ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রশ্ন ফাঁসের ‘গুজব’, তীব্র সমালোচনা লাখ লাখ শিক্ষার্থী অভিভাবকের, ক্ষুব্ধ শিক্ষাবিদরাও;###;শিশুদের নিয়ে ‘এক্সপেরিমেন্ট’ বন্ধ করুন

প্রাথমিকের স্তর যদি অষ্টম শ্রেণী হয় তবে কেন এ পরীক্ষা

প্রকাশিত: ০৪:৩৮, ২ ডিসেম্বর ২০১৪

প্রাথমিকের স্তর যদি অষ্টম শ্রেণী হয় তবে কেন এ পরীক্ষা

বিভাষ বাড়ৈ ॥ প্রশ্ন ফাঁস, সমালোচনা আর লাখ লাখ শিক্ষার্থী-অভিভাবকের ক্ষোভের মধ্য দিয়ে শেষ হলো দেশের প্রাথমিক ও ইবতেদায়ী শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতো প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়ে ‘দেখেও না দেখার ভান’ করলেও রবিবার শেষ হওয়া সমাপনীর গণিত পরীক্ষাও অভিযোগ থেকে মুক্ত হতে পারেননি। আগের রাতে ফেসবুকসহ নানা মাধ্যমে পাওয়া প্রশ্ন শতভাগ মিলে গেছে বলে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন অভিভাবকরা। এদিকে গণহারে প্রশ্ন ফাঁস ও শিশুদের ওপর পরীক্ষার বোঝা নিয়ে উদ্বেগ যেমন বাড়ছে তেমনি প্রশ্ন উঠেছে শিক্ষানীতির বাইরে গিয়ে পঞ্চম শ্রেণীর শিশুদের ওপর পাবলিক পরীক্ষার বোঝা চাপানো নিয়ে। খোদ শিক্ষাবিদরাই প্রশ্ন তুলেছেন এহেন পরীক্ষার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে। বলেছেন, অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক স্তর হলে পঞ্চম শ্রেণীতে সমাপনী পরীক্ষার কোন মানে থাকে না। এখন সময় হয়েছে শিশুদের নিয়ে ‘এক্সপেরিমেন্ট‘ বন্ধ করার। শিক্ষণ পদ্ধতি ও মূল্যায়ন সম্পর্কে জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে, শিশুর সৃজনশীল চিন্তা ও দক্ষতার প্রসারের জন্য সক্রিয় শিক্ষণ পদ্ধতি অনুসরণ করে শিক্ষার্থীকে এককভাবে বা দলগতভাবে কার্য সম্পাদনের সুযোগ দেয়া হবে। ফলপ্রসূ শিক্ষাদান পদ্ধতি উদ্ভাবন, পরীক্ষণ ও বাস্তবায়নের জন্য গবেষণায় উৎসাহিত করা হবে এবং সেজন্য সহায়তা দেয়া হবে। আর মূল্যায়নের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে ধারাবাহিক মূল্যায়ন এবং তৃতীয় থেকে সকল শ্রেণীতে ত্রৈমাসিক, অর্ধবার্ষিক ও বার্ষিক পরীক্ষা চালু থাকবে। পঞ্চম শ্রেণী শেষে উপজেলা/পৌরসভা/থানা (বড় বড় শহর) পর্যায়ে সকলের জন্য অভিন্ন প্রশ্নপত্রে সমাপনী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। অষ্টম শ্রেণী শেষে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা নামে একটি পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে এবং এই পরীক্ষা সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ড দ্বারা পরিচালিত হবে। শিক্ষানীতি প্রণয়নকারী শিক্ষাবিদরা হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, যেখানে সরকার শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে ধাপে ধাপে সেখানে নীতিবহির্ভূতভাবে কিভাবে পঞ্চম শ্রেণীর কোমলমতি শিশুর ওপর পাবলিক পরীক্ষার বোঝা চাপাচ্ছেন? বরং শিক্ষানীতি অনুসারে পঞ্চম শ্রেণীতে মেধা মূল্যায়নের জন্য উপজেলা ভিত্তিতে বা বিদ্যালয়েই একটি পরীক্ষা নেয়া যেতে পারে। তবে শিক্ষানীতি ও শিক্ষাবিদদের সুপারিশ অনুসারে কাজ চলছে একথা আর বলা যাচ্ছে না। সুপারিশ বাস্তবায়ন নয় বরং দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের নামে চলা অব্যাহত পরীক্ষা-নিরীক্ষার চক্রে আটকে রাখা হচ্ছে শিশুদের। শিশুদের সক্ষমতার কথা বিবেচনা না করে চাপিয়ে দেয়া একের পর এক পরীক্ষা আর বিশাল পাঠক্রমের চাপে তাদের মেধাবী করে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যই ভেস্তে যাওয়ার দশা। তার পরও ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে একের পর এক পরীক্ষার বোঝা। দেশব্যাপী ভর্তিযুদ্ধের উৎকণ্ঠা তো আছেই, তার ওপর মেধার মূল্য দিতে প্রথম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত দফায় দফায় পরীক্ষা আর ‘এক্সপেরিমেন্ট’র বিষয়বস্তুতে পরিণত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় দুটি সাফল্যের দাবি করলেও এসএসসির আগেই পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে শিশুদের দুটি পাবলিক পরীক্ষার মুখোমুখি করা নিয়ে অসস্তোষ বাড়ছেই শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মাঝে। পরীক্ষার বোঝা নিয়ে ক্ষোভের মধ্যে যুক্ত হয়েছে পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা। প্রশ্ন উঠেছে, এভাবে প্রশ্ন যদি পাওয়াই যায় তাহলে এ পরীক্ষার মানে কি? এর আগে গত রবিবার থেকে শুরু হওয়া প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীর বাংলা ও ইংরেজী পরীক্ষার আগে হুবহু প্রশ্ন পাওয়া যাওয়ার খবর গণমাধ্যমে ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমসহ বিভিন্ন পর্যায়ে সমালোচনা হচ্ছে। তবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এ ধরনের সংবাদকে প্রথম থেকেই ‘গুজব’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে। আর এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার কোন জেলাতেই প্রশ্ন ফাঁসের প্রমাণ পাওয়া যায়নি দাবি করে বলেছেন, প্রশ্ন ফাঁস হলে তার দায় তিনি নিজের কাঁধে নেবেন। এর আগে অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের সমাপনীতেও বিভিন্ন বিষয়ের প্রশ্ন আগেই ফেসবুকে প্রকাশের খবর পাওয়া যায়। এসব ঘটনায় দেশের বিভিন্নস্থানে কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়। প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে সরকারকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, পাড়ার ফটোকপির দোকান ও কোচিং সেন্টারগুলো থেকে সাজেশন আকারে আগাম প্রশ্ন পাওয়া গেছে। পরীক্ষার শেষদিন রবিবার ছিল গণিত পরীক্ষা। আবারও দেখা গেল, আগের রাতে পাওয়া প্রশ্ন আর মূল প্রশ্ন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এক। রবিবারও দেশজুড়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ছিল অভিভাবকদের মুখে মুখে। তাঁরা অভিযোগ করেছেন, সাজেশন আকারে পরীক্ষার আগে যেসব প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে এর সঙ্গে অনেকখানি মিল রয়েছে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের। অভিভাবকদের সংগঠন অভিভাবক সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নীপা সুলতানা রবিবার পরীক্ষা শেষে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছিলেন, এভাবে পরীক্ষা নেয়ার মানে কি? শনিবার রাতে আমরা যে প্রশ্ন ফেসবুকে পেয়েছি তার সঙ্গে দেখা গেল আসল প্রশ্নের শতভাগ মিল। দেশজুড়েই অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে পঞ্চম শ্রেণীর পরীক্ষাটি। শিশুদের নিজ প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্য এলাকায় নিয়ে বিশাল এ পরীক্ষর মুখোমুখি করায় তাদের ওপর অকারণেই চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ পরীক্ষার সনদ যেহেতু তাদের যথাক্রমে ষষ্ঠ ও নবম শ্রেণীতে ভর্তির মাপকাঠি সেহেতু পরীক্ষা তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতি আতঙ্ক বাড়িয়ে দিচ্ছে। এ পরীক্ষার ভয় শিশুদের স্কুলের প্রতি অনাগ্রহী করে তুলতে পারে বলে মনে করেন তাঁরা। যাঁরা শিক্ষা দেন সেই শিক্ষকরাও একের পর এক পরীক্ষা আয়োজনকে ভালভাবে গ্রহণ করছেন না। অনেক শিক্ষকই একে শিশুদের ওপর অতিরিক্ত বোঝা চাপানোর পদক্ষেপ বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু সরকারের উদ্যোগ বলে সমালোচনা করে কিছু বলারও সাহস পাচ্ছেন না অনেক শিক্ষক। রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজ, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এ্যান্ড কলেজ এবং গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলের একাধিক শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলে তাঁরা বলেন, আমাদের মনে হয় অনেক সিদ্ধান্তই নেয়া হচ্ছে পরিকল্পনা ছাড়া। কারণ সরকারের শিক্ষানীতিতে যদি অষ্টম শ্রেণী পর্যন্তই প্রাথমিক শিক্ষা হয় তা হলে পঞ্চম শ্রেণীতে তো আর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা নেয়া যাবে না। অব্যাহত পরীক্ষার চাপ সামাল দিতে শিশুরা গাইড বই এবং প্রাইভেট টিউশনির দিকে আরও বেশি ঝুঁকে পড়ছে বলে অভিমত প্রকাশ করলেন তাঁরা। শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মোঃ আখতারুজ্জামান বলছিলেন, প্রশ্ন ফাঁস চরম শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এর বিরুদ্ধে কড়া আইনী ব্যবস্থা জরুরী। অপরাধ অপরাধই। তবে যেসব অভিভাবক ফাঁস হওয়া প্রশ্ন শিশুদের হাতে তুলে দিচ্ছেন তাঁরাও ভুল করছেন, নিজেদের সন্তানের ক্ষতি করছেন। প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের দিক থেকে এড়িয়ে গেলে হবে না। এটা তো আর ভিন্ন গ্রহ থেকে এসে করে যায়নি। এটা ঘটেছে এটাই সত্য। তাই অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর এ্যাকশন জরুরী। তিনি পরীক্ষা নেয়াকে ভাল মনে করলেও বলছেন, এভাবে প্রশ্ন ফাঁস হলে পরীক্ষা প্রশ্নের মুখে পড়বেই। শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শেখ ইকরামুল কবীর বলছিলেন, শিক্ষানীতিতে যেহেতু অষ্টম শ্রেণীতে পাবলিক পরীক্ষার কথা বলা হয়েছে তাই সেভাবে এগোনই ভাল ছিল। পঞ্চম শ্রেণীতে উপজেলা ভিত্তিতে একটি পরীক্ষা হতে পারত। এভাবে শিশুদের দিয়ে পাবলিক পরীক্ষা নেয়া ঠিক হয়নি। তাছাড়া প্রশ্ন ফাঁস পরীক্ষাকে আরও বিতর্কিত করে ফেলেছে। এখন সময় হয়েছে নতুন করে ভাবার। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেছেন, দেশের শিক্ষা ও পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে এবার ভাবার সময় হয়েছে। পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা বাতিল করার সুপারিশ করে তিনি বলেন, অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে। একই সময়ে যেহেতু একটি পাবলিক পরীক্ষা হচ্ছে তাহলে শিশুদের জন্য পঞ্চম শ্রেণীতে এভাবে একটা পরীক্ষা নেয়ার মানে হয় না।
×