ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সড়ক দুর্ঘটনায় লাশের মিছিল কিছুতেই থামছে না ॥ বছরে ১২ থেকে ২০ হাজার মানুষ

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২২ নভেম্বর ২০১৪

সড়ক দুর্ঘটনায় লাশের মিছিল কিছুতেই থামছে না ॥ বছরে ১২ থেকে ২০ হাজার মানুষ

বাবুল হোসেন, ময়মনসিংহ ॥ ওভারটেকিং, ওভারস্পিড, ওভারলোডিং-এই ৩টি প্রধান কারণে সড়ক-মহাসড়কে ঘটছে বেশিরভাগ দুর্ঘটনা। এর বাইরে চালকের অদক্ষতা ও অসাবধানতা, ঝুঁকিপূর্ণ ড্রাইভিং, ট্রাফিক আইন অমান্য, গাড়ি চালানোর আগে মাদক গ্রহণ, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, বেহাল সড়ক, যত্রতত্র স্পিডব্রেকার, পথচারীদের সতর্কতার অভাব, দুর্ঘটনাপ্রবণ স্পটগুলোতে প্রতিরোধমূলক কার্যকর ব্যবস্থা না থাকাসহ সড়ক-মহাসড়কে পুলিশি নজরদারির অভাবেও ঘটছে এই দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়ার কোন নজির না থাকায় কমছে না এই সড়ক দুর্ঘটনা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষীয় সূত্র সড়ক দুর্ঘটনার জন্য এসব কারণ চিহ্নিত করলেও দুর্ঘটনা রোধে এখনও কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) ও হাইওয়ে পুলিশসহ স্থানীয় প্রশাসন পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের বিরুদ্ধে আইনী পদক্ষেপ গ্রহণে অনেকটাই অসহায়। ফলে নাটোরের বড়াইগ্রামে স্মরণকালের ভয়াবহ দুর্ঘটনাসহ মানিকগঞ্জে মিশুক-মুনিরের মতো মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় সরকার প্রশাসন নড়েচড়ে বসলেও অবস্থার কোন উন্নতি হয়নি। তবে পরিবহন মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়ন নেতাদের দাবি, পুলিশ ও প্রশাসন ইচ্ছে করলেই সড়ক-মহাসড়কের এসব অব্যবস্থাপনা বন্ধ করতে সক্ষম। বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্স সেন্টারের গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের সড়ক-মহাসড়কে এখন দুর্ঘটনার মহামারি চলছে। দেশে প্রতিবছর ১২ থেকে ২০ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনায়। আর ব্র্যাকের গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় অকালেই প্রাণ হারাচ্ছে ১০ থেকে ১২ হাজারেরও বেশি মানুষ। আহত হয়ে কর্মক্ষমতা হারাচ্ছে এর কয়েকগুণ মানুষ। এর সিংহভাগই ঘটছে জাতীয় সড়ক-মহাসড়কে। গবেষণায় বলা হয়, প্রায় সব জেলাতেই কমবেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে কুমিল্লা, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও চট্টগ্রাম মহাসড়কে এই দুর্ঘটনা সবচেয়ে বেশি হচ্ছে। সরকারীভাবে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই। যেসব ঘটনায় মামলা হয় সেগুলোই রেকর্ডে আসে। সরকারী হিসেবে প্রতিবছর দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার সংখ্যা ৩ হাজার মাত্র। বিশ্ব ব্যাংকের গবেষণায় বলা হয়, বিশ্বে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন মানুষ। আর আহত হচ্ছে ৫০ মিলিয়ন মানুষ। নাটোরের বড়াই গ্রামে গত অক্টোবরে স্মরণকালের ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় রেকর্ডসংখ্যক ৩৬ জন মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। দুর্ঘটনার কারণ ॥ বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলোতে সড়ক নিরাপত্তার সার্বিক অবস্থার দিন দিন অবনতি ঘটছে। গবেষণায় বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার সুনির্দিষ্ট ৮টি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে হাইওয়ে পরিকল্পনা না থাকা, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, মোটরযানের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যাওয়া, সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় অতি সামান্য বিনিয়োগ, অপর্যাপ্ত সচেতনতামূলক কর্মসূচী, চালকদের প্রশিক্ষণ ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব, সড়ক নির্মাণ ও মেরামতে ত্রুটি। তবে দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে চালকের অদক্ষতা, ওভারটেকিং, ওভারস্পিড ও ওভারলোডিংসহ ত্রুটিপূর্ণ সড়ক ব্যবস্থাকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। দুর্ঘটনার স্পট শনাক্ত হলেও প্রতিরোধে উদ্যোগ নেই ॥ রাজধানী ঢাকায় ৫১টিসহ সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার চিহ্নিত স্পট রয়েছে ২০৯টি। সড়ক বিভাগ এসব স্পটের নাম দিয়েছে ব্ল্যাক স্পট। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ১০টি, ঢাকা-চট্টগ্রামে ৩৮, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ৩৫টি, গাজীপুর-টাঙ্গাইল ও জামালপুর মহাসড়কে ১৪টি, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে ২২টি, নগরবাড়ী-বাংলাবান্ধা মহাসড়কে ২৪টি, নগরবাড়ী-রাজশাহী মহাসড়কে ২৪টি, দৌলতদিয়া-ঝিনাইদহ-খুলনা মহাসড়কে ১৬টি, ঢাকা-মাওয়া-বরিশাল মহাসড়কে ৪টি এবং যমুনা ব্রিজ সড়কে ৮টি ব্ল্যাক স্পট রয়েছে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ব্ল্যাক স্পটগুলো হচ্ছে ভালুকার ভরাডোবা বাজার, বোর্ড বাজার, সিডস্টোর বাজার, ২৬ কিলোমিটার পোস্ট, গফরগাঁও ইন্টারসেকশন, গিলারচালা বাজার, পোড়াবাড়ী বাজার, ময়মনসিংহ পলিটেকনিক, টঙ্গী মার্কেট, টঙ্গী স্টেশন রোড। বিভিন্ন সময়ে এসব স্পটে একাধিক দুর্ঘটনা ঘটলেও তা রোধে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেই পুলিশ কিংবা সড়ক বিভাগের। পুলিশ কর্মকর্তার পরামর্শ ॥ পুলিশ পরিদর্শক মোঃ সালাহ উদ্দীনের মতে দুটি পদ্ধতির মাধ্যমে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তাঁর মতে বেশিরভাগ র্দুঘটনা ঘটছে বাস ও ট্রাকের মধ্যে। এক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশন দেয়ার সময় বিআরটিএ থেকে প্রত্যেক বাস ও ট্রাকে স্পিড লিমিট গবর্নর সিলযুক্ত করে গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। আশির দশক পর্যন্ত এ পদ্ধতি চালু ছিল। এক্ষেত্রে বাস ও ট্রাকের জন্য সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার নির্ধারণ করে গবর্নর সিলযুক্ত করে দিলে চালকদের গতি নিয়ন্ত্রণ হবে। আর কেউ যদি এই লিমিট অতিক্রম করার পর ধরা পড়ে, তাহলে তাকে শাস্তিমূলক দ- দেয়া যাবে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে করণীয় ॥ নাটোরের বড়াইগ্রামে স্মরণকালের ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর মৃত্যুর এ মিছিল রোধে বিশেষজ্ঞরা নানা পরামর্শ দিচ্ছেন সরকারকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চালক নিয়োগ, রোড ডিভাইডার নির্মাণ, দেশের সকল জাতীয় মহাসড়ককে চার লেনে রূপান্তর, সড়ক মহাসড়কের পাশ থেকে হাটবাজার উচ্ছেদ, মহাসড়কে গাড়ি পার্কিং ও ইউটার্ন বন্ধ, মহাসড়কের ব্যস্ততম পয়েন্টে ফুটওভার ব্রিজ ও আন্ডারপাস নির্মাণ, মহাসড়ক থেকে কমগতির নসিমন করিমন ভটভটি উচ্ছেদ, ইন্টারসেকশনের উন্নয়নসহ ট্রাফিক সাইন, আইন ও সিগন্যাল সম্পর্কে চালকদের ধারণা দেয়া গেলে দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। সড়ক ও জনপথ বিভাগ ময়মনসিংহের নির্বাহী প্রকৌশলী শামীম আল মামুন জনকণ্ঠকে জানান, উন্নত বিশ্বের কোথাও মহাসড়কের পাশে হাটবাজার নেই। ডিভাইডার বাড়ানোসহ মহাসড়কে বেপরোয়া যানচলাচল নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলে দুর্ঘটনা কমে আসবে বলে এই প্রকৌশলীর দাবি। ট্রমা সেন্টারের চিত্র ॥ সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের দ্রুত উন্নতমানের চিকিৎসা সেবা প্রদানের লক্ষ্যে ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়কের ভালুকা উপজেলা সদরে স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পাশে গত ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্মাণ করা হয় ট্রমা সেন্টার। সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার মতো প্রয়োজনীয় সবধরনের যন্ত্রপাতির সাপোর্ট রয়েছে এখানে। কিন্তু প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাবে জোড়াতালির বহির্বিভাগ চালু রাখা হলেও বন্ধ রয়েছে ইনডোর বিভাগ। এতে করে জরুরী ও গুরুতর রোগীদের ট্রমা সেন্টারে ভর্তি করে চিকিৎসা দেয়া যাচ্ছে না। ড্রাইভার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ॥ ব্র্যাকের গবেষণায় বলা হয়, দেশে ২১ লাখ গাড়ির বিপরীতে লাইসেন্সধারী চালক রয়েছে মাত্র ১৩ লাখ। প্রতিবছর নতুন করে দেড় লাখ গাড়ি নিবন্ধিত হচ্ছে। কিন্তু এ সব গাড়ির জন্য যত সংখ্যক চালকের প্রয়োজন বাস্তবে তা তৈরি হচ্ছে না। পেশাদার চালক সৃষ্টিসহ দক্ষতা বাড়াতে ময়মনসিংহ শহরের বাইপাস হাইটেক পার্কের কাছে গড়ে তোলা হচ্ছে ড্রাইভার ট্রেনিং সেন্টার। চালকদের সঙ্গে বিআরটিএর চেয়ারম্যানের এক মতবিনিময় সভায় এ কথা জানান চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম। ব্র্যাকের কর্মসূচী ॥ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা না গেলে আগামী ১০ বছরে হতাহতের এ সংখ্যা দ্বিগুণে দাঁড়াবে। এ জন্য সরকার আগামী ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এ লক্ষ্যে আগামী ২০১৫ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা ২৫ শতাংশ কমিয়ে আনার টার্গেট নিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচী হাতে নিয়ে বাস্তবায়ন করছে সরকার।
×