ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দুর্নীতির ধারণা সূচকে এবার বাংলাদেশ ১৪তম স্থানে

প্রকাশিত: ০৫:০৬, ৪ ডিসেম্বর ২০১৪

দুর্নীতির ধারণা সূচকে এবার বাংলাদেশ ১৪তম স্থানে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশে দুর্নীতি আগের চেয়ে বেড়েছে। সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় এবার ১৪তম স্থানে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬তম। দুর্নীতির ধারণা সূচকে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ সোমালিয়া ও উত্তর কোরিয়া। সূচকের নিম্নক্রম অনুসারে ১৭৫ দেশের মধ্যে এই দুই দেশের অবস্থান ১৭৪। তাদের স্কোর ৮। সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত তালিকার শীর্ষে রয়েছে ডেনমার্ক। ১০০ স্কেলের মধ্যে দেশটির স্কোর ৯২। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) বিশ্ব দুর্নীতির ধারণা সূচকে এ তথ্য প্রকাশ করেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (সিপিআই) বাংলাদেশ দুই ধাপ নিচের দিক থেকে ওপরের দিকে এগিয়েছে। বুধবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) আয়োজিত বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির ধারণা সূচক-২০১৪’ প্রকাশ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে বেসরকারী এ সংস্থাটির বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান সাংবাদিকদের কাছে এ তথ্য তুলে ধরেন। অপরদিকে টিআইবির প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কমিশনার মোঃ সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। টিআইবি মনে করে বাংলাদেশে দুর্নীতি বাড়ার মূল কারণ হিসেবে দুর্নীতিবিরোধী অঙ্গীকার অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণে ঘাটতি, দুদকের স্বাধীনতা খর্বের উদ্যোগ ও দুদকের প্রত্যাশিত সক্রিয়তার ঘাটতি, দুর্নীতির ঘটনায় জড়িতদের বিচারের সম্মুখীন করার ঘাটতি, জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা, স্বার্থের দ্বন্দ্ব কালো টাকা সাদা করার সুযোগ ও উচ্চমাত্রায় অবৈধ অর্থের পাচার। অনুষ্ঠানে জানান হয়, দুর্নীতির ধারণা সূচক নিচের দিকে গেলে দুর্নীতি কমে। আর ওপরের দিকে এগুলে দুর্নীতি বাড়ে। সূচক ব্যাখ্যা করলে দাঁড়ায়, বাংলাদেশে দুর্নীতি আগের চেয়ে বেড়েছে। অন্যদিকে দুর্নীতির ধারণা সূচকের ১০০-এর স্কেলে বাংলাদেশের স্কোর ২৫, যা ২০১৩ সালের তুলনায় ২ পয়েন্ট কমেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশে দুর্নীতি বেড়েছে। উর্ধক্রম অনুসারে তালিকায় ৯ ধাপ নিচে নেমে বিশ্বের ১৭৫ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৪৫তম অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের মতো একই স্কোর পাওয়া অন্য দেশগুলো হচ্ছেÑ গিনি, লাওস, কেনিয়া ও পাপুয়া নিউগিনি। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার ৭ দেশের মধ্যে নিম্নক্রম অনুসারে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। ১২ স্কোর পেয়ে প্রথম অবস্থানে রয়েছে আফগানিস্তান। তবে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ভাল অবস্থানে রয়েছে ভুটান। উর্ধক্রম অনুসারে তালিকায় ভুটানের অবস্থান ৩০তম (স্কোর ৬৫)। এর পরই রয়েছে শ্রীলঙ্কা ও ভারত (স্কোর ৩৮), বিশ্বে তাদের অবস্থান ৮৫তম। আরও নিচের দিকে রয়েছে নেপাল ও পাকিস্তান (স্কোর ২৯)। সম্মেলনে বলা হয়, ২০১৩ সালে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় নিচের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬তম ছিল। মোট স্কোর ২৭ পেয়ে বিশ্বের ১৭৭ দেশের মধ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠার দিক দিয়ে সূচকে ৮ ধাপ এগিয়ে ১৩৬তম অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। দুর্নীতির ধারণা সূচকে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ সোমালিয়া ও উত্তর কোরিয়া। এর পরই রয়েছে সুদান ১৭৩তম (স্কোর ১১), আফগানিস্তান ১৭২তম (স্কোর ১২), দক্ষিণ সুদান ১৭১ (স্কোর ১৫), ইরাক ১৭০তম (স্কোর ১৬) তুর্কমেনিস্তান ১৬৯তম (স্কোর ১৭) ও উজবেকিস্তান, লিবিয়া ও ইরিত্রিয়া ১৬৬তম (স্কোর ১৮)। এছাড়া কম দুর্নীতিগ্রস্ত ১০ দেশের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে নিউজিল্যান্ড (স্কোর ৯১) ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ফিনল্যান্ড (স্কোর ৮৯)। এরপর চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে সুইডেন (স্কোর ৮৭), পঞ্চম নরওয়ে ও সুইজারল্যান্ড (স্কোর ৮৬), ষষ্ঠ সিঙ্গাপুর (স্কোর ৮৪), সপ্তম নেদারল্যান্ডস (স্কোর ৮৩), অষ্টম লুক্সেমবার্গ (স্কোর ৮২) এবং নবম অবস্থানে কানাডা (স্কোর ৮১)। বিশ্ব দুর্নীতির রিপোর্ট প্রকাশকালে টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপার্সন এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন বৈশ্বিকভাবে বাংলাদেশের দুর্নীতি উদ্বেগজনক। তিনি বলেন, দুর্নীতিতে দেশের অবস্থা নাজুক। বিগত বছরগুলোতে আমরা আমাদের অগ্রগতি ধরে রাখতে পারিনি, যা খুব উদ্বেগজনক। এর কারণ হচ্ছে, দেশের সব সেক্টরে নির্বাহীদের ক্ষমতার প্রয়োগ এবং অধস্তনদের প্রতি উর্ধতনদের কর্তৃত্ব কাজ করে। এর কারণে সংসদ সদস্যরাও স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করতে পারে না। এছাড়া দুর্নীতির মামলা আদালত পর্যন্ত যাওয়ার পরও তা তুলে নেয়া হয়। এটা ক্ষমতার অপব্যবহার। তিনি অভিযোগ করেন, দুর্নীতির কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ মানুষ। বাংলাদেশের মতো অন্য পৃথিবীর কোন দেশে সাধারণ মানুষ দুর্নীতির কারণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। যে কোন প্রকার দুর্ঘটনাও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। খতিয়ে দেখলে পাওয়া যাবে, এতে জড়িত আছে উচ্চ পর্যায়ের কোন ক্ষমতাশালী ব্যক্তি। এর কারণ হচ্ছে প্রভাব। সুলতানা কামাল বলেন, টিআইবি এবং সরকারের মধ্যে ‘লাভ এ্যান্ড হেট’ সম্পর্ক এ দুটি বিষয় লক্ষণীয়। সরকারের নানা সেক্টরে নানাধরনের লোক আছে। তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে কোন কিছু গেলে তারা টিআইবির মতো সংগঠনগুলোর সমালোচনা করে। শুধু আমাদেরই না তারা সিপিডি এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোরও সমালোচনা করে। তারা আমাদের সমর্থন না করে প্রতিক্রিয়া দেখায়। নাগরিক সমাজ এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে ক্ষমতাবানরা খারাপ মনোভাব পোষণ করে। ফলে মানুষ বিচার চাওয়া থেকে বিরত থাকে। এক পর্যায়ে মানুষ বিচারহীনতায় ভোগে। সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘দুর্নীতি উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে উন্নতি করা সম্ভব নয়। এ জন্য আইনী প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করার কথা থাকলেও সেভাবে কাজ করতে পারছে না। বিশেষ করে দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না।’ যারা দুর্নীতি করে তাদের প্রশ্রয় দিলে দুর্নীতি বাড়বে বলে তিনি মনে করেন। এদিকে টিআইবির প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদক কমিশনার মোঃ সাহাবুদ্দিন চুপ্পু বলেছেন, ‘টিআইবির পরিসংখ্যান প্রকৃত চিত্রের চেয়ে ভিন্নতর। টিআইবির প্রতিবেদন প্রকাশের পর রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদক কার্যালয়ে সাংবাদিকদের কাছে তিনি বলেন, বাস্তবতার নিরিখে টিআইবির প্রতিবেদন গ্রহণযোগ্য নয়। দুদক তাদের প্রতিবেদনের সঙ্গে একমত নয়। যদিও পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন এখনও আমরা হাতে পাইনি। তবে এ প্রতিবেদন হাতে পেলেও তা গ্রহণযোগ্য হবে বলে আমি মনে করি না। টিআইবির অভিযোগ অস্বীকার করে দুদক কমিশনার বলেন, আমরা ক্ষমতাসীনদের ছেড়ে দিচ্ছিÑ কথাটা ঠিক নয়। ক্ষমতাসীন ও বিরোধী যেই হোক, দুর্নীতিগ্রস্ত কাউকে ছাড় দেয়া হচ্ছে না। কাউকেই দায়মুক্তি দেয়া হচ্ছে না। হলমার্ক, ডেসটিনি ও রানা প্লাজার মালিকের মতো সব অপরাধীর বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এছাড়া দুদক আগের যে কোন সময়ের তুলনায় এখন অনেক সক্রিয় বলেও দাবি করেন তিনি। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এম হাফিজউদ্দিন খান, প্রাক্তন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এ টি এম শামসুল হুদা ও সংস্থাটির উপনির্বাহী পরিচালক ড. সুমাইয়া খায়ের প্রমুখ।
×