাম আযাদ তাঁর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা করলে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল ডেভিড বার্গম্যানকে সাজা প্রদান করে। অপর দুই বিচারপতি ছিলেন বিচারপতি মুহম্মদ মুজিবুর রহমান মিয়া এবং বিচারপতি মুহম্মদ শাহিনুর ইসলাম। বার্গম্যানের এটাই প্রথম অপরাধ নয়। ট্রাইব্যুনাল-২ এর প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান রায়ে বলেন, বার্গম্যান ‘ÔSayeedi indictment : 1971 death’ শিরোনামে একটি লেখায় বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদানের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এতে আদালত অবমাননা না হলে কোনভাবেই জনস্বার্থে এবং সৎ বিশ্বাসে এ প্রশ্ন তোলা হয়নি। বরং শহীদদের সংখ্যা নিয়ে এমন সময় প্রশ্ন তোলা হয়েছে যখন ট্রাইব্যুনালের সামনে কতগুলো যুদ্ধাপরাধ মামলা রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ এদেশের মানুষের আবেগের জায়গা। আদালত ঐতিহাসিকভাবে মীমাংসিত বিষয় নিয়ে ভবিষ্যতে আর কোন প্রশ্ন তোলা বা সমালোচনা না করার জন্য বার্গম্যানকে সতর্ক করে দেন। বার্গম্যানের অপর ২টি লেখায় আদালত অবমাননার উপাদান রয়েছে। পেশায় সাংবাদিক হয়ে তিনি এবং সেই সব ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মুখপাত্রের মতো বিচার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে অযৌক্তিক, পক্ষপাতমূলক ও কুরুচিপূর্ণ প্রচারণা চালিয়েছেন। পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বার্গম্যান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ন্যায়ভ্রষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। International justice tribune’ সাময়িকীতে ২০১২ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত তার ÔICT : can one sided trials be fairÕ শিরোনামে এক প্রবন্ধে বলা হয়েছে, ওঈঞ অর্থাৎ ওহঃবৎহধঃরড়হধষ পৎরসব ঃৎরনঁহধষ কাজ করছে একাত্তরের মার্চ থেকে ডিসেম্বরের ঘটনাবলী নিয়ে। অর্থাৎ ’৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করলেও পাকিস্তান তা প্রতিহত করতে বলপ্রয়োগ করে। আওয়ামী লীগের সমর্থক ও অন্যরা পাকিস্তানী সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করে। এই প্রবন্ধে বার্গম্যান প্রথমত. যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারকে ‘একপক্ষীয় বিচার’ বলে মন্তব্য করেছেন; দ্বিতীয়ত. বাঙালীর আত্মপরিচয়ের যুদ্ধ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে ‘পাকিস্তান সেনা ও আওয়ামী লীগের সমর্থকদের’ মধ্যকার যুদ্ধ বলে লিখেছেন। এরপরও কিভাবে কিসের ভিত্তিতে এই বিদেশী নাগরিক ডেভিড বার্গম্যান বাংলাদেশে বসবাস করছেন। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের তা দেখা দরকার। এর আগেও ২০১১ সালের ১ অক্টোবর ‘অ পৎঁপরধষ ঢ়বৎরড়ফ ভড়ৎ ওঈঞ’ শিরোনামে একটি লেখা নিউএজ পত্রিকায় লেখেন। যে কারণে ট্রাইব্যুনাল পত্রিকার সম্পাদক নুরুল কবির প্রকাশক শহীদুল্লাহ খান বাদলের বিরুদ্ধে রুল দেন। ২০১২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ওই রুল নিষ্পত্তির সময় ট্রাইব্যুনাল বার্গম্যানকে ‘সর্বোচ্চ সতর্ক’ করে দিয়েছিল। এর আগে আমরা দেখেছি, দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত হয়ে জিয়া-খালেদা তনয় তারেক রহমান লন্ডনে বসে ক’দিন পর পর একটা মিথ্যা তথ্য ছেড়ে আমাদের দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এমন বেয়াদবিও করেছেন যে বঙ্গবন্ধু নাকি স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি এবং তিনি বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন না। ঘোষক আর প্রথম প্রেসিডেন্ট নাকি তার বাপজান। ক’দিন আগে খালেদা জিয়া এক জনসভায় বললেন, ‘আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ করেনি, আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল নয়।’ এভাবে ডেভিড বার্গম্যান, তারেক এবং খালেদা একই সূত্র থেকে যে কথা বলছেন, তা বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়। এরা একই নাশকতামূলক পরিকল্পনা নিয়ে বলেছেন। মঙ্গলবারের রায়ের পর ডেভিড বার্গম্যানের স্ত্রী ব্যারিস্টার সারা হোসেন তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন : ঞযব লঁফমবসবহঃ যধং পঁৎনবফ ঢ়বড়ঢ়ষব’ং ভৎববফড়স ড়ভ ংঢ়ববপয ..... ঃযব াবৎফরপঃ রং ধ ংবাবৎং নষড়ি ঃড় ঃযব ষরনবৎধঃরড়হ ধিং ংঢ়রৎরঃ ঃযধঃ বহফড়ৎংবং ভৎবব ঃযরহশরহম. অপরদিকে ট্রাইব্যুনাল তার রায়ে বলেছে : জরমযঃ ঃড় ভৎববফড়স ড়ভ ংঢ়ববপয ধং মঁধৎধহঃববফ রহ ঃযব পড়হংঃরঃঁঃরড়হ রং হড়ঃ ধনংড়ষঁঃবষু ঁহভবঃঃবৎবফ ধহফ রঃ রং ঃড় নব বীবৎপরুবফ রিঃয ংড়সব ৎবংঃৎরপঃরড়হ ধহফ পধঁঃরড়হ (ডেইলি স্টার, ৩ ডিসেম্বর ২০১৪). এ কারণেই প্রবন্ধের শুরুতে এদের কথা বলেছি। এই ডেভিড বার্গম্যান বা তারেক বা খালেদাÑ এরাই আমাদের জাতীয় অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টির ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। আমরা দেখছি বিগত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে কিভাবে পিটিয়ে-কুপিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়েছে, কিভাবে ট্রেন-বাসে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়েছে, কিভাবে পবিত্র কোরআন শরীফ ও হাদিসে রসূল (সা) পোড়ানো হয়েছে, মসজিদে পর্যন্ত আগুন দেয়া হয়েছে। তারা এ সব করেছে নির্বাচন বানচাল করে ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধীদের বের করে নিয়ে যাওয়ার জন্য, যেমন করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়া বিচারাধীন ও সাজাপ্রাপ্ত ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধীকে কারাগার থেকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইন করে এবং যুদ্ধাপরাধী দালাল, রাজাকার, শান্তি কমিটি, আলবদর-আলশামস, নারী নির্যাতনকারীদের বিচার করার জন্য সারাদেশে ৭৩টি ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করেন। প্রায় ৩৮ হাজার যুদ্ধাপরাধী গ্রেফতার হয়, তন্মধ্যে ১১ হাজারের বিরুদ্ধে চার্জশীট দিয়ে বিচার শুরু হয়। সাত শ’র মতো যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড এবং যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজাও হয়েছিল। খালেদা ভেবেছিলেন এবারও গোলাম আযম-নিজামী-সাঈদীদের একইভাবে ছেড়ে দেবে। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। ১৯৭৩ সালের আইন দিয়েই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছেন। এরই মধ্যে অনেকের মৃত্যুদণ্ড ও আমৃত্যু সাজা হয়েছে। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা শুরু হয়েছে। বার্গম্যান, তারেক, খালেদা, রাজাকার বা যাই ভাবুক শেখ হাসিনা কেবল দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, বিশ্ব নেতৃত্বের উচ্চতায় আসীন এক রাষ্ট্রনায়ক। ঢাকা, ৫ ডিসেম্বর ২০১৪ লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
×