ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

প্রিয় জগলু ভাই

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২ ডিসেম্বর ২০১৪

প্রিয় জগলু ভাই

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক ও কলামিস্ট জগলুল আহমদ চৌধুরী। সংবাদপত্র জগতে সবার পরিচিত ‘জগলু’ ভাই। ২৯ নবেম্বর রাজধানীতে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নির্মমভাবে মারা যান। তাঁর এ বেদনাবিধূর প্রয়াণে শোকাচ্ছন্ন স্বজন, সহকর্মী, পাঠক ও অনুরক্ত। ঘটনার দিন রাতে এটিএন নিউজ-এর সংবাদ নির্ভর ‘অন্যদৃষ্টি’ অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু তাঁর ভাগ্য খারাপ। নিজের কর্মক্ষেত্র ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস থেকে কারওয়ান বাজারে আসছিলেন। বাস থেকে নামার সময় হঠাৎ দ্রুত গতিতে বাস টান দিলে তিনি রাস্তায় পড়ে গিয়ে মাথায় প্রচ- আঘাত পান। এরপর তাঁকে হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। ১৯৫৪ সালে হবিগঞ্জের পিয়াইম গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ছিলেন সে সময়ের নামকরা রাজনীতিক। যুক্তফ্রন্টের এমএলএ ও পরে আইনমন্ত্রী নির্বাচিত হন। কর্মজীবন শুরুই হয়েছিল সাংবাদিকতা দিয়ে। সাংবাদিকতার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক, কলামিস্ট হিসেবেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। জীবনের শেষ টকশোতে অংশ নিয়েছিলেন গত শুক্রবার একটি বেসরকারী চ্যানেলে। সমসাময়িক বিষয় নিয়ে পর্যালোচনার সে অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, “দেশ এগিয়ে যাচ্ছে বলতে গেলে দেশে সুশাসন আছে কিনা সেটাও দেখতে হবে। উন্নয়নের পাশাপাশি দেশে গণতান্ত্রিক চর্চাও থাকতে হবে। গণতন্ত্রকে বাদ দিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় না। একজন বিদেশী দেশে এলে আমাদের মিডিয়াগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়ে, এটা ঠিক, তবে সেই বিদেশীরা কী বলতে চাচ্ছেন, সেটাও জনগণ জানতে চায়। আর জনগণকে সার্বিক বিষয়ে জানানোটাই মিডিয়ার কাজ।” অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে অংশ নিয়েছিলেন সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমির, অর্থনীতিবিদ এমএম আকাশ ও ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন। বেশ জমজমাট ও প্রাণবন্ত আলোচনায় জগলুল আহমদ চৌধুরী মূল্যবান অনেক কথাই বলেছিলেন। যা আজ কেবলই স্মৃতি। কৃতিমান এই সাংবাদিক বাংলা ও ইংরেজী দুই ভাষাতেই নির্ভার গদ্য লিখতেন। ঝরঝরে ভাষায় আন্তর্জাতিক বিষয়গুলো উপস্থাপনে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। সাধারণ পাঠক ছিল তাঁর লক্ষ্য। প্রথিতযশা সাংবাদিক জগলুল আহমদ চৌধুরী সর্বশেষ ইংরেজী দৈনিক ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী ছাত্র ছিলেন। বিএ (সম্মান) ও এমএ ডিগ্রী লাভের পরপরই সাংবাদিকতা জগতে প্রবেশ করেন স্বাধীনতার পর। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় (বাসস) প্রতিবেদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে তাঁকে নয়াদিল্লীতে বাসস প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করার কারণে ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিকে খুব কাছে থেকে দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে তিনি ছিলেন সচেষ্ট। পরবর্তীকালে বাসসের বিশেষ প্রতিনিধি, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও প্রধান সম্পাদক ছিলেন। ২০০৯ সালে অবসরে যান। কিন্তু সাংবাদিকতার জগত ছেড়ে যাননি। সাংবাদিক হিসেবে সবার প্রিয় জগলুল আহমদ চৌধুরী নিজে সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেননি। ১৯৭৮ সালে হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহারের কন্যা ইংরেজী সাহিত্যের অধ্যাপক তাজিন চৌধুরীকে বিয়ে করেন। এক পুত্র ও এক কন্যার জনক জগলুল আহমদ চৌধুরী জাতীয় প্রেসক্লাব ও ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির আজীবন সদস্য ছিলেন। জগলুল আহমদ চৌধুরী প্রচুর লিখতেন। ঢাকার প্রায় সব সংবাদপত্রেই তিনি সহজ ভাষায় নিয়মিত কলাম লিখতেন। আমরা যারা তাঁর স্নেহধন্য ছিলাম, তারা নানাবিষয়ে তাঁর কাছ থেকে পেতাম অজানা তথ্য। এমনকি আমাদের প্রতিবেদন পাঠ করতেন এবং সে নিয়ে মতামতও দিতেন। ছাত্রজীবনে তিনি ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহপাঠী। ব্যক্তিগত পরিচয়কে পুঁজি করে তিনি কখনও রাজনৈতিক সুযোগ সুবিধা বা পদ-পদবীর দিকে ধাবিত হননি। কারণ ছিল তিনি লোভ ও মোহমুক্ত। পরশ্রীকাতরতা, হিংসা-বিদ্বেষ ইত্যাদি কোনকিছুই তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। নিরহংকারী হিসেবে তিনি সবার সঙ্গে সবার যোগে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন উচ্চতর চেতনায়, মননশীলতায়। জগলুল আহমদ চৌধুরীর মৃত্যু চোখে আঙ্গুল দিয়ে স্পষ্ট করে দিল, এদেশে পরিবহন ও চিকিৎসা খাতের নির্মমতা। সেসব দূর করাই হবে পরবর্তী প্রজন্মের দায়িত্ব।
×