ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

কাইয়ুম চৌধুরীর মৃত্যুতে শোকাবহ শাস্ত্রীয় সঙ্গীত উৎসবের চতুর্থ দিন

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২ ডিসেম্বর ২০১৪

কাইয়ুম চৌধুরীর মৃত্যুতে শোকাবহ শাস্ত্রীয় সঙ্গীত উৎসবের চতুর্থ দিন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসবের রবিবার ছিল চতুর্থদিন। রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় শুরু হওয়া এ অনুষ্ঠান চলে ভোর পর্যন্ত। আর চতুর্থ দিন উৎসব পরিবেশনা উপভোগ করেন প্রায় ৫৫ হাজার দর্শক- শ্রোতা। তবে উৎসবের শুরুর দিকে বাংলাদেশের বরেণ্য চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর আচমকা অসুস্থতা এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর মৃত্যু সংবাদে উৎসবে শোকের ছায়া নেমে। শিল্পীদের পরিবেশনাতেও ছিল শোকের আবহ। শিল্পীদের বিভিন্ন পরিবেশনার পর রাত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, ভোরের আলো ফুটতে বেশি দেরি নেই। এমন সময় বাঁশি হাতে মঞ্চে উঠে আসেন পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া। বাঁশের বাঁশিতে আলাপ, মত্ত তালে রাগ আহির ভৈরব, সবশেষে কীর্তন ও ভৈরবী পরিবেশন করে শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রাখেন ভোর পর্যন্ত। পাঁচ দিনব্যাপী এ উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসবটি পল্লীকবি জসিম উদ্দীনকে উৎসর্গ করা হয়েছে। উৎসবের চতুর্থ দিনের শুরুতেই রাগ নাট্টাই এবং আধিতালে নৃত্যশিল্পী অমিত চৌধুরী ভরতনাট্যমে নাটেশা কৌথুওয়াম পরিবেশন করেন। এ ছাড়া তিনি বসন্ত রাগে নটনম আডিনা ও রাগ পূরবীতে রূপক তালে তিল্লানা পরিবেশন করে দর্শকদের মন জয় করে নেন। এ নৃত্যশিল্পীর সঙ্গে বেহালায় সত্য বিশাল অভিরেড্ডি, মৃদঙ্গমে সুরিয়া নারায়ণন গোপাল কৃষ্ণাণ, নাট্যভঙ্গমে রাজদীপ ব্যানার্জি এবং কণ্ঠসঙ্গীতে সুকুমার গোবিন্দন কুট্টি ছিলেন। পরিবেশনা শেষে তাঁর হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের। এরপর মঞ্চে এসে তিনতালে তবলা বাজিয়ে শ্রোতাদের মন কাড়েন স্বরূপ হোসেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে হারমোনিয়ামে ছিলেন আলমগীর পারভেজ। পরিবেশনা শেষে তাঁর হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী লাইসা আহমদ লিসা। স্বরূপ হোসেনের পরিবেশনার পর আনুষ্ঠানিকভাবে উৎসবের চতুর্থদিনের উদ্বোধন করা হয়। এ সময় প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমেরিটাস ড. আনিসুজ্জামান। বিশেষ অতিথি ছিলেন বরেণ্য চিত্রকর কাইয়ুম চৌধুরী এবং স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেই চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মাটিতে পড়ে যান। এরপর তাঁকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। উৎসবে শোকের ছায়া নেমে এলেও পরবর্তীতে অনুষ্ঠানের বাকি পর্বগুলো অনুষ্ঠিত হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর মঞ্চে এসে সরোদের তানে শ্রোতাদের বিমুগ্ধ করে রাখেন দুই সহোদর আমান আলী খান এবং আয়ান আলী খান। সাড়ে নয় মাত্রায় ঝিঞ্ঝটি রাগ বাজিয়ে পরিবেশনা শুরু করেন তাঁরা। এরপর রাগেশ্রী ও একটি ভাটিয়ালি ধুন বাজিয়ে উৎসব আলোকিত করে তোলেন শিল্পীদ্বয়। তাঁদের সঙ্গে তবলায় ছিলেন সত্যজিৎ তালওয়ালকার। পাখওয়াজে ছিলেন পণ্ডিত ফতেহ সিং গাঙ্গানি। তাঁদের হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন মাছরাঙা টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী ফাহিম মোনায়েম। রাত সাড়ে ১০টার দিকে তাঁদের পরিবেশনার পর মঞ্চে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এমেরিটাস ড. আনিসুজ্জামান শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর মৃত্যুর সংবাদ দেন। এ সময় চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর কণ্ঠসঙ্গীত পরিবেশন করেন সামিহান কাশালকার। তিনি মালকোশ রাগে বিলম্বিত, দ্রুত খেয়াল ও তারানা এবং সোহিনী রাগে দ্রুত খেয়াল পরিবেশন করেন। তবলায় ছিলেন সঞ্জয় অধিকারী এবং হারমোনিয়ামে গৌরব চট্টোপাধ্যায়। সামিহান কাশালকারের হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের ডেপুটি হাই কমিশনার সন্দীপ চক্রবর্তী। এরপর মধ্যরাতে পণ্ডিত তেজেন্দ্র নারায়ণ মজুমদারের সরোদ এবং গণেশ রাজাগোপালনের বেহালার যুগলবন্দী পরিবেশনা। দক্ষিণী রাগ হিন্দোলম এবং রাগ চারুকেশী পরিবেশন করেন গুণী এ দুই শিল্পী। কবি জসীম উদ্দীনের লেখা ‘রঙ্গিলা’ গানের সুরের ওপর ভিত্তি করে একটি ধুন বাজিয়ে শেষ করেন তাঁদের পরিবেশনা। এ সময় তবলায় ছিলেন পণ্ডিত যোগেশ শামসি এবং মৃদঙ্গমে রবিশঙ্কর ভদ্রাচার। পণ্ডিত তেজেন্দ্র নারায়ণ মজুমদারকে উৎসব স্মারক তুলে দেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা। গণেশ রাজাগোপালনকে উৎসব স্মারক তুলে দেন তুরস্কের রাষ্ট্রদূত হোসেইন মুফতুগলু। এরপর শুরু হয় কৌশিকী চক্রবর্তীর কণ্ঠসঙ্গীত পরিবেশনা। বাগেশ্রী রাগে একতালে বিলম্বিত, তিনতালে মধ্যলয়ের খেয়াল ও তারানা পরিবেশন করেন তিনি। দুটি পাহাড়ি ঠুমরী গেয়ে তাঁর পরিবেশনা শেষ করেন। কৌশিকীর সঙ্গে তবলায় ছিলেন পণ্ডিত যোগেশ শামসি। এ সময় কৌশিকী চক্রবর্তীর হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন চিত্রশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার। সবশেষে পরিবেশিত হয় চতুর্থদিনের মূল আকর্ষণ বাঁশি। বাঁশের বাঁশিতে পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া প্রায় দেড় ঘণ্টা একটানা বাঁশি পরিবেশন করে সবার মন জয় করেন। মত্ত তালে রাগ আহির ভৈরব দিয়ে শুরু করে এরপর পণ্ডিত চৌরাসিয়া বাঁশিতে তোলেন কীর্তনের সুর। রাগ ভৈরবী বাজিয়ে পরিবেশনা শেষ করেন তিনি। তাঁর সঙ্গে তবলা সঙ্গত করেন ওস্তাদ যোগেশ শামসি। পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়ার হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের। এদিকে গতকাল সোমবার ছিল উৎসবের শেষদিন। শেষদিনের অনুষ্ঠান আগের মতোই সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় শুরু হয়ে শেষ হয় ভোর পাঁচটায়। শুরুতে সম্মিলিত কণ্ঠে বাংলা গানের কোরাসে অংশ নেন অদিতি মহসিন, অনিন্দিতা চৌধুরী, আজিজুর রহমান, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস, বুলবুল ইসলাম, চন্দনা মজুমদার, ইলোরা আহমেদ শুক্লা, ফাহিম হোসেন চৌধুরী, ফরিদা পারভীন, ইফফাত আরা দেওয়ান, জান্নাত-ই ফেরদৌস, ঝুমা খন্দকার, খায়রুল আনাম শাকিল, কিরণ চন্দ্র রায়, লাইসা আহমেদ লিসা, মাসুদা নার্গিস আনাম, মিতা হক, মহিউজ্জামান চৌধুরী, নাসিমা শাহীন, প্রিয়াঙ্কা গোপ, শাহীন সামাদ, শাহীন কবির পলাশ, শামা রহমান, শারমিন সাথী ইসলাম, সেমন্তী মঞ্জারি, সুবির নন্দী, সুমা রানী রায়, তানিয়া মান্নান, ইয়াসমিন মুসতারী এবং ইয়াকুব আলী খান। এছাড়া বিশাল কৃষ্ণ (নাচ), কিশোরী আমানকার (কণ্ঠ), মনিরুজ্জামান (বাঁশি), অশ্বিনী ভিডে দেশপা-ে (কণ্ঠ), উদয় ভাওয়ালকার (কণ্ঠ ধ্রুপদ), ওস্তাদ আমজাদ আলী খানের সরোদ পরিবেশনাও ছিল।
×