ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বেনাপোলে আমদানি রফতানি বাণিজ্যে ধস

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২৭ নভেম্বর ২০১৪

বেনাপোলে আমদানি রফতানি বাণিজ্যে ধস

স্টাফ রিপোর্টার, বেনাপোল ॥ বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের পণ্য ছাড়করণের বেলায় কাস্টমসের শীর্ষ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা উৎকোচ গ্রহণের হার নিজেরাই নিজেদেরটা নির্ধারণ করে নিয়েছেন। আর এই হার পণ্যের আকার ভেদে বিভিন্ন রকম। যেমন আমদানিকৃত সিনথেটিক শাড়িতে উৎকোচের হার কেজিতে ২০ টাকা, থ্রী পিচে ১৫ টাকা, শাটিং শুটিং ও ফেব্রিক্স (কাপড়) এর বেলায় কেজিতে ১১ টাকা, মোটর পার্টস আমদানিতে ৯ টাকা। উৎকোচ গ্রহণে এরকম হার নির্ধারণ করার পর থেকেই গোটা বন্দরের সামগ্রিক আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব শুরু হয়েছে। কাস্টমসের শীর্ষ কর্মকর্তাসহ তার অধস্তন সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাও এই পরিস্থিতির সুযোগে শুরু করেছে উৎকোচ গ্রহণের মচ্ছব। জানা গেছে, এরকম উৎকোচ গ্রহণের ফলশ্রুতিতে দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল দিয়ে সামগ্রিক আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে ধস নেমেছে; রাজস্ব আয় চরম হতাশাজনক। বেনাপোল কাস্টমস হাউস প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ যাবত এরকম বিপর্যয় ইতোপূর্বে আর দেখা যায়নি। এই চরম বিপর্যয়ের জন্য এখানকার ব্যবসায়ীরা এককভাবেই দায়ী করেছেন কাস্টমস হাউসের মহা দুর্নীতিবাজ হিসেবে পরিচিত পাওয়া শীর্ষ কর্মকর্তা ব্যক্তিটিকে। বেনাপোল বন্দর এলাকার বিভিন্ন কার্যক্রম সরেজমিন ঘুরে দেখে এই সত্যটিই বার বার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ব্যবসায়ী সূত্রের অভিযোগ, বেনাপোল কাস্টমস হাউসের বর্তমান শীর্ষ কর্তাটি বড়ই গুণধর; উৎকোচ গ্রহণে পারদর্শী বটে। আমদানিকৃত পণ্য ছাড়করণ ফাইলে তার অনুমোদন স্বাক্ষরের বেলায় তাকে উচ্চহারে উৎকোচ দিতে হয়। অন্যথায় ফাইল টেবিলের ডয়ারে আটক থাকে। উৎকোচ হার তথাকথিত স্পীড মানির বেলায়। আর শুল্ক চুরির ফাইল হলে তো পোয়া বারো। আর এসব কারণে এই বন্দরের ব্যবসা-বাণিজ্য এখন লাঠে উঠার উপক্রম হয়েছে। সূত্রমতে, রাজধানী ঢাকা এখন বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ নগর; জনবসতি এখন এই শহরে ৩ কোটির উপরে। পৃথিবীর অনেক দেশ আছে যেখানে গোটা দেশেই ৩ কোটি মানুষ নেই। এই ঢাকায় পানির চাহিদা কত? এই বিপুল পানি চাহিদা ব্যবস্থাপনার জন্য পানির পাইপ ফিটিং প্রতিদিন লাগে কয়েক লাখ। পাইপ ফিটিং চাহিদার সিংহভাগ আসে ভারত থেকে বেনাপোল বন্দর দিয়ে। র্র্র্র্৮র্ ব্যাসার্ধের নিচে পাইপের শুল্ক হার ২৫% হলেও তিনি ছাড়ছেন ২% শুল্কায়নে। এই স্টেইনার ফিল্টার শুল্কায়ন হেড ৮৪.২১ যার শুল্ক ২৫% অথচ শুল্কায়ন গ্রুপ-৪ এর রাজস্ব কর্মকর্তা ও সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তাবৃন্দ এখানকার শীর্ষ কর্মকর্তার নির্দেশে নিম্নহারের শুল্কায়নে ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এভাবে বহু পণ্য খাতের উদাহরণ দেয়া যাবে; যেমন স্টেশনারিজ পণ্য খাতে ৫ লাখ ডলার মূল্য পর্যন্ত ২% শুল্ক হলেও উর্ধমূল্যের পণ্যে ১২%, ২৫% শুল্ক এর বেলায় তিনি শুল্ক নির্ধারণ করেছেন ২% এ ভাবে বহু খাতেই শুল্ক চুরির মহোৎসব চলছে গুণধর এই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার নির্দেশে। সত্যিই এ এক অভাবনীয় ঘটনা; এরকম বেনাপোল কাস্টমস হাউসে ইতোপূর্বে আর এরকমটি দেখা যায়নি। তার এই শুল্ক চুরির মহোৎসবের পাশাপাশি বৈধভাবে পণ্য ছাড় করতে ইচ্ছুক ব্যবসায়ীদের ওপর চলছে খড়গ নির্যাতন। এই খড়গ বেশি মাত্রায় চালান দুজন গুণধর সহকারী কমিশনার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে এই দুই সহকারী কমিশনারকে অন্যত্র বদলি করা হলেও ওই শীর্ষ কর্তার অনুরোধে তাদের বদলি স্থগিত করা হয়েছে। এই দুই ব্যক্তি শুল্ক চুরির পণ্য আটক করেন এবং এরপর শুল্ক চোররা কানেক্ট হয়ে যান শীর্ষ কর্তার সঙ্গে; অভিনব কৌশল বটে। বেনাপোল কাস্টমস হাউসের অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও উৎকোচ গ্রহণে কেউ কারও চেয়ে কম নন। বৈধভাবে আমদানি পণ্যেও স্পীড মানির (দ্রুত কাজকরণ অর্থ) নামে মোটা টাকা গুনতে হয় টেবিলে টেবিলে। পণ্যের চালান মাফিক এই হার নির্ধারণ করা আছে। রাজস্ব কর্মকর্তা, সহকারী কমিশনার, যুগ্ম কমিশনার সকলেই স্পীড মানির নামে নির্ধারিত হারে চাঁদা আদায় অব্যাহত রেখেছেন বলে এখানকার ব্যবসায়ীদের অভিযোগ। উৎকোচের বিনিময়ে শুধু চুরি করা যাবে তবে বৈধভাবে নিচ্ছে শুল্কহারে পণ্য ছাড় নেয়ার সুযোগ থাকলেও এসব কসাই কর্মকর্তারা তা ছাড়েন না, ফলে এই বন্দর ব্যবহারকারী ব্যবসায়ীরা দিন দিন এই বন্দর ছেড়ে অন্য স্থলবন্দর যেমন ভোমরা, সোনামসজিদসহ সুবিধাজনক স্থলবন্দরে চলে যাচ্ছে। ফলে আগে এই বন্দরে যেখানে প্রতিদিন ভারত থেকে কমপক্ষে ৫ শতাধিক পণ্যবাহী গাড়ি ঢুকত সেখানে এখন দিনে ২শ’ গাড়িও ঢুকছে না। বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে যে পণ্যগার অবকাঠামো গড়ে তুলেছে তার অধিকাংশ গুদাম এখন পণ্য শূন্যতায় খাঁ খাঁ করছে। এ প্রসঙ্গে ননটেকার হিসেবে খ্যাতি পাওয়া এখানকার দুই সহকারী কমিশনারের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আছে। এ নিয়ে এখানকার ব্যবসায়ীদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তারা বলেছেন এই দুজন ব্যক্তি বিশেষ করে কাস্টমসের স্পেশাল এসাইড গ্রুপ (স্যাগ) এর দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী কমিশনার যিনি ননটেকার হিসেবে পরিচিত পেলেও দুটি চিহ্নিত সিএ্যান্ডএফ এজেন্সিকে নিয়মিত সুবিধাদি প্রদান করে যাচ্ছেন। যেন ইতোপূর্বে ননটেকার হিসেবে পরিচিত স্যাগ দায়িত্বপ্রাপ্ত জনৈক সহকারী কমিশনার অপর একটি চিহ্নিত সিএ্যান্ডএফ এজেন্সিকে সুবিধাদি দিয়ে গেছেন। অভিযোগে জানা গেছে, শীর্ষ কর্মকর্তাসহ বেনাপোল কাস্টমস হাউসের সকল পর্যায়ের কর্মকর্তাদের এরকম ফ্রী স্টাইল উৎকোচ গ্রহণের ফলে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে চলতি অর্থবছরে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য অনেক নিচে নেমে গেছে। সূত্র বলেছে, বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ২০১৩-১৪ অর্থবছরের তুলনায় চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে এক হাজার ৩০ দশমিক ১৮০ টন পণ্য কম আমদানি হয়েছে। এর কারণ হিসেবে ব্যবসায়ী মহল দায়ী করেছেন কাস্টমস কর্মকর্তাদের। আর কর্মকর্তারা দায়ী করেন ব্যবসায়ীদের। উল্লেখ্য, গত অর্থবছর এই বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি হয়েছিল এক লাখ ৭৪ হাজার ৭৪৭ দশমিক ৬৩ টন। আর চলতি অর্থবছরে আমদানি হয়েছে এক লাখ ৭৩ হাজার ৭১৭ দশমিক ৪৫০ মে. টন পণ্য। কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন, গত অর্থবছরে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব এখনও ব্যবসায়ীদের মধ্যে রয়েছে। এছাড়া কাস্টমস কর্মকর্তারা নজরদারি বাড়ানোর কারণে পণ্য আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তবে ব্যবসায়ীদের দাবি, দেশে এখন স্বাভাবিক অবস্থা থাকলেও ব্যবসায় মন্দাভাব বিরাজ করছে। এতে আমদানি করা পণ্য এনে বিক্রি করা যাচ্ছে না। সেই সঙ্গে বন্দর শেড থেকে মাল চুরি, কাস্টমসের হয়রানির কারণে অনেকে এ বন্দর ছেড়ে অন্য বন্দরে চলে যাওয়ায় বেনাপোল দিয়ে পণ্য আমদানি কমে গেছে। বেনাপোল কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, গত অর্থবছরের (২০১৩-১৪) জুলাই মাসে দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোল দিয়ে পণ্য আমদানি করা হয় ৭১ হাজার ২৫৫ দশমকি ৪১ টন পণ্য। যার মূল্য ছিল এক হাজার ৮৪ কোটি টাকা। আগস্টে আমদানি হয়েছিল ৭১৩ কোটি টাকার ৩৯ হাজার ৭৮৬ দশমিক ২৮ টন পণ্য। সেপ্টেম্বর মাসে আমদানি হয়েছিল এক হাজার ৫ কোটি টাকার ৬৩ হাজার ৪৭ দশমিক ৯৯ টন পণ্য। অক্টোবর মাসে ৯০৯ কোটি ২৪ লাখ টাকার ৫৭ হাজার ৩৫৭ দশমিক ৯৮ টন পণ্য আমদানি করা হয়। আর চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জুলাই মাসে আমদানি হয়েছে এক হাজার ২৪ কোটি টাকার ৫৫ হাজার ৭৮১ দশমিক ৮৯ মেট্রিক টন পণ্য। আগস্টে হয়েছে এক হাজার আট কোটি টাকার ৫ হাজার ৬৩৮ দশমিক ১৩ টন পণ্য। সেপ্টেম্বর মাসে আমদানি হয়েছে এক হাজার ৮৬ কোটি টাকার প্রায় ৬৩ হাজার টন পণ্য এবং অক্টোবর মাসে ৯০১ কোটি ৪১ লাখ টাকার ৪৯ হাজার ৫৬৪ দশমিক ২৭ টন পণ্য। এ ব্যাপারে যশোর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মিজানুর রহমান খান বলেন, ‘ব্যাংকের উচ্চ সুদ, বন্দর থেকে মালামাল চুরি, কাস্টমসের হয়রানিসহ বিভিন্ন কারণে অনেক আমদানিকারক বেনাপোল ছেড়ে অন্য বন্দরে চলে গেছেন। যে কারণে দিন দিন বেনাপোল থেকে মালামাল আমদানি কমে যাচ্ছে। এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে বেনাপোল কাস্টমস হাউসের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করা শর্তে সাংবাদিকদের কাছে বলেছেন, যেখানে শুল্ক আদায় হয় সেখানে দুর্নীতি হবে এটাই সত্য। তবে যে সব শুল্ক চুরির অভিযোগ করা হচ্ছে তা সঠিক নয়।
×