ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুক্তিযুদ্ধের স্মারক বঙ্গবন্ধুকে বহন করার স্মৃতি

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ২০ নভেম্বর ২০১৪

মুক্তিযুদ্ধের স্মারক বঙ্গবন্ধুকে বহন করার স্মৃতি

মোরসালিন মিজান ॥ আকাশে উড়ে বেড়ানো ঘুরে বেড়ানো বিমান। বিশাল ডানায় দেশ-বিদেশ করা হেলিকপ্টার। কোনটি যুদ্ধে জয়ী। বীরের বেশ। পরাজয়েরও চিহ্ন কোন কোনটির গায়ে মাখা। দীর্ঘ ভ্রমণে লড়াইয়ে ক্লান্ত শ্রান্ত বিমান হেলিকপ্টার এখন ইতিহাসের স্মারক। মাটিতে এক সময় পা পড়ত না। এখন মাটির সঙ্গে মাখামাখি। ফলে মজা করে দেখা যায়। অনেকটা ঘোড়ার মতো, সুন্দর চড়া যায়! সুযোগটি করে দিয়েছে বিমানবাহিনী জাদুঘর। হ্যাঁ, নতুন। গত ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে এটি যাত্রা শুরু করেছে। এরই মাঝে বেশ জনপ্রিয়ও। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে জাদুঘর দেখতে আসছেন কৌতূহলী মানুষ আর কাগজের এরোপ্লেন ওড়ানো বাচ্চাদের কথা তো বলাই বাহুল্য, আনন্দে যেন আত্মহারা তারা। সব মিলিয়ে বেশ জমে উঠেছে। জাদুঘরটি রাজধানীর আগারগাঁওয়ে আইডিবি ভবনের বিপরীত পাশে অবস্থিত। এটি প্রতিষ্ঠা করেছে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী। একই বাহিনী আছে সার্বিক তত্ত্বাবধানে। সাধারণত জাদুঘর মানেই চার দেয়ালের ঘর। কাঁচের শোকেস। এখানে একেবারেই ভিন্ন চিত্র। গত কয়েকদিন সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বিশাল মাঠ। খোলা প্রান্তর। সবুজ ঘাসের ওপর সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে উড়োজাহাজ। হেলিকপ্টার। দেখে মনে হতে পারে কোন বিমানবন্দর। এর পর কাছে গিয়ে দেখা। একেবারে বাম পাশে ইটবসানো ওয়াকওয়ে। কিছুক্ষণ হাঁটলে হাতের বাম পাশে দৃশ্যমান হয় ১১টি যুদ্ধবিমান। এক পাশে ৫টি। অন্যপাশে ৬। মুখোমুখি করে সাজানো। মাঝখানের সরু ওয়াকওয়ে ধরে হেঁটে গেলে এবং ফেরত এলে দেখা হয়ে যায় সবকটি। এখানে মূলত যুদ্ধবিমান। একটি বিমান বেশ সিøম দেখতে। ওজনেও কম। নামÑ জি ন্যাট যুদ্ধবিমান। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে মনেই হয় না, এ দিয়ে যুদ্ধ করা সম্ভব অথচ তা-ই হয়েছে। শুধু যুদ্ধবিমান নয়, এটি বিজয়ী বিমান। জানা যায়, ১৯৫৮ সালে ভারতীয় বিমানবাহিনীতে সংযোজিত হয়েছিল। ১৯৭১ সালে বাঙালীর সাহায্যে এগিয়ে আসা ভারতীয় বাহিনী এ রকম তিনটি জি ন্যাট দিয়েই আকাশ ও ভূমি আক্রমণ শুরু করেছিল। পাশেই দাঁড়িয়ে হান্টার বিমান। দৈর্ঘ্য ৪৫ ফুট ১১ ইঞ্চি। ওপরের দিকে ছোট্ট মতো বসার জায়গা। চালক একা বসতে পারতেন। তবে জানা যায়, এটি ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী ও নির্ভরযোগ্য যুদ্ধবিমান। ১৯৫১ সাল থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত ভারতীয় বিমানবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত ছিল। ১৯৭১ সালে কাজ করে বাংলাদেশের হয়ে। একই রকম হালকা দেখতে ‘মিগ ২১ এফএল’। ভারতীয় বাহিনীর এ বিমানটিও লড়েছিল পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে। সরু দেখতে বিমানের দৈর্ঘ্য ৫১ ফুট ৮ ইঞ্চি। উচ্চতা ১৩ ফুট ৬.৪১ ইঞ্চি। বিমানের একটি মাত্র আসন। সেটি চালকের। তবুও বিজয়ী। মাথা উঁচু করেই দাঁড়িয়ে আছে। উল্টো দিকে পাকিস্তানী বাহিনীর পরাজয়ের চিহ্ন হয়ে আছে ‘এফ ৮৬’ যুদ্ধবিমান। মাছের মতো দেখতে। রাক্ষুসে মুখটি এখনও হা করে আছে। জানা যায়, আরও বহু বিমানের মতো এ বিমানটিও ব্যবহার করেছিল পাকিস্তানী বাহিনী। বাংলাদেশকে শ্মশান করার কাজে লাগানো হয়েছিল একে। খুব প্রাসঙ্গিক আরও একটি তথ্য হচ্ছে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যার পক্ষে অবস্থান নেয়া যুক্তরাষ্ট্র বিমানটি তৈরি করেছিল। বর্তমানে একই বিমান দুটি দেশের পরাজয়ের ইতিহাস তুলে ধরছে। জানা যায়, ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় বিমানটি ফেলে পালিয়ে পালিয়েছিল পাকিস্তানীরা। বাংলাদেশের ইঞ্জিনিয়ারদের বহু চেষ্টার পর ১৯৭২ সালে এটি ফের উড্ডয়ন শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধের স্মারক বিমানগুলো দেখা শেষ হলে চোখে পড়ে আরও বেশ কিছু ছোট উড়োজাহাজ। দেখতে বড় খেলনার মতো। মাটির সঙ্গে বুক যেন লাগিয়ে আছে। টি-৩৭, ফুগা সিএম ১৭০ ম্যাজিস্টার, পিটি ৬ ও এয়ার টুওরার ট্রেইনার নামের বিমানগুলো দীর্ঘদিন প্রশিক্ষণের কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। বিমানগুলো বেশ রঙিন হওয়ায় দর্শনার্থীদের সহজেই আকৃষ্ট করে। অবশ্য শুধু দেখা নয়, জাদুঘরে আছে বিমানে চড়ার সুযোগ। ছোট্ট সিঁড়ি বেয়ে বিমানের ভেতরে প্রবেশ করা। না, ভেতরে তেমন কিছু নেই। স্টেনলেজ স্টিলের শূন্য বাক্সটিতে বসার কয়েকটি চেয়ার। ওখানে কিছু সময় বসে থাকা। জানালা দিয়ে বাইরে তাকানো। এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত হেঁটে নেমে আসা। কয়েক মিনিটের এ ভ্রমণের জন্য আবার গুনতে হয় বাড়তি ৩০ টাকা। তবুও বিমানে চড়া হলো! আনন্দ তাই ধরে না। ভেতর অবধি বেড়ানো যায় এমন একটি বিমানের নাম এয়ারটেক কানাডিয়ান ডিএইচ ৩/১০০০ অটার। ১৯৫২ সালে কানাডায় তৈরি বিমানটি ১৯৭১ সালে উঠেছিল বোমারু বিমান। প্রয়োজনের তাগিদে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর দক্ষ টেকনিশিয়ানরা এই রূপান্তর ঘটাতে সক্ষম হয়। জানা যায়, ৩ ডিসেম্বর এর সাহায্যে আকাশ থেকে ইস্টার্ন তেল শোধনাগার এবং চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে সফল আক্রমণ পরিচালনা করা হয়। বর্তমানে এর ভেতরে তেমন কিছু নেই। খালি বাক্সের মতো। কিছু চেয়ার বসানো আছে। দর্শনার্থীরা ওখানেই কিছু সময় বসে থেকে বিমানে চড়ার স্বাদ নিচ্ছেন। একইভাবে ঘুরে দেখা যায় এন ২৪ বিমানটি। রাশিয়ার তৈরি এ উড়োজাহাজ বেশ বড়সড়ো। জানা যায়, ১৯৭৩ সালে এটি বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে সংযুক্ত হয়। তবে বিমানটিকে বিশেষ বলতে হবে এ জন্য যে, এর সঙ্গে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামটি জড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বিমানটি ব্যবহার করতেন। জাদুঘরে বিমান ছাড়াও আছে বিশাল দেখতে হেলিকপ্টার। এম আই ৮ নামের দুটি হেলিকপ্টার নির্দিষ্ট দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে। ১৯৭২ সাল থেকে এগুলো বাংলাদেশে। ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত পাখা মেলেছে। বর্তমানে জাদুঘরের নিদর্শন। ৩০ টাকার টিকেট কেটে ভেতরটা ঘুরে দেখা যায়। দুটি হেলিকপ্টারের একটি বঙ্গবন্ধু ব্যবহার করতেন। ফলে সেটি নিয়ে দর্শনার্থীদের কৌতূহল বেশি। তবে হেলিকপ্টারের ভেতরে প্রবেশ করে অবাকই হতে হয়। কারণ বঙ্গবন্ধু যত বড় নেতা, ভেতরের জায়গাটি ততটাই ছোট! বিমান হেলিকপ্টার ছাড়াও জাদুঘরে রয়েছে দুটি র‌্যাডার। পি৩৫এম ও পিআরভি১১ নামের র‌্যাডার দুটি ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে ব্যবহৃত হয়েছে। সবই কৌতূহল নিয়ে দেখছেন দর্শনার্থীরা। চলছে ছবি তোলার কাজ। তবে জাদুঘরটির সীমাবদ্ধতাও কম চোখে পড়েনি। এখানে অনেকেই বসে গেছেন ব্যবসার মন নিয়ে। জাদুঘরের প্রবেশ মূল্য ধরা হয়েছে ২০ টাকা। বিমান হেলিকপ্টারগুলোর অভ্যন্তরে দেখার কিছুই নেই। ন্যূনতম অনুষঙ্গ যোগ করা হয়নি। এর পরও ঘুরে দেখার জন্য দর্শনার্থীদের গুনতে হচ্ছে বাড়তি ৩০ টাকা করে। জাদুঘরের ভেতরে টানানো হয়েছে বিয়েবাড়ির মাইক। বিকট শব্দে বাজছে হিন্দি গান। ‘রসিয়া বন্ধু’কে কাছে না পাওয়ার রোদনে ভরা বাংলা গান। এদিকে, দর্শনার্থীরাও যার যা খুশি করছেন। এক মাঝবয়সী নারী তো যুদ্ধবিমানের পাখার ওপর রীতিমতো লাঞ্চ সাজিয়ে বসেছিলেন। বিমানের ডানায় খাবারের বাটি, পানির মগ রেখে বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছিলেন তিনি। কোন কোন যুগল বসেছিলেন বিমানের ঠিক পাখার নিচে। বিমান দেখার পরিবর্তে তাঁদের দেখছিলেন দর্শনার্থীরা। মাঠের দক্ষিণ দিকে রয়েছে একটি ছোট শিশুপার্ক। ফোয়ারা আছে। আছে বিভিন্ন পশুপাখি মাছের ভাস্কর্য। সব মিলিয়ে একটা এলোমেলো ব্যাপার মনে হয়। এসব বিষয়ে জাদুঘর অফিসে কথা হয় মিজানুর রহমানের সঙ্গে। দায়িত্বপ্রাপ্ত এই কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, বিমানবাহিনী জাদুঘর একেবারেই নতুন। এখনও অনেক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বাকি। এগুলো নিয়ে কাজ হচ্ছে। অচিরেই সব সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে জাদুঘরটি আরও উপভোগ্য হয়ে উঠবে বলে জানান তিনি। বিমানবাহিনী জাদুঘর সোমবার থেকে বৃহস্পতিবার বেলা ২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্র ও শনিবার এবং সরকারী যে কোন ছুটির দিনে সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে। সাপ্তাহিক বন্ধ রবিবার। পছন্দের দিনটি বেছে নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন নতুন এই জাদুঘর।
×