ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রতিন সংস্থার হিসেব তিন রকম- সিটি কর্পোরেশনের মতে ৩৮ বর্গ কিমি, রাজউক বলছে ১৬৮৩ আর পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে ১৪৬ বর্গ কিমি ;###;ড্যাপ ও এসটিপি বাস্তবায়ন নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি;###;আশপাশের পাঁচ জেলাকেও ঢাকা বলছে এসটিপি

স্বাধীনতার ৪৩ বছরেও সীমানা নির্ধারণ হয়নি ॥ ঢাকা কত বড়

প্রকাশিত: ০৪:৩১, ২ ডিসেম্বর ২০১৪

স্বাধীনতার ৪৩ বছরেও সীমানা নির্ধারণ হয়নি ॥ ঢাকা কত বড়

মশিউর রহমান খান ॥ স্বাধীনতার ৪৩ বছরেও আজও নির্ধারিত হয়নি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার সীমানা। দীর্ঘদিনেও সরকারের কোন সংস্থাই ঢাকার প্রকৃত আয়তন নির্ধারণ না করায় প্রতিবছরই ঢাকার সীমানা বেড়েই চলেছে। আজ পর্যন্ত আয়তন বা সীমানা নিয়ে কোন প্রজ্ঞাপন জারি বা এ সংক্রান্ত কোন নির্দেশনা জারি হয়নি। একেকটি আদমশুমারি শেষ হলেই বাড়ে ঢাকার সীমানা। এছাড়া ঢাকার সীমানা নিয়ে সরকারের একেক সংস্থার সংজ্ঞা একেক রকম। আয়তন নিয়ে এক সংস্থার সঙ্গে অন্য সংস্থার কোন মিল নেই। প্রতিটি সংস্থার ঢাকার সীমানায় রয়েছে বিশাল ফারাক। সংবিধানে রাজধানী শহরের সীমানা নির্ধারণের কথা স্পষ্ট করে বলা থাকলেও রাজধানীর সীমানা নির্ধারণে কোন সরকারই গুরুত্ব দেয়নি। ফলে ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের জেলাগুলো প্রতিনিয়ত ঢাকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাচ্ছে। আর সঠিক আয়তন নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে ঢাকার চারদিকের পাঁচ জেলা। রাজধানী ঢাকার আয়তন নির্ধারণ নিয়ে জনমনে যাতে কোন প্রকার বিভ্রান্তির সৃষ্টি না হয় সে লক্ষ্যে সংবিধানের ৫ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে যে, প্রজাতন্ত্রের রাজধানী ঢাকা। রাজধানীর সীমানা আইনের দ্বারা নির্ধারিত হইবে। তবে স্বাধীনতার ৪৩ বছরেও সংবিধানের এ নির্দেশ মানেনি কোন সরকারই। রাজধানীর সীমানা বা আয়তন নির্ধারিত করার বিষয়ে এ পর্যন্ত সকল সরকারই ছিল পুরো উদাসীন। আজ পর্যন্ত এ সম্পর্কে কোন আইন প্রণয়ন না করায় ঢাকার সীমানা আজও অনির্ধারিতই রয়ে গেছে। ফলে একেক সংস্থা একেকভাবে ঢাকার সীমানা ধরে নিচ্ছে। প্রতিনিয়ত ব্যাহত হচ্ছে রাজধানীকে নিয়ে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর কোন রাজধানীরই ঢাকার মতো দুরবস্থা নেই। সীমাহীন এলাকা নিয়েই যেন রাজধানী শহর ঢাকার অবস্থান। নারায়ণগঞ্জ, জয়দেবপুরকেও বর্তমানে ঢাকা বলা হচ্ছে। রাজউকের তৈরি ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানে (ড্যাপ) ঢাকা বলতে রাজউকের ঢাকাকে বিবেচনা করা হয়েছে। মেট্রোপলিটন সিটি ঢাকার সঙ্গে সাভার ও নারায়ণগঞ্জ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তবে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনাতে (এসটিপি) রাজউকের এলাকার সঙ্গে গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও নরসিংদীর আংশিক যুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ এসটিপির পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত এলাকায় পাঁচটির বেশি জেলা রয়েছে। ফলে দুই সংস্থার ড্যাপ ও এসটিপির ২ মহাপরিকল্পনার মধ্যে সমন্বয় করা কঠিন হয়ে পড়েছে। সংজ্ঞানুযায়ী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়ে। বর্তমানে ঢাকার ভিন্ন সীমানা নিয়ে পৃথক পৃথক সংস্থা কাজ করলেও সুফল সাধারণ জনগণ পাচ্ছে না। রাজধানী ঢাকার আয়তন নিয়ে সরকারের তিনটি সংস্থার হিসাব তিন রকম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ আদমশুমারি বলছে, ১ হাজার ৪৬০ বর্গকিলোমিটার। কিন্তু সিটি কর্পোরেশনের হিসাবে ঢাকা তুলনামূলক এখনও অনেক ছোট। ২০১৩ সালে কামরাঙ্গীরচরের কয়েকটি ইউনিয়ন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মোট আয়তন দাঁড়িয়েছে ৩৮০ বর্গকিলোমিটার। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অধিভুক্ত ঢাকা ও আশপাশের এলাকা নিয়ে আয়তন আবার ১ হাজার ৬৮৩ দশমিক ৫ বর্গকিলোমিটার। সূত্র জানায়, প্রতিবার আদমশুমারি শেষে দেখা গেছে রাজধানী ঢাকার আয়তন আগের তুলনায় বেড়েছে। তথ্যানুযায়ী স্বাধীনতার পূর্বে ১৯৫১ সালে পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকার আয়তন ছিল মাত্র ২৮ বর্গমাইল (৭২ দশমিক ৫২ বর্গকিলোমিটার)। ১৯৬১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯০ দশমিক ৬৫ বর্গকিলোমিটারে। আর স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে ঢাকা বলতে শুধু ঢাকা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন এলাকাকেই বিবেচনা করা হতো। এ সময় ঢাকার সীমানা দাঁড়ায় ১০৩ দশমিক ৬ বর্গকিলোমিটার। পরবর্তীতে ১৯৮১ সালে ঢাকার আয়তনে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। ঐ বছর বিবিএস আদমশুমারির সময় স্ট্যাটিস্টিটিক্যাল মেট্রোপলিটন এলাকা ধারণার সূত্রপাত। এতে ঢাকা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন ছাড়াও ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড, টঙ্গী পৌরসভা, নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা, উত্তরখান, দক্ষিণখান, বেরাইদ, সাঁতারকুল, ডেমরা, শ্যামপুর, মাতুয়াইল, সিদ্ধিরগঞ্জ, আদমজীনগর, ফতুল্লা, কেরানীগঞ্জ, আমিনবাজার, সাভার ও তৎসংলগ্ন এলাকা ঢাকার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়। স্ট্যাটিস্টিটিক্যাল মেট্রোপলিটন এলাকা হিসেবে ঢাকার আয়তন দাঁড়ায় ১ হাজার ১২০ দশমিক ৮ বর্গকিলোমিটার। ২০১১ সালের বিবিএসের সর্বশেষ আদমশুমারি হিসাবে ঢাকার আয়তন আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৪৬০ বর্গকিলোমিটারে। রাজউকের হিসাবেও ঢাকার আয়তন আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। ১৯৫৬ সালে তৎকালীন ডিআইটি প্রণীত স্ট্রাকচারাল ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানে ঢাকার আয়তন ধরা হয় ২৪০ বর্গমাইল বা ৬২১ দশমিক ৬ বর্গকিলোমিটার। ১৯৮৭ সালে ডিআইটি রাজউকে রূপান্তরিত হয়। তখন রাজউকের অধিভুক্ত ঢাকার আয়তন দাঁড়ায় ৬৫০ বর্গমাইল বা ১ হাজার ৬৮৩ দশমিক ৫ বর্গকিলোমিটার। এ সময়, কামরাঙ্গীরচর, কেরানীগঞ্জ, মিরপুর, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের আংশিক ঢাকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে সিটি কর্পোরেশনের হিসেবে ঢাকার আয়তন মাত্র ৩৮০ বর্গকিলোমিটার। বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজধানী ঢাকার আয়তন নির্দিষ্ট না হওয়ায় এর জনসংখ্যা কত বা জনসংখ্যার ঘনত্ব কত, তাও নির্ধারণ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে ঢাকা নিয়ে সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়ন কঠিন হয়ে পড়েছে। এছাড়া পরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়ন করাও সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া রাজধানীর উন্নয়নে সরকার বৃহৎ কোন প্রকল্প হাতে নিলেও সঠিক সীমানা নির্ধারণ না থাকায় বা ভিন্ন ভিন্ন সংস্থার হিসাব ভিন্ন আয়তন ও জনসংখ্যা হওয়ায় প্রকল্পের সাফল্য তেমন আসে না। সিটি কর্পোরেশন এলাকা বিবেচনা করলে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ঢাকায় ৪১ হাজারের বেশি মানুষ বাস করে। আর রাজউকের ঢাকা হিসাব করলে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ১০ হাজার মানুষ বাস করে। এতে প্রকৃত তথ্য নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা। তাছাড়া রাজধানীর সীমানা জটিলতার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দাতা সংস্থাও উন্নয়ন কাজে অর্থায়ন করতে বা সাহায্য প্রদানে অনেক সময় দ্বিধাবোধ করে। সূত্র জানায়, রাজধানী ঘিরে বিভিন্ন সরকারের আমলে কয়েকটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করে। এটি বাস্তবায়নেও অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সীমানা জটিলতা। উল্লেখ্য, রাজধানী ও আশপাশের জেলার যানজট নিরসনে ১০ বছর আগে প্রণয়ন করা হয় কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি)। এটি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। আর ঢাকার অবকাঠামোগত উন্নয়নে ২০১০ সালে ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) প্রণয়ন করে রাজউক। এ দুই মহাপরিকল্পনায় ঢাকার আয়তন ও জনসংখ্যা নিয়েও রয়েছে জটিলতা। ফলে ড্যাপ ও এসটিপির মধ্যে কখনই সমন্বয় করা যায়নি। ড্যাপে ঢাকার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয় নারায়ণগঞ্জ ও সাভার। আর এসটিপিতে ঢাকা বলতে মূল ঢাকা শহরসহ পার্শ্ববর্তী পাঁচটি জেলাকে বিবেচনা করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জ। এর সঙ্গে নরসিংদী জেলারও একটি অংশকে ঢাকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এসটিপিতে এ এলাকাকে বৃহত্তর ঢাকা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সদস্য (উন্নয়ন) নাঈম আহমেদ খান বলেন, রাজধানী শহর হিসেবে ঢাকার অবশ্যই একটি সীমানা নির্ধারণ ও নির্দিষ্ট আয়তন থাকা জরুরী। বিশ্বের প্রতিটি রাজধানী শহরের সীমানা নির্ধারণ করা থাকলেও ঢাকার কোন সীমানা বা আয়তন নেই। স্বাধীনতার এত বছর পেরিয়ে গেলেও তা করা সম্ভব হয়নি। ফলে কোনমতেই বোঝার উপায় নেই কোন্্ স্থানটি ঢাকা ও কোন্্টি ঢাকার বাইরের এলাকা। এছাড়া সময়ের প্রয়োজনে রাজধানীর সীমানা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ফলে সিটি কর্পোরেশনসহ একেকটি সংস্থা সীমানা নিয়ে একেকভাবে ঢাকার সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে দেখা যাচ্ছে। রাজধানীবাসীর উন্নয়ন তথা সার্বিক কল্যাণমূলক কাজ সঠিক বাস্তবায়ন কাজ সীমানা ও আয়তনের ওপরই নির্ভর করে। ঢাকা শহরের আশপাশের জেলাগুলো থেকে ঢাকাকে অবশ্যই অতি দ্রুত আলাদা করা প্রয়োজন। সীমানা নির্ধারণের মাধ্যমে রাজধানী হিসেবে বহির্বিশ্বের কাছে ঢাকার অবস্থান বর্তমানের চেয়ে আরও সুদৃঢ় হবে। তবে রাজউক অন্যান্য সংস্থার চেয়ে আলাদা। রাজউক নাগরিকদের স্বার্থে সুষ্ঠু নগরায়ন তথা পরিকল্পিত নগরায়নের স্বার্থে ঢাকা ও তার আশপাশের জেলাগুলোর বেশ কিছু অংশকে ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) অন্তর্ভুক্ত করেছে। তবে অবশ্যই রাজধানীর উন্নয়নে রাজউক চায় এর সুনির্দিষ্ট সীমানা নির্ধারণ করা। এটি না থাকায় আমাদের কাজেও ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অতি দ্রুত আলোচনা করা হবে। তবে এ জন্য সরকারের সর্বোচ্চ মহলের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে প্রশাসনিক নির্দেশনায় সীমানা নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
×