ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

তিস্তার চরে স্বাস্থ্যসেবা নারী-পুরুষ উচ্ছ্বসিত

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১৯ নভেম্বর ২০১৪

তিস্তার চরে স্বাস্থ্যসেবা নারী-পুরুষ উচ্ছ্বসিত

জাহাঙ্গীর আলম শাহীন ॥ তিস্তার দুর্গম চরাঞ্চল। সবদিক থেকে অবহেলিত। এক সময় ছিল শুধু ক্ষণিকের বসতি। স্বাস্থ্যসেবা বলতে কিছুই ছিল না। এখন সময় বদলেছে। বেড়েছে চরাঞ্চলে সুযোগ-সুবিধা। সেই সঙ্গে নিশ্চিত হয়েছে স্বাস্থ্যসেবা। গ্রামের পাশাপাশি চরেও স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে গেছে। লালমনিরহাটের পাঁচটি উপজেলায় ১৫৭ কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা মানুষের দোরগোড়ায়। এখন আর ওঝা, ফকির, কবিরাজ, তাবিজ-কবজ ও পানি পড়ার ওপর প্রত্যন্ত গ্রাম ও চরের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নির্ভরশীল নয়। কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে পাল্টে গেছে চরের স্বাস্থ্যসেবার মান। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতেই গর্ভবতী মায়েরা নিয়মিত স্বাস্থ্য পরিচর্যার সুবিধা পাচ্ছেন। এ সব ক্লিনিকে বিনা খরচে প্রশিক্ষিত ধাত্রী দিয়েই স্বাভাবিক সন্তান প্রসব করানো হচ্ছে। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই স্বাস্থ্যসেবা এখন একটি মডেল। তিস্তার দুর্গম চরের নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর এবং গর্ভবতী মা এতদিন বঞ্চিত ছিল স্বাস্থ্যসেবা থেকে। অপুষ্টিসহ সামান্য অসুখ-বিসুখে তারা অসহায় হয়ে পড়ত। বিশেষ করে গর্ভবতী মায়েদের প্রসবজনিত সমস্যা ছিল প্রকট। ফলে চরগুলোতে মা ও শিশুমৃত্যুর হার ছিল অনেক বেশি। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো চরে স্বাস্থ্যসেবার ধারণা পাল্টে দিয়েছে। এখন এ সব ক্লিনিকের মাধ্যমে প্রত্যন্ত গ্রাম ও দুর্গম চরেও স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি ঘটেছে। প্রতিদিন শতশত গর্ভবতী মা ও শিশু ক্লিনিকগুলো হতে বিনা পয়সায় স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে। কমেছে মা ও শিশুমৃত্যুর হার। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে গিয়ে দুর্গম চরের গর্ভবতীরা স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানতে পারছে। জানতে পারছে পুষ্টি, গর্ভবতী মায়ের পরিচর্যা, সদ্য প্রসব করা শিশু পরিচর্যা সম্পর্কে। এমনকি নবদম্পতিরা জন্ম নিয়ন্ত্রণসহ নানা বিষয়ে পরামর্শ নিতে পারছে অতি সহজে। চরের লাজুক মহিলারা কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছে গিয়ে তার সমস্যা নিয়ে প্রাণখুলে কথা বলছে, সহজে সমাধান হচ্ছে এ সব সমস্যার। কারণ ক্লিনিকে কর্মরত কমিউনিটি হেল্থ কেয়ার প্রোভাইডারটি তার নিজ গ্রামের মেয়ে অথবা ছেলে। চরাঞ্চলের রাজপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা মোঃ মোফাজ্জল হোসেন মোফা জানান, কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো চরের মানুষের যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে, তা প্রশংসার দাবি রাখে। মানুষ সেবা পেয়ে দারুণ খুশি। স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের লালমনিরহাট শাখার সভাপতি ও বাংলাদেশ রেলওয়ে মেডিক্যাল হাসপাতালের চীফ মেডিক্যাল অফিসার ডাঃ ভোলানাথ ভট্টাচার্য জানান, বর্তমান সরকার তৃণমূল পর্যায়ে মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এই কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে চরের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে গর্ভবতী মা ও শিশুর পরিচর্যা ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা। ছয় বছর আগেও সামান্য জ্বর হলেই চরের মানুষকে যেতে হতো শহরে। দুর্গম চরের নাজুক যোগাযোগ ব্যবস্থার ধকল সামাল দিয়ে চরের নারীরা অসুস্থ হলেও চিকিৎসকের কাছে যেতে অনীহা প্রকাশ করত। ফলে অকালে ঝরে পড়ত বহু প্রাণ। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর মাধ্যমে গর্ভবতী মা ও শিশু স্বাস্থ্য পরিচর্যার সেবা নিশ্চিত হয়েছে। এতে চরাঞ্চলে গর্ভবতী মা ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে শিশুমৃত্যুর হার চরাঞ্চলেও প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৬ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসেন। তখন তিনি তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রধানমন্ত্রীর প্রকল্প হিসেবে সরাসরি গ্রাম্য ও চরের নারীদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে এই কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের উদ্যোগ নেন। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে সম্পূর্ণ বিনা পয়সায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হয়। প্রতি সপ্তাহ ও মাসে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো পরিদর্শন করেন উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, এনজিও প্রতিনিধি, ডিএমসিএইচ এ্যান্ড আইও কর্মকর্তা, এমবিবিএস ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। তারা কমিউনিটি ক্লিনিক পরিদর্শনের পাশাপাশি একটু জটিল রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকেন। এছাড়াও সরকার বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রীয়ভাবে টিকাদান কর্মসূচীসহ সকল প্রকার স্বাস্থ্যগত প্রচার এ সব কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে করে থাকে। এভাবেই কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো দেশের স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে কাজ করছে এবং অবদান রাখছে। কমিউনিটি ক্লিনিকে হাজার হাজার নারী ও পুরুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এ সব কমিউনিটি ক্লিনিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ৩৩ প্রকার ওষুধ বিনা পয়সায় চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুসারে বিতরণ করা হয়। উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা, সানিয়াজান, ব্রহ্মপুত্র নদের চর ও চরের শ্রমজীবী, মৎস্যজীবী, হতদরিদ্র পরিবার নিয়ে কাজ করা দেশের একটি এনজিওর নারী কর্মকর্তা মা, শিশু ও ধাত্রীবিদ্যা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডাঃ সেলিমা রহমান জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাধারণ মানুষ ও নারীদের কথা মাথায় রেখে, তাদের দুঃসময়ে পাশে থাকতেই এই কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করেন। আজকের এই কমিউনিটি ক্লিনিক হয়ত একদিন ছোট ছোট হাসপাতালে পরিণত হবে।
×