ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

স্বর্ণ চোরাচালান ॥ এবার বিমানের ডিজিএমসহ আটক ৫

প্রকাশিত: ০৪:৩৩, ২০ নভেম্বর ২০১৪

স্বর্ণ চোরাচালান ॥ এবার বিমানের ডিজিএমসহ আটক ৫

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিমানের প্রভাবশালী কিছু পাইলট ও বিমানবালার সিন্ডিকেট সরাসরি সোনা চোরাচালানে জড়িত এমন অভিযোগ ছিল দীর্ঘদিনের। সেটা বিমান কর্তৃপক্ষ বিশ্বাস করত না। এবার যখন এক পাইলটসহ পাঁচজনকে হাতেনাতে ধরা হলো- তখন এমডি মোসাদ্দিক আহমেদ জানালেন- তদন্ত হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গ্রেফতার হওয়া বিমানের এই গুণধর পাইলট হলেন আবু আসলাম শহীদ, (ডিজিএম ফ্লাইট সার্ভিস) মোঃ এমদাদ হোসেন, সিডিউলিং ম্যানেজার তোজাম্মেল হোসেন, বিমানের ঠিকাদার মাহমুদুল হক পলাশ ও ফারহান মানি একচেঞ্জের মালিক হারুন অর রশীদ। বিমানবন্দর, উত্তরা ও বসুন্ধরা এলাকা থেকে মঙ্গলবার রাতে তাদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর বুধবার সকালে তাদের মিন্টো রোডের গোয়েন্দা কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হয়। এরপর দুপুরে তাদের আদালতে পাঠিয়ে চার দিনের রিমান্ডে আনা হয়। এ ঘটনায় বিমানে তোলপাড় শুরু হয়েছে। বিশেষ করে মাহমুদুল হক পলাশ নিজেকে সব সময় বিমান পর্ষদ প্রধানের ধর্মপুত্র বলে পরিচয় দেয়ায় এখন বিপাকে পড়েছেন বিমানের শীর্ষ কর্তারা। জানতে চাইলে জনসংযোগ কর্মকর্তা খান মোশাররফ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, এসব আমাকে জিজ্ঞাসা করবেন না। প্রভাবশালীদের পরিচয় দেয়া বা নাম ভাঙ্গানো মানুষের একটা স্বভাব। আর চেয়ারম্যানের পরিবারের সঙ্গে কার কি যোগাযোগ আছে কি নাই সেটা আমার জানার বিষয় নয়। পরিচালক রাজপতি সরকার রাতে জনকণ্ঠকে বলেন, নিয়মানুযায়ী কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী গ্রেফতার হলে, তাকে সাসপেন্ড করতে হয়। এটা নিয়ে এমডির সঙ্গে কথা হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার তাদের সাসপেন্ড প্রক্রিয়া শুরু হবে। এ বিষয়ে মোবাইলে জানতে চাইলে কোন প্রকার মন্তব্য থেকে বিরত থাকেন এয়ার মার্শাল জামাল উদ্দিন। ডিবি জানায়, এদের আটকের নেপথ্যে দীর্ঘদিনের নজরদারি ছিল। কারণ তারা সবাই প্রভাবশালী। তাদের আটকের আগে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণাদি হাতে নিয়েই অভিযানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পুলিশের ওপর মহলের গ্রিন সিগন্যাল নিয়েই তাদের ধরার অভিযান শুরু হয় মঙ্গলবার। গত ১২ নবেম্বর বিজি-০৪৬ ফ্লাইটে বাংলাদেশ বিমানের কেবিন ক্রু মাজহারুল আফসার রাসেলকে ২ কেজি ৬০০ গ্রাম স্বর্ণসহ গ্রেফতার করে বিমানবন্দর কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এরপর বিমানবন্দর থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা হয়, যার তদন্ত আসে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে। রাসেলকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদে বিমানের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নাম আসে। পরে আদালতে ১৬৪ ধারামতে দেয়া জবানবন্দীতে উঠে আসে গ্রেফতারকৃতদের নাম। জানা যায়, মঙ্গলবার রাতে উত্তরার বাসা থেকে প্রথমে আটক করা হয় মাহমুদুল হক পলাশকে। তারপর বসুন্ধরা ও বিমানবন্দর এলাকা থেকে আটক করা হয় বাকিদের। রাতেই তাদের নিয়ে আসা হয় ডিবি হেফাজতে। তাদের অত্যন্ত গোপনীয়তা রাখা হয়। সকাল ১০টায় প্রথম সাংবাদিকদের জানানো হয় এ অভিযানের কাহিনী। এ বিষয়ে যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তদন্তে যার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে তাকেই গ্রেফতার করা হবে। গ্রেফতারকৃত বিমান কর্মকর্তাদের বিষয়ে তিনি বলেন-তারা বিমানের সিডিউল তৈরি করতেন। এমনকি বিমানে কার কখন দায়িত্ব থাকবে এবং কি দায়িত্ব থাকবে তারা নির্ধারণ করত। চোরাচালানের স্বর্ণ নিরাপদে বাইরে বের করে আনতে বিভিন্ন পর্যায়ে কার কি ভূমিকা থাকবে তাও তারা নির্ধারণ করতেন। দুবাই প্রবাসী বাংলাদেশী শফিউল আলম মিন্টু এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করত জানিয়ে মনিরুল ইসলাম বলেন, শফিউল দুবাই থেকে স্বর্ণ কিনে বিমান কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে তা বাংলাদেশে পাঠাত। চোরাচালানের নীল নকশার সঙ্গে এই কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভূমিকাও থাকে বলে তারা নিশ্চত হয়েছে। চার দিনের রিমান্ডে ॥ বুধবার তাদের আদালতে হাজির করে মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন ডিবি উত্তরের এএসপি মীনহাজুল ইসলাম। ঢাকা মহানগর হাকিম এরফান উল্লাহ শুনানি শেষে এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন। অন্যদিকে আসামিদের আইনজীবী এ্যাডভেকেট কাজী নজিবুল্লাহ এর বিরোধিতা করেন। শুনানি শেষে মহানগর হাকিম এরফান উল্লাহ আসামিদের চার দিনের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন। রিমান্ড প্রতিবেদনে বলা হয়- পাঁচজনকে গ্রেফতারের পর বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, মূলত শফিউল আজম নামের এক ব্যক্তি দুবাই থেকে চোরাচালানের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করেন। আর বিমানের ঠিকাদার পলাশ এ কাজের সমন্বয় করতেন। অর্থ আদান প্রদানের বিষয়টি দেখতেন হারুন অর রশিদ। বিদেশ থেকে আনা চালান নির্বিঘেœ কাস্টমস পার করতে বিমানের ক্যাপ্টেন থেকে শুরু করে অন্যান্য পর্যায়ের দায়িত্ব থাকা ব্যক্তিদের ভাগ করে দেয়া হতো। বিভিন্ন পর্যায়ে কার কী ভূমিকা থাকবে তাও তারা নির্ধারণ করত। গত প্রায় দুই বছর ধরে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রায় প্রতিদিনই সোনার চালান ধরা পড়লেও এই প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কাউকে গ্রেফতার করা হলো। গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানান, গত ১২ নবেম্বর বিমানের একটি ফ্লাইট থেকে দুই কেজি ৬০০ গ্রাম সোনা ও ছয়টি আইপ্যাডসহ মাজহারুল আফসার নামের বিমানের এক কেবিন ক্রুকে গ্রেফতার করা হয়। তিন দিনের রিমান্ডের পর তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন এবং তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতেই বিমান কর্মকর্তাসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়। মাজহারুলকে গ্রেফতারের পর শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের পরিদর্শক আবুল হোসেন বাদী হয়ে বিমানবন্দর থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলাতেই এমদাদসহ পাঁচজনকে রিমান্ডে পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের মহাপরিচালক মইনুল খান জানান, এ মামলায় অপরাধ প্রমাণিত হলে আসামিদের সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদ- হতে পারে। এদিকে গ্রেফতারকৃতদের সম্পর্কে মনিরুল ইসলাম বলেন, ঠিকাদার মাহমুদুল হক পলাশ বেশ প্রভাবশালী। তাকে আমরা ভোরে গ্রেফতার করি। এখনও তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়নি। আমাদের কাছে কিছু তথ্য আছে, আমরা সেগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখব। মনিরুল জানান, বিমান বালা থেকে শুরু করে বিমানের বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজনের নাম এসেছে তাদের তদন্তে। পলাশের স্ত্রী নিজেও একজন বিমানবালা। গ্রেফতারকৃতরা ছাড়াও এ চক্রের সঙ্গে জড়িত আরও বেশকিছু নাম এসেছে। এগুলো যাচাই-বাছাই করে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। পলাশ বিমান চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিনের ধর্মপুত্র পরিচয় দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিমানে একচেটিয়া কমিশন বাণিজ্য, নিয়োগ, বদলি পদোন্নতি ও বিভিন্ন তদ্বির কাজের অভিযোগ জানা আছে কিনা জনকণ্ঠের এমন প্রশ্নের জবাবে ডিসি ডিবি মনিরুল ইসলাম বলেন-আমরা সব দিকই তদন্ত করছি। যার নাম আসবে তদন্তে আসবে তাকেই আইনের আওতায় আনা হবে। এখানে কে কি সেটা দেখা হবে না। বিমান সূত্র জানায়, বিমানের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কাবো কেলেঙ্কারি অন্যতম হোতা এই পলাশ। মূলত তাকেই টোল কালেক্টর হিসেবে ব্যবহার করত। সে সূত্রেই বিমানে তার ত্রাসের রাজত্ব গড়ে ওঠে। কারো কেলেঙ্কারির পর পলাশ সম্পর্ক গড়ে তোলে গ্রেফতারকৃত এমদাদ হোসেন, তোজাম্মেল ও ফারহা মানি একচেঞ্জ মালিক হারুন রশীদের সঙ্গে। এ সময় পলাশ বিমানে কর্মরত তার স্ত্রী বিমানবালা নূরজাহানকে কাজে লাগায়। নূরজাহানে মাধ্যমেই পাইলট আবু আসলাম শহীদের সঙ্গে। সর্বশেষ যে ফ্লাইটে সোনা ধরা পড়ে তার সিডিউল ঠিক করার দায়িত্ব পালন করেন তোজাম্মেল ও এমদাদ। গ্রেফতারের পর তারা প্রাথমিকভাবে এ সব স্বীকারও করেন। এ বিষয়ে এসি মিনহাজুল ইসলাম বলেন, আরও চমক আছে। প্রভাবশালী আরও কজন আসামিকে ধরার অভিযান চলছে। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (উত্তর) উপ-কমিশনার (ডিসি) শেখ নাজমুল আলম, ডিএমপির (মিডিয়া) উপ-কমিশনার (ডিসি) মাসুদুর রহমান।
×