ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘তারা ভাই’ ছিলেন সাংবাদিক গড়ার কারিগর

প্রকাশিত: ০৫:২২, ৬ ডিসেম্বর ২০১৪

‘তারা ভাই’ ছিলেন সাংবাদিক গড়ার কারিগর

বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার ॥ দেশের সাংবাদিকতার জগতে তিনি ছিলেন অন্যতম গুরু, ছিলেন সাংবাদিক গড়ার কারিগর। তাঁর হাত ধরেই দেশের সাংবাদিকতায় আধুনিকতার নতুন ধারা সংযোজন হয়েছিল। তিনি ‘তারা ভাই’ হয়ে পুরো সমাজের জন্য বেঁচে ছিলেন। হয়ে উঠেছিলেন সবার আত্মার অভিভাবক। সাংবাদিকতা জগতের এক অনন্য প্রতিষ্ঠান। সারল্যে ভরা একটা হাসির ঝলক তাঁর মুখে সবসময় লেগেই থাকত। তাঁর নিষ্ঠা, সাধনা, আদর্শ ও পেশার প্রতি অঙ্গীকার সাংবাদিকতার ইতিহাসে চির অনুসরণীয় হয়ে থাকবে। নির্ভীকতা, দেশপ্রেম ও প্রজ্ঞা তাঁকে অসামান্য উচ্চতায় স্থাপন করেছে। তাঁর মৃত্যুতে শুধু সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে নয়, জাতীয় জীবনেও অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। শুক্রবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে আয়োজিত বরেণ্য সাংবাদিক ফওজুল করিমের স্মরণসভায় বক্তারা এসব মন্তব্য করেন। সভার আয়োজন করে দৈনিক বাংলা বিচিত্রা পরিবার। দৈনিক বাংলার প্রাক্তন সহকারী সম্পাদক সালেহ চৌধুরীর সভাপতিত্বে এবং জাতীয় প্রেসক্লাবের সিনিয়র সহসভাপতি কাজী রওনক হোসেনের উপস্থাপনায় সভায় বক্তব্য রাখেন প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমদ, দৈনিক জনকণ্ঠের প্রাক্তন সিটি এডিটর আবদুল খালেক, চন্দন সরকার, শুভ রহমান, আবুল কাশেম, ফটো সাংবাদিক মুহাম্মদ কামরুজ্জামান, প্রয়াতের স্ত্রী নীলুফার করিম প্রমুখ। উপস্থিত ছিলেন দৈনিক আমার দেশের ফিচার সম্পাদক হাসান হাফিজ, প্রয়াতের ছোট ভাইয়ের স্ত্রী আফসানা কামাল, রোজিনা আকবর, কবি নাসির আহমেদ, বাংলাদেশ গিটার শিল্পী সংস্থার সাধারণ সম্পাদক এনামুল কবির প্রমুখ। প্রধান অতিথির বক্তব্যে সাংবাদিক ফওজুল করিমের দীর্ঘদিনের সহকর্মী, ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং দৈনিক জনকণ্ঠের উপদেষ্টা সম্পাদক তোয়াব খান বলেন, তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের, ১৯৫৫ সাল থেকে। একসময়ে এ রকম হয়েছে, রাতের বেলায় সংবাদ অফিসের কাজ শেষ করে আমরা তখন কথা বলতে বলতে হেঁটে বেড়াতাম। ওই কথাগুলো এতটাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ছিল যে তার ছেদ টানা ওই মুহূর্তে সম্ভব ছিল না। বংশালের মোড় হয়ে ভিক্টোরিয়া পার্কের গির্জা পর্যন্ত গিয়ে আবার সংবাদ অফিসে ফিরে আসতাম। তৃতীয় বারে আমরা শেষ করতাম, বাড়ি ফিরে যেতাম। এই অবস্থা থেকে আমাদের সম্পর্ক শুরু। তিনি বলেন, আমরা যখন সাংবাদিকতা শুরু করি, তখন সাংবাদিকতা পেশায় বেতন এত কম ছিল যে, আজকের দিনে তা কল্পনাই করা যায় না। হাতে গোনা দুয়েকটি পত্রিকা ছাড়া অন্যসব পত্রিকার বেতন দেয়া হতো তিন-চার-পাঁচ মাসে। তাও একসঙ্গে দেয়া হতো না। ষাটের দশকের শুরুতে দেশের সাংবাদিকতার জগতে কিছু কিছু পরিবর্তন আসতে শুরু করে। আইয়ুব খান নিজের স্বার্থে সামরিক শাসক হিসেবে এদেশের প্রথম ওয়েজবোর্ড চালু করেছিল। সাংবাদিকদের দাবি ছিল এটা। এটি চালু হওয়ার পর এদেশে সাংবাদিকদের বেতনের একটা কাঠামো নির্ধারিত হয়। সাংবাদিকতা আস্তে আস্তে প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পে রূপ নিতে শুরু করে। এভাবে বিভিন্ন অভিজ্ঞাতার মধ্য দিয়ে আমাদের পথচলা। দেশের সাংবাদিকতায় আধুনিকতার নতুন ধারা সংযোজনের পেছনে যেসব প্রবীণ সাংবাদিকদের অবদান রয়েছে তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। তোয়াব খান আরও বলেন, অনেক দিন চলে গেছে, আমরা এখান থেকে চলে গেছি, আবার ফেরত এসেছি, আবার আমাদের দেখা হয়েছে, আবার একসঙ্গে কাজ করেছি, কাজ করতে করতে আবার চাকরি চলে গেছে, কিন্তু এর মধ্যে আমাদের বন্ধুত্ব কোনদিন নষ্ট হয়নি। আমরা এক সঙ্গেই ছিলাম। খবরের কাগজ এবং সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তাঁর যেসব অবদান এর একটি ডকুমেন্টেশন করে রাখার প্রয়োজন। মাওলা বক্স সর্দার মেমোরিয়াল ট্রাস্টের চেয়ারম্যান আজিম বক্স বলেন, তাঁর প্রস্থান আমাদের এতিম করে দিয়ে গেছে। তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় একটি দিক ছিল কঠোরভাবে সময় মেনে চলা। তিনি সময় মেনে চলার ব্যাপারে কোন ছাড় দিতেন না। ১৩ থেকে ১৪ বছর ওনাকে দেখেছি, এই সময়ের মধ্যে কোন দিনও দুই-এক মিনিটের জন্য অফিসে আসতে বিলম্ব হয়নি। ক্রীড়া সাংবাদিক মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, খেলার সংবাদ যে প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা যেতে পারে সেই ধারণা সর্বপ্রথম আমাদের দিয়েছিলেন ‘তারা ভাই’। তিনি সেই আমলেই উপলব্ধি করেছিলেন খেলার গুরুত্ব এবং তাঁরই দেখানো পথে দেশের ক্রীড়া সাংবাদিকতা এতদূরে এসেছে। সভাপতির বক্তব্যে সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী বলেন, বিচিত্র বিষয়ে ওনার কৌতূহল ছিল, ভেতরে শিশুর মতো সরল মন ছিল। আপাতদৃষ্টিতে গম্ভীর দেখালেও, খুব রসিক মানুষ ছিলেন উনি। তিনি খুব অভিমানীও ছিলেন। এই প্রথিতযশা সাংবাদিকের জীবনকর্ম ও আদর্শ নিয়ে একটি স্মরণিকা প্রকাশের গুরুত্বের কথা তুলে ধরেন তিনি। প্রথিতযশা এই সাংবাদিক ১৯৩০ সালের ২৭ নবেম্বর বগুড়ার গাবতলীর বাগবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৫ সালে দৈনিক সংবাদে তাঁর সাংবাদিকতার জীবন শুরু হয়। এরপর তিনি দৈনিক পাকিস্তানে যোগ দেন এবং স্বাধীনতার পর দৈনিক বাংলার বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। দৈনিক পত্রিকার ম্যাকআপ, গেটআপ, ফটো এডিটিংয়ের ক্ষেত্রে তিনি অনন্য ভূমিকা পালন করেন। তাঁর হাতে দৈনিক বাংলার আধুনিক বিকাশ ঘটে। লে-আউট ডিজাইন বিষয়ে তাঁর ফটো সম্পাদনা গ্রন্থটি সাংবাদিকতার শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়। তিনি ব্রিটেনের টমসন ফাউন্ডেশন থেকে সাংবাদিকতার ওপর প্রশিক্ষণ নেন। জেমস ওয়াইজের পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জাতি ও পেশার বিবরণ সংবলিত ৯টি গ্রন্থের অনুবাদক ফওজুল করিম। চার ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। সাংবাদিকদের কাছে ‘তারা ভাই’ নামে বেশি পরিচিত ছিলেন। বাংলাদেশের সাংবাদিকতার জগতে একজন বার্তা সম্পাদক হিসেবে তাঁর নাম কিংবদন্তিতুল্য। একজন গবেষক হিসেবে ইতিহাসের নানা বিষয় নিয়ে বিশেষ করে ঢাকার ওপর তিনি গবেষণাধর্মী কাজ করেন। দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগে এ বছর ১৫ অক্টোবর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। এ সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর।
×