ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মনোযোগ কাড়ছে ঢাকা জাদুঘর

মুদ্রার গায়ে খোদাই করা ইতিহাস নোটে সমাজ সংস্কৃতি

প্রকাশিত: ০৫:১২, ২৩ নভেম্বর ২০১৪

মুদ্রার গায়ে খোদাই করা ইতিহাস নোটে সমাজ সংস্কৃতি

মোরসালিন মিজান ॥ টাকা কি গাছে ধরে? বহু পুরনো প্রশ্ন। উত্তরÑএকদমই না। গাছে ধরে না টাকা। যদি ধরত! কেমন দেখতে হতো টাকার গাছ? চারপাশে এত যে ‘টাকা টাকা’, এর শুরুটাইবা কবে থেকে? পয়সাপাতি না হলেই নয়। পয়সাপাতির ইতিহাসটা কী? বাংলার টাকা কড়ি আর বিদেশী টাকা কড়ির মধ্যে মিল অমিল কতটা? টাকার গায়ে কী ইতিহাস খোদাই করা থাকে? কেমন সে ইতিহাস? হ্যাঁ, অসংখ্য প্রশ্ন। তবে উত্তর মিলছে খুব সহজেই। চমৎকার উত্তর করছে টাকা জাদুঘর। এখানে প্রাচীন বাংলার মুদ্রা থেকে শুরু করে আছে আজকের দিনের কড়কড়ে নোট। বাইরের দেশের বিভিন্ন মূল্যমানের মুদ্রা ও নোট আছে। সুন্দর সাজানো। দেখতে দেখতে টাকা কড়ি নয় শুধু, আরও কত কী যে দেখা হয়ে যায়! টাকা জাদুঘর বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগ। প্রথমে ছোট্ট পরিসরে এটি ছিল মতিঝিলের প্রধান কার্যালয়ে। আরও জনগণের করতে এটি স্থানান্তর করা হয় মিরপুরের বাংলাদেশ ব্যাংক ট্রেনিং একাডেমি ভবনে। এর পর থেকে খুব যে দর্শনার্থী, তা নয়। তবে যে বা যিনি একবার এটি ঘুরে দেখেছেন, নিশ্চিত করে বলা যায়, মুগ্ধও হয়েছেন। একেবারে মূল রাস্তা থেকেই দেখা যায় টাকা জাদুঘরের নাম ধাম। দু’কদম এগোলে দৃশ্যমান হয় টাকার গাছটিও! বিভিন্ন সময়ের, দেশ ও কালের মুদ্রা ফলের মতোই গাছে ধরেছে! ভবনের দেয়ালে স্টেনলেজস্টিলে গড়া নান্দনিক এই শিল্পকর্ম স্বাগত জানায় ভেতরে। ভবনের দ্বিতীয় তলায় মূল জাদুঘর। দুটো গ্যালারি নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে। গত বছরের ৫ অক্টোবর এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। এর পর থেকে সকলের জন্য উন্মুক্ত। জাদুঘরের ভেতরে প্রবেশ করলে প্রথমেই চোখে পড়ে একটি পরিপাটি পরিবেশ। বেশ সুন্দর সাজানো গোছানো। আগ্রহ নিয়ে দেখা শুরু হয় ১ নম্বর গ্যালারি থেকে। এখানে বাংলার প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে এই মুহূর্তের বাংলাদেশ। প্রথম শোকেসটি সাজানো হয়েছে বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন মুদ্রা দিয়ে। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে খ্রিস্টাব্দ দ্বিতীয় শতক পর্যন্ত বাংলায় এসব মুদ্রার প্রচলন ছিল। মোট মুদ্রা ৫৪টি। সবই ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রা। অধিকাংশই গোলাকৃতির। জামার বড় বোতামের মতো দেখতে। তবে ৪টি মুদ্রা আর সব থেকে আলাদা। এগুলো বক্র দ-াকৃতির। আঙ্গুলের লম্বা নখের মতো সামান্য বাঁকা। জানা যায়, গান্ধার জনপদের এসব মুদ্রা গ্যালারিতে নতুন সংযোজিত হয়েছে। ২ নম্বর গ্যালারিতে রয়েছে কুষাণ রাজাদের মুদ্রা। এই রাজারা খ্রিস্টীয় প্রথম শতক থেকে দ্বিতীয় শতক পর্যন্ত ভারতে রাজত্ব করেন। রাজাদের মধ্যে ভীমকদফিস, কনিস্ক, হুবিস্ক ও বাসুদেবের সময় মুদ্রিত ও প্রচলিত মুদ্রা শোকেসে স্থান পেয়েছে। ভাল করে তাকালে দেখা যায়, মুদ্রাগুলোতে সম্রাটের ছবি ও দেবদেবীর মূর্তি আঁকা। শোকেসে আরও রয়েছে গ্রীক দেব দেবীর প্রতিচ্ছবি সংবলিত ইন্দো-পার্সিয়ান ও ইন্দো-গ্রীক মুদ্রা। ৩ নম্বর শোকেসে হরিকেল রাজাদের মুদ্রা। আনুমানিক সপ্তম থেকে অষ্টম শতকে প্রাচীন বাংলায় হরিকেল রাজাদের বসবাস ছিল। তবে এই মুদ্রাগুলো কোন ব্যক্তি বা শাসকের নামে করা হয়নি। স্থান বা রাজ্যের নামে মুদ্রিত হয়েছে। মুদ্রাগুলোর একদিকে ত্রিশূল। অপরদিকে হিন্দুদের আদি দেবতা শিবের বাহন নন্দী বা ষাঁড়ের প্রতিকৃতি। গ্যালারির ৪ নম্বর শোকেসটি তুলে ধরছে দিল্লীর সুলতানদের ইতিহাস। এখানে সুলতান আলাউদ্দীন, মাসুদ শাহ, নাসিরউদ্দীন মাহমুদ শাহ, গিয়াসউদ্দীন বলবন, গিয়াসউদ্দীন তুঘলক শাহ, মুহম্মদ বিন তুঘলক, জালাল উদ্দীন ফিরোজ খিলজী, আলা উদ্দীন মুহম্মদ খিলজী, মুইজ উদ্দীন কায়কোবাদসহ ৮ জন সুলতানের সময়ের মুদ্রা। ৫ নম্বর শোকেসে বাংলার স্বাধীন সুলতানদের মুদ্রা। জানা যায়, সিংহাসনে আরোহণ, রাজ্য জয়সহ নানা উপলক্ষে এসব মুদ্রা প্রচলন করেন তাঁরা। ৬ নম্বর শোকেসে আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান, আওরঙ্গজেব, মুহাম্মদ শাহ, আহম্মদ শাহ বাহাদুরসহ কয়েকজনের মুদ্রা। আকবরে মুদ্রাগুলো দেখতে তেঁতুল বিচির মতো। চার কোন। মুঘল আমলের সমসাময়িক কুচবিহারের রৌপ্য মুদ্রা দিয়ে সাজানো হয়েছে ৭ নম্বর শোকেসটি। ৮ ও ৯ নম্বর শোকেস ব্রিটিশ ভারতীয় মুদ্রা। রৌপ্য তাম্র ও মিশ্র ধাতুর মুদ্রা সেই সময়টিকে তুলে ধরছে। ১০ নম্বর শোকেসে পাকিস্তান আমলের মুদ্রা ও কাগজী নোট। এসব নোটে মসজিদ, জিন্নাহর প্রতিকৃতি প্রধান। পাকিস্তান যেমন ভেঙ্গেছে তেমনি বিলুপ্ত হয়েছে অনেক দেশ। নাম বদলেছে কোন কোনটি। তবে টাকা রয়ে গেছে। সেই টাকা ডেব ডেব করে তাকিয়ে আছে ১১ নম্বর শোকেসে। এখানে বর্মা, চেকোশ্লোভাকিয়া, যুগোশ্লোভিয়া, সিলোন, জায়ার, ট্রান্সনেশিয়াসহ প্রায় এক ডজন দেশের কাগজী নোট। কিছু নোট নানা বিবেচনায় দুষ্প্রাপ্য। সেগুলোকে আলাদা করে নিয়ে দেখানো হচ্ছে ১২ নম্বর শোকেসে। এখানে সবচেয়ে বড় কাগজী নোটটি। রাশিয়ার নোট। দৈর্ঘ্য প্রস্থ উভয় দিক থেকেই বড়। আর ছোট নোটটি জার্মানির। আছে মরক্কো, বার্মুদা, বুলগিরিয়া, কাজাকিস্তান, সোলেমন দ্বীপপুঞ্জ, ওমান, কাতারের হাউব্রিড ব্যাংক নোট। এই গ্যালারিতে আছে ৩টি টেবিল শোকেসও। একটি শোকেসে স্বর্ণমুদ্রা চক চক করছে। এগুলো মুঘল সম্রাট শাহজাহান ও সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের শাসনামলে প্রচলিত ছিল। ব্রিটিশ আমলেও প্রচলিত ছিল স্বর্ণমুদ্রা। সেগুলোও এখানে রাখা। টেবিল শোকেসে আরও রয়েছে মুঘল আমলের সমসাময়িক অসম রাজা রুদ্রসিংহ, শিবসিংহ, রাজেশ্বর সিংহ, লক্ষ্মী সিংহ, নরসিংহ ও গৌরীনাথ সিংহের মুদ্রা। ১ নম্বর গ্যালারিতে শোকেস টেবিল শোকেস ছাড়াও আছে ৩টি ডিওরামা। এসবে পণ্য বিনিময় প্রথার বিভিন্ন পর্যায় উপস্থাপন করা হয়েছে। এভাবে দেখা শেষ হয় বাংলা ও বাংলাদেশ পর্ব। এর পর বিদেশের টাকা কড়ি দিয়ে সাজানো ২ নম্বর গ্যালারি। এখানে দেখার শুরুটা হয় ১৩ নম্বর শোকেস দিয়ে। শোকেসের ভেতরে কাঁচা সোনা রং নোট। গোল্ড ফয়েলের তৈরি অনুকৃতি নোটগুলো আমেরকিা, অস্ট্রেলিয়া ও থাইল্যান্ডের। আছে মালয়েশিয়ার স্বর্ণমুদ্রাও। ১৩ নম্বর শোকেসে মোজাম্বিক, কেনিয়া, আইভোরি কোস্ট, বুরুন্ডি বতসোয়ানা, উগান্ডা, রুয়ান্ডা তিউনিসিয়া নাইজিরিয়াসহ কিছু দেশের প্রচলিত মুদ্রা, ব্যাংক নোট ও নমুনা নোট। ১৪ নম্বর শোকেসে আর্জেন্টিনা, পেরু, গুয়েতেমালা, ভেনিজুয়েলা, উরুগুয়ে, ব্রাজিল, ইকুয়েডর, বলিভিয়া, কিউবা, চিলি প্রভৃতি দেশের নোট ও মুদ্রা। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, লুক্সেমবার্গ, জ্যামাইকা, স্কটল্যান্ড, ইউক্রেন, রোমানিয়া, সুইডেনসহ কিছু দেশের নোট দিয়ে সাজানো হয়েছে ১৫ নম্বর শোকেসটি। ১৬ নম্বর শোকেসে ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি, আইসল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস। ১৭ নম্বর শোকেসে রাশিয়া, ইংল্যান্ড, চেক রিপাবলিক, সাইপ্রাস, স্পেন প্রভৃতি দেশের নোট। গ্যালারি পুরোটা দেখা হলে বাইরের দেশের নোট ও মুদ্রা সম্পর্কে ভাল একটি ধারণা হয়ে যায়। আরও যাঁরা জানতে চান, তাঁদের জন্য রয়েছে টাচ স্ক্রিন ডিজিটাল সাইনেজ ও প্রজেক্টর। শেষটাও বেশ মজার। এ পর্যায়ে আছে টাকার সঙ্গে ছবি তোলার ব্যবস্থা। দর্শনার্থীরা চাইলে ১ লাখ টাকার সুভ্যেনির নোটে নিজেদের আবক্ষ ছবি যুক্ত করতে পারেন। কিছু সময় জাদুঘর ঘুরে ক্লান্ত? আছে ছোট্ট কিন্তু সুন্দর একটি কয়েন কাফে। সেখানে হতে পারে গল্প আর হাল্কা খাবার। সব মিলিয়ে অনবদ্য টাকা জাদুঘর। এর কিউরেটর রেজাউল করিম জনকণ্ঠকে বলেন, এটি বিশেষায়িত জাদুঘর। দেশে এমন দ্বিতীয়টি নেই। অনেক পরিকল্পনা করে জাদুঘরটি গড়া হয়েছে। শহরের শেষ প্রান্তে হলেও, এখানে এসে যথেষ্ট কৌতূহল নিয়েই টাকা ও মুদ্রা দেখছেন দর্শনার্থীরা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন। বিশেষ করে আশপাশের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা নিয়মিত আসছে। টাকা ও মুদ্রা দেখার পাশাপাশি তারা সে সময়ের ইতিহাস সমাজ জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারছে। দর্শনার্থী প্রতিনিয়ত বাড়ছে জানিয়ে তিনি বলেন, এখন প্রতিদিন প্রায় ২০০ দর্শনার্থী জাদুঘর পরিদর্শন করছেন। অচিরেই জাদুঘরটি রাজধানীবাসীর মনোযোগ আকর্ষণ করতে হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
×