ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

ফিলিস্তিন শান্তি আর কত দূরে

প্রকাশিত: ০৪:৪০, ১৩ নভেম্বর ২০১৪

ফিলিস্তিন শান্তি আর কত দূরে

৩০ অক্টোবর ২০১৪-এ সুইডেন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতির ঘোষণা দিয়েছে। জাতীয় নির্বাচনে জিতে এই অক্টোবরের প্রথম দিকে সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী স্টিফান লয়েফভন পার্লামেন্টে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেবেন বলে ঘোষণা করেছিলেন। স্বীকৃতির ঘোষণা দেয়ার সঙ্গে সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্গট ওয়ালস্টয়েম বলেছেন, তাদের এই পদক্ষেপ ফিলিস্তিনের স্বশাসনের অধিকার নিশ্চিতকরণের পথে নেয়া হয়েছে। সুইডেনের স্বীকৃতির সঙ্গে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়া রাষ্ট্রের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩৫-এ। এর মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রসমূহ হলো আরব কিংবা মুসলিম, যারা ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়নি। আজকের ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের ইতিহাসকে প্রথম মহাযুদ্ধের সময় থেকে পর্যালোচনা করা যায়। প্রথম মহাযুদ্ধের আগে এখনকার ফিলিস্তিন ও ইসরাইল অধিকৃত প্রায় সকল স্থান তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। এই সময় রাশিয়া থেকে অর্ধ লক্ষাধিক ইহুদী জারের অত্যাচার থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উদ্দেশ্যে এই এলাকায় বসতি স্থাপন করে। প্রথম মহাযুদ্ধে তুরস্কের বিপক্ষে ব্রিটেনকে সমর্থন দেয়ার কারণে ব্রিটেন তখনকার আরব শাসকদের এই এলাকায় তাদের আধিপত্য দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও ফ্রান্সের সঙ্গে গোপনে একই এলাকায় তাদের দুই দেশের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বিস্তারে মনোযোগী হয়। ১৯১৭ সালে ব্রিটেন লর্ড বালফোরের ঘোষণামাফিক সিরিয়া ও লেবাননকে ফ্রান্সের প্রভাবাধীন রেখে ফিলিস্তিনে ইহুদীদের জন্য স্বদেশ স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এই এলাকা তার শাসনাধীনে রাখে। এই ঘোষণার পর ফিলিস্তিনে ইহুদীদের অভিবাসন দ্রুত বাড়ে এবং ফলত আরব ও ইহুদীদের মধ্যে সময়ান্তরিক দাঙ্গা হতে থাকে। ১৯৩০ ও ৪০-এর দশকে নাজিদের বর্ণবাদ প্রসূত অত্যাচার ইউরোপীয় ইহুদীদের এই ফিলিস্তিন এলাকায় অভিবাসনে তখনকার পশ্চিমা দেশসমূহের সহানুভূতি তাদের অনুকূলে নিয়ে যায়। ফলত, ১৯৪৭ তক ব্রিটেন শাসিত ফিলিস্তিনে প্রায় ৬ লক্ষাধিক ইহুদীর বাস স্থাপিত হয়ে যায়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে দু’ভাগে বিভক্তকরণের লক্ষ্যে এই এলাকায় বসবাসরত ৩০% ইহুদী জনগণের জন্য এই এলাকার ৪৫% এবং ৭০% আরবদের (মুসলিম ও খ্রিস্টান) জন্য ৩০% ভূমি নির্দিষ্ট করে দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকরণের প্রস্তাব গ্রহণ করে। আরবগণ জাতিসংঘের এই বিভক্তি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আরব সংখ্যাধিক্য ও ইহুদী সংখ্যালঘিষ্ঠতা নিয়ে একটি একক ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সৃজন দাবি করে। ১৯৪৭-এর শেষ ভাগে ব্রিটেন এই এলাকার শাসনভার ত্যাগ করার পর ১৯৪৮-এর ১৪ মে ফিলিস্তিনের ইহুদীরা বেনগুরিয়নের নেতৃত্বে ফিলিস্তিন এলাকার প্রায় ২২০০০ বর্গ কি.মি. এলাকা নিয়ে ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করে। পাশের আরব রাষ্ট্রের অনিয়মিত বাহিনী ও ফিলিস্তিনে বসবাসরত আরবগণ তখনই ইসরাইল আক্রমণ করে। নিজেদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে এবং প্রধানত অনিয়মিত বাহিনী দিয়ে আক্রমণ পরিচালনা করার কারণে ইহুদীরা আরবদের শোচনীয়ভাবে পরাজিত এবং ফিলিস্তিনের বৃহদাংশ থেকে তাদের বিতাড়িত করতে সমর্থ হয়। ১৯৪৯ সালে যুদ্ধবিরতির পর দেখা যায় যে ইহুদীরা কেবল মাত্র মিসরের আওতাধীন গাজা উপত্যকা (৩৬০ বর্গ কি.মি.) এবং জর্দানের শাসনাধীন পশ্চিম তীর (৫৮৬০ বর্গ কি.মি.) ও পূর্ব জেরুজালেম ছাড়া ফিলিস্তিনের ৮০% ভাগ দখল করে নিয়েছে। ফলত, নিজ বাসভূমিতে সাড়ে সাত লক্ষাধিক আরব উদ্বাস্তু হয়ে যায়। ১৯৬৭ সালে ইসরাইল অতর্কিতে পার্শ্ববর্তী মিসর ও জর্দান আক্রমণ করে এবং ৬ দিনের যুদ্ধে পূর্ব জেরুজালেম (পুরনো নগর ও পশ্চিমের দেয়ালসহ) ও পশ্চিম তীর জর্দান থেকে ছিনিয়ে নেয়, গাজা ও সিনাই উপত্যকা থেকে মিসরকে হটিয়ে দেয় এবং সিরিয়া থেকে গোলান মালভূমিকে নিজের দখলে আনে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের দাবি অবজ্ঞা করে ইসরাইল এসব এলাকা তার দখলে রাখে এবং ১০ লক্ষাধিক ফিলিস্তিনীকে নিজ বাসভূমিতে উদ্বাস্তুতে পর্যবসিত করে। পরে ১৯৭৯ সালে মিসরের সঙ্গে শান্তি স্থাপন প্রক্রিয়ায় ইসরাইল সিনাই থেকে এবং ২০০৫ সালে গাজা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম তাদের কর্তৃত্বাধীনে থেকে যায় এবং এই দুই স্থানে ইহুদীরা বসতি স্থাপন করে চলে। বর্তমানে পশ্চিম তীরে ২৬ লাখ লোকের বাস এর মধ্যে ২১ লাখ ফিলিস্তিনী আরব আর ৫ লাখ ইসরাইলী ইহুদী। এই ৫ লাখ ইহুদীর মধ্যে প্রায় ২ লাখ পূর্ব জেরুজালেমে বাস করে। ১৯৬৪ সালে আরব লীগ ইসরাইলের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা বা পিএলও প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৭০ থেকে প্রধানত ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা গেরিলা হামলার মাধ্যমে ইসরাইলী দখলদারিত্ব ও আরব ভূমিতে বসতি স্থাপন প্রতিরোধ করতে থাকে। একই সময়ে আরাফাতের নেতৃত্বে ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে অযৌক্তিকভাবে জর্দানের সঙ্গে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়। ১৯৭০-এর সেপ্টেম্বরে বাদশা হোসেনের নির্দেশে জর্দান থেকে ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা নির্বাসিত হয়। ১৯৭২-এর সেপ্টেম্বরে মিউনিক অলিম্পিক ক্রীড়ার সময়ে ফিলিস্তিনীদের সশস্ত্র প্রতিরোধের একাংশ আলফাতাহ ১১ জন ইসরাইলী ক্রীড়াবিদকে হত্যা করে। লেবানন কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বলতার কারণে এই মুক্তি সংস্থা ১৯৮০ সালে দক্ষিণ লেবানন প্রায় দখল করে নেয়। পরে ইসরাইল যুদ্ধের মাধ্যমে এই এলাকার কর্তৃত্ব অর্জন করে। ১৯৭৩ এর ২ মার্চ ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা সুদানে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে হত্যা করে বলে অভিযোগ করা হয়। ১৯৭৪-এর ১৩ নবেম্বর আরাফাত নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে শান্তির প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপের আওতায় আরাফাত জাতিসংঘে এসে নিরাপত্তা কাউন্সিলের সংশ্লিষ্ট প্রস্তাব অনুযায়ী ইসরাইলকে স্বীকৃতির প্রতিশ্রুতি এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্র স্থাপনের শর্ত হিসেবে ইসরাইলের বিরুদ্ধে সকল সহিংস তৎপরতা বন্ধ করার ঘোষণা দেন। এ ঘোষণা অনুযায়ী ১৯৪৯ সালের যুদ্ধ বিরতি রেখা-মধ্যবর্তী এলাকায় ইসরাইলী রাষ্ট্রের অস্তিত্ব স্বীকার করে পশ্চিম তীর ও গাজাতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র সৃজনের পরিকল্পনা দেয়া হয়। এর পরে মাদ্রিদ ও অসলোতে ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র ও ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার মধ্যে দীর্ঘ আলোচনার প্রেক্ষিতে ১৯৯৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বরে প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টনের মধ্যস্থতায় ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তি স্থাপনের সম্মত নীতিসমূহের ঘোষণা দেয়া হয়। এ ঘোষণায় বলা হয় যে, তখন থেকে ইসরাইল ১৯৬৭ সালে যুদ্ধে দখলকৃত ফিলিস্তিনী ভূমি ফেরত দেবে আর ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা ইসরাইলের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ পরিহার করবে। এই ঘোষণায় বিবৃত ও দু’পক্ষের গৃহীত সূত্রাদি চুক্তি নামে খ্যাতি লাভ করে। এই ঘোষণার প্রেক্ষিতে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির আশায় ইয়াসির আরাফাত এবং ইসরাইলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাবিন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেরেসকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়। এইভাবে গৃহীত নীতি অনুযায়ী ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার বিকল্প ও উত্তরাধিকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১৯৯৪ এর ১ জুলাই ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ গাজা ও পশ্চিম তীরের (তথা প্রস্তাবিত ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের) নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। এই পটভূমিকায় প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টন জুলাই ২০০০-এ ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাত ও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী ইহুদ বারাককে শান্তি স্থাপনে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাম্প ডেভিডে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন। জানা যায় যে, তাঁর মধ্যস্থতা অনুযায়ী ইসরাইল পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে গাজা ও পশ্চিম তীর থেকে সরে এসে পূর্ণাঙ্গ অবয়বে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র সৃষ্টি করতে রাজি হবে এবং এর বিনিময়ে ফিলিস্তিনীরা আল-আকসা মসজিদের পশ্চিম দেয়ালের ধর্মীয়ভাবে ইহুদীদের কাছে তাৎপর্যমূলক অংশের ওপর ইসরাইলী সার্বভৌমত্ব মেনে নেবে এবং জর্দান উপত্যকা থেকে তিনটি প্রতিরক্ষামূলক সেনা চৌকি থেকে ক্রমান্বয়ে সরে আসবে বলে দু’পক্ষ সম্মত হয়। পরে আরাফাত এই সমঝোতা মেনে নিতে অস্বীকার করেন এবং ইসরাইলের বিরুদ্ধে সহিংসতা অব্যাহত রাখেন। এই সহিংসতার প্রেক্ষিতে ইসরাইল আরাফাতকে ইসরাইলের শত্রু হিসেবে ঘোষণা করে। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণাধীন গাজা ও পশ্চিম তীর প্রধানত জাতিসংঘ ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশের সহায়তায় অর্থায়িত ও পরিচালিত হয়ে আসছে। এই প্রশাসন নিয়ে আরাফাতের বিরুদ্ধে ও ফিলিস্তিনীদের মধ্যেও বিরোধিতার সৃষ্টি হয়। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের নিরিখ অনুযায়ী প্রাপ্ত সহায়তা থেকে আরাফাত ৯০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার তার ব্যক্তিগত নিয়ন্ত্রণাধীন বিশেষ তহবিলে স্থানান্তর করেন বলে বিদিত হয়। ২০০৪-এর ১১ নবেম্বর আরাফাত মারা যান এবং তার জায়গায় সাময়িক কোন্দলের পর মাহমুদ আব্বাস ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। অভিযোগ ওঠে যে আরাফাতকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছিল। অবশ্য আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানে এ অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়নি। মাহমুদ আব্বাসকেও সকল ফিলিস্তিনী বা সংগঠন একমাত্র নেতা হিসেবে মেনে নেয়নি। মাহমুদ আব্বাস পশ্চিম তীরের রামাল্লায় তার সদর দফতর স্থাপন করে প্রত্যক্ষভাবে পশ্চিম তীরের এবং পরোক্ষভাবে গাজার বেসামরিক শাসন চালাতে থাকেন। অসলো চুক্তি অনুযায়ী ২০০৫-এর ১ সেপ্টেম্বর ইসরাইলী প্রতিরক্ষা বাহিনী গাজা উপত্যকা থেকে সরে যায়। এবং ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ আকাশ ও সমুদ্রপথ ছাড়া গাজার সকল বিষয়ে প্রশাসনিক ক্ষমতা লাভ করে। ২০০৬ নির্বাচনে ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার অনুসারীদের হারিয়ে উগ্রপন্থী ফিলিস্তিনীয় সংস্থা হামাস জিতে গাজার শাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে অসলো চুক্তি অনুসরণ করতে এবং ইসরাইলের অস্তিত্ব মানতে অস্বীকার করে। ২০০৭ সালে হামাস গাজা থেকে তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ফাতাহকে বহিষ্কার করে। হামাসের এসব সিদ্ধান্ত ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই নেয়া হয়। এসব সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়ে হামাস সদস্যরা সম্ভবত ভুলে যান যে গাজার অর্থনীতি পূর্ণাঙ্গভাবে ইসরাইল ও মিসরের ওপর নির্ভরশীল এবং নিজেদের মধ্যে একতার অভাব তাদের অধিকতর দুর্বল করবে। ক্রয় ক্ষমতার সমতা অনুযায়ী গাজার মাথাপিছু আয় বার্ষিক ৩১০০ মার্কিন ডলার এবং এর শতকরা ৭০ ভাগ জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। গাজায় জলপাই, কমলালেবু এবং ফুল উৎপন্ন হয়। শিল্প ক্ষেত্রে বস্ত্র, সাবান এবং কাঠজাত পণ্যাদি প্রধান। গাজার বিদ্যুত সরবরাহ ইসরাইল থেকে আসে এবং পানি সরবরাহ হয় মিসর থেকে। গাজার সঙ্গে প্রধান বাণিজ্য সম্পর্ক যুক্ত দেশ হলো ইসরাইল ও মিসর। গাজার শাসন পশ্চিম তীরের শাসনের মতোই (ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ) পূর্ণাঙ্গভাবে ইসরাইল, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের অনুকূলে প্রদত্ত আরব লীগ হতে প্রাপ্ত সাহায্য অনেকাংশে অজানা এবং অনিয়মিত। ২০১৪ সালে হামাস ও ফাতাহ গোষ্ঠী ঐকমত্যে পৌঁছে সেখানে ফিলিস্তিন ঐকমত্যের সরকার বা শাসন প্রতিষ্ঠা করে। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট আব্বাস তখনই ঐকমত্যের সরকার ভেঙ্গে দিয়ে হামাসকে বাদ দিয়ে গাজায় নতুন সরকার বা শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৬ সাল থেকে ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে বিরোধ ও সংঘাত চলতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র হামাসকে সন্ত্রাসী সংস্থা আখ্যায়িত করে তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ কোন আলোচনায় অংশগ্রহণ করে না। প্রধানত মিসরের মাধ্যমে হামাসের সঙ্গে পরোক্ষ যোগাযোগ রক্ষা করে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনীদের বিরোধ কমাতে অসলো চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র সময়ান্তরে পদক্ষেপ গ্রহণ করে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে হিলারি ক্লিন্টন মিসরের প্রেসিডেন্ট মোর্সির মাধ্যমে ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধ বিরতি অর্জনের জন্য সর্বশেষ চেষ্টা করেন ২০১২ এর নবেম্বর। এই যুদ্ধ বিরতি আগেকার সকল যুদ্ধ বিরতির মতোই হয়েছিল ক্ষণস্থায়ী। এই পটভূমিকায় ৩ মাস আগে হামাসের নেতৃত্বে ইসরাইলের অভ্যন্তরে গাজা থেকে রকেট হামলার ঘটনা ঘটে। এই রকেট হামলার মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের কোন অনুমোদন ছিল না। এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরাইল তার বিমান ও সেনাবাহিনী নিয়ে গাজায় অতর্কিতভাবে সামরিক ও বেসামরিক লক্ষ্যবস্তু নির্বিশেষে আক্রমণ চালায়। হাজার হাজার বেসামরিক ফিলিস্তিনী নিহত ও বাস্তুচ্যুত হয় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এই ধ্বংসলীলায় প্রায় ১৮ লাখ নিরপরাধ জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হন। পরে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপ এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাপে দু’পক্ষই যুদ্ধ বিরতিতে উপনীত হয়। উপরোক্ত পটভূমিকায় সুইডেন কর্তৃক ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়ার তাৎপর্য দু’ভাবে প্রতিভাত হতে পারে। এক, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অনুকূলে স্বীকৃতি প্রদান এ ক্ষেত্রে অসলো চুক্তি অনুসারে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টনের মধ্যস্থতায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের প্রস্তাব অনুযায়ী ফিলিস্তিন এলাকায় যে দুই রাষ্ট্রের সৃজন সংবলিত শান্তি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে তারই সাহসিক এবং প্রকাশ্য অনুসমর্থন। এ ক্ষেত্রে স্মরণ রাখতে হবে যে সুইডেনের এ স্বীকৃতি ইসরাইলকে অস্বীকার করা বা অস্বীকৃতি দেয়ার নামান্তর নয়। ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া সুইডেনের এই ঘোষণা অনস্বীকার্যভাবে এই এলাকায় নিরাপত্তা কাউন্সিলের সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত প্রস্তাব ও অসলো চুক্তি অনুযায়ী ২টি সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বীকৃতির নামান্তর। দুই, এ স্বীকৃতি ফিলিস্তিনীদের অনুকূলে ১৯৪৮ থেকে প্রায় ভুলে যাওয়া পশ্চিমা রাষ্ট্র ও জাতিসংঘের দায়িত্ব পালনের প্রয়োজন স্মরণ করণীয় স্মারক। একইসঙ্গে ফিলিস্তিনে যুগ যুগ ধরে মানবাধিকার লঙ্ঘন করার লজ্জাজনক পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিশ্ব নেতৃবৃন্দের অবহেলার প্রতিবাদ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে সরকার প্রতিষ্ঠা ও পরিচালন সর্বস্থানে জনগণের অলঙ্ঘনীয় অধিকার হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। ফিলিস্তিনীদের ক্ষেত্রে জনগণের এ অধিকার এখন পর্যন্ত সমুন্নত করা বা রাখা হয়নি। ইতিহাসের পটে ফিলিস্তিনীদের দুর্দশার কারণ : (১) বালফোর ঘোষণা অনুযায়ী ইহুদীদের জন্য আরব ভূমিতে ইহুদীদের অভিবাসন ও ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা; (২) ফিলিস্তিনীদের প্রায় নিরবচ্ছিন্ন অন্তঃকলহ; (৩) পার্শ¦বর্তী আরব দেশসমূহের ফিলিস্তিনীদের অনুকূলে অপর্যাপ্ত ও অসমন্বিত সহায়তা ও সমর্থন; (৪) যুক্তরাষ্ট্রসহ অধিকাংশ পশ্চিমা দেশের তরফ থেকে ইসরাইলকে সমর্থন এবং অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তি সহায়তা প্রদান; (৫) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে ইসরাইলের আপেক্ষিক অগ্রগতি। (৬) ফিলিস্তিনের পক্ষ হতে অধিকতর বাস্তবধর্মী নীতি অনুসরণ না করা। এবং (৭) বিশ্বের প্রধান প্রধান মানবাধিকার সংগঠন কর্তৃক ফিলিস্তিনের মানবিক বিপর্যয়কে অবহেলা করা। এই কারণগুলো স্মরণে রাখলে এ কথা প্রতীয়মান থাকে যে, সুইডেন কর্তৃক ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের স্বীকৃতি এই এলাকায় শান্তি ও সৌহার্দ্য স্থাপনের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক স্থাপন করেছে। কিন্তু এই মাইলফলক পার হলেই এই এলাকায় শান্তি স্থাপনের প্রতিকূলে বিদ্যমান সকল কারণ দূর হবে না। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন হবে সকল ক্ষেত্রে মানব অধিকার সমুন্নত রেখে সাহসিকতা সম্পন্ন বাস্তববাদী নেতৃত্বের মোড়কে আরও বেগে এগিয়ে যাওয়া। লেখক : সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
×