ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও আমাদের সংবিধান

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ১১ নভেম্বর ২০১৪

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও আমাদের সংবিধান

(১০ নবেম্বরের পর) সেই সাথে গ্রামের উন্নয়ন, নগর ও গ্রামের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণ, কৃষিবিপ্লবের বিকাশ, গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার সৃষ্টি, শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের আমূল পরিবর্তনের ব্যবস্থা, গণমুখী সার্বজনীন শিক্ষা, অবৈতনিক বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, সময়ের সঙ্গে শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করা এবং শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রকৃত দেশপ্রেমিক নাগরিক সৃষ্টি, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, পুষ্টি ও জনস্বাস্থ্য এবং নৈতিকতার উন্নয়ন, সবার জন্য সুযোগের সমতা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবিচার থেকে মুক্তি, স¤পদের সুষম বণ্টন, কর্মের অধিকার ও কর্মকে কর্তব্যে পরিণত করা, নির্বাহী বিভাগ হতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ, নাগরিক ও সরকারী কর্মচারীদের কর্তব্য বিধান, জাতীয় সংস্কৃতির বিকাশ, ইতিহাস ও ঐতিহাসিক বস্তু এবং স্থানসমূহের বিকৃতি ও ক্ষতিসাধন রোধ, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার উন্নয়ন সবই আমাদের সংবিধানের প্রত্যয় ও প্রতিশ্রুতি। সেই সঙ্গে প্রতিটি নাগরিকের জন্য মৌলিক অধিকার-যথা আইনের দৃষ্টিতে সমতা, নারী ও পুরুষের সমান অধিকার, ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণের কারণে বৈষম্য দূরীকরণ, সরকারী নিয়োগলাভে সুযোগের সমতা, আইনের আশ্রয়লাভের অধিকার, জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার রক্ষা, গ্রেফতার ও অবৈধ আটক স¤পর্কে অধিকারের রক্ষাকবচ, জবরদস্তি শ্রম ও নিবর্তনমূলক আটকের ব্যাপারে বিধিবদ্ধতা, বিচার ও দ- স¤পর্কে বিধিবদ্ধতা রক্ষাকরণ, ভ্রমণের স্বাধীনতা, সংগঠনের অধিকার, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক্ স্বাধীনতা, পেশা, ধর্ম পালন ও স¤পত্তি ভোগের অধিকার, গৃহ ও যোগাযোগের রক্ষণ, মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নের অধিকার। এ সবই আমাদের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করে। এই সকল অধিকার বিশ্বজনীন মানবাধিকার সনদে এবং আন্তর্জাতিক দুটি অঙ্গীকারনামায় সন্নিবেশিত। উপরন্তু মানবিক মর্যাদা ও মানবসত্তার মর্যাদা আমাদের সংবিধানেই শুধু স্থান লাভ করেছে। কারণ, যুগ যুগ ধরে আমাদের এ অধিকার স্বেচ্ছাচার, স্বৈরাচার ও শক্তিধরদের কাছে নিষ্পেষিত হয়ে বংশপরম্পরায় আমরা স্বেচ্ছাচারী শাসকদের দুঃশাসনের শিকার হয়েছি। প্রতিটি মানুষ ও তাদের পরিবার বংশপরম্পরায় শোষণ, বঞ্চনা, অন্যায় ও অত্যাচারের শিকার ও সাক্ষী। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে, সংবিধানের প্রস্তাবনায়, ৭ ও ১১ অনুচ্ছেদে মানবিক মর্যাদা ও মৌলিক অধিকার এবং রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে বাংলাদেশের জনগণের ক্ষমতায়ন, স্বাধীনতার চেতনা ও গণতন্ত্র, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও বাস্তবায়নের দৃঢ় প্রত্যয় এবং অভিপ্রায়ের প্রকাশ ঘটেছে। জাতিসংঘ সনদ, সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র, আন্তর্জাতিক দুটি অঙ্গীকারনামায় সংবলিত মূল ভাবধারার সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও সংবিধানের মূলনীতিসমূহ একীভূত। আমাদের সংবিধান ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সৃষ্টি হয় এক রক্তক্ষয়ী ঐতিহাসিক সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মানব সভ্যতার বিরুদ্ধে প্রচ- হুমকিস্বরূপ হিটলারের আবির্ভাব পৃথিবীতে যেমন এক অসহনীয় ত্রাসের সৃষ্টি করে, তেমনি ’৭১-এর নৃশংস গণহত্যা, ভয়াবহ অত্যাচার, মর্মান্তিক অবিচার ও সামরিক ব্যাভিচারের মাধ্যমে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী মানবতাবিরোধী অপরাধের আরেকটি কলঙ্কময় অধ্যায় সৃষ্টি করেছিল। বিশ্বজুড়ে ফ্যাসিবাদের একই রূপ। মানব সভ্যতা ও মানবাধিকারের বিরুদ্ধে একই হুমকি কখনও বাংলাদেশের নর-নারী ও শিশুকে নরকঙ্কালে, গলিত মৃতদেহে, গণকবরে ও শবদাহে পরিণত করেছে। কখনও বসনিয়া, রুয়ান্ডা, ইথিওপিয়া অথবা প্যালেস্টাইনের শিশু, নারী ও নিরীহ জনগণের ওপর হামলা, হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বা আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর অত্যাচার বা আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ানদের নির্মূলন ও কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের অধিকারহরণ, মধ্যযুগে আফ্রিকার মানুষদের নিয়ে পশ্চিমা দেশে দাস বিক্রির ব্যবসা, শোষণ ও লুণ্ঠনের জিঘাংসা, হিটলারের গ্যাস চেম্বার ও সশস্ত্র সংঘর্ষে বিভিন্ন দেশে গণহত্যা, ধর্মের নামে জঙ্গী হামলা এসব অন্যায় যুদ্ধ যেমন মানব সভ্যতার বিরুদ্ধে ভ্রƒকুটি তেমনি বাংলাদেশের গণহত্যা, গণকবর, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা, নারী ধর্ষণ, লুট ও অগ্নিসংযোগ, গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া, এক জনপদ থেকে অপর জনপদে বাস্তুহারা মানুষের দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর মিছিল, শরণার্থীদের আশ্রয় শিবিরে গুলিবর্ষণ, শিশুহত্যার পৈশাচিকতা এ সবই বাঙালী জাতির কালরাত্রির দুঃস্বপ্নের মতো বিশ্ব মানবাধিকারের বিরুদ্ধে তীব্র ভ্রƒকুটি। বাংলাদেশের বীর যোদ্ধাদের লড়াই ছিল জঘন্য গণহত্যার বিরুদ্ধে মানুষের মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দৃঢ় অঙ্গীকার। তাই বাংলাদেশের সব মানুষই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার বীর যোদ্ধা। সেই গৌরবোজ্জ্বল বীরত্বের ঐতিহ্য নিয়ে বাঙালী তাই এগিয়ে চলেছে জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা ও প্রতিটি মানুষের মানবিক সত্তার মর্যাদা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। স্বাধীনতার চেতনাবোধ আর স্বাধীন সত্তার গৌরবম-িত অধিকারের উচ্চারণ ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ।’ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে বাঙালী জাতি স্বাধীন সত্তা প্রতিষ্ঠা করেছে; কিন্তু ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’ এই উপলব্ধি আজও বাস্তবায়িত হয়নি। সংবিধানের কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য অক্ষুণœ রাখার পবিত্র অঙ্গীকার বারবার ব্যর্থ হয়েছে। ’৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা, জাতীয় চার নেতাকে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে নৃশংসভাবে হত্যা বাঙালী জাতির ললাটে কলঙ্ক লেপন করেছে। এই কলঙ্কের সঙ্গে যোগ হয়েছে একটার পর একটা ব্যর্থতা। সংবিধানে স্বাধীনতার প্রথম স্বাক্ষরে জাতির পিতা উচ্চারণ করেছিলেন ‘জনগণ সকল ক্ষমতার মালিক’ এবং ‘যে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা স¤পত্তির নিশ্চয়তা বিধান হবে আইনের আশ্রয় লাভের মাধ্যমে।’ ৪৩ বছর পর, ’৭১-এর গণহত্যার বিচার আজ চলছে। স্বাধীনতার প্রাণ-পিতাকে হত্যা করা হলো। তাঁর জীবন ও দেহের নিরাপত্তা ঘাতকরা ছিনিয়ে নিল। সেই জঘন্য অপরাধের বিচার হয়ে কারও কারও শাস্তি হলেও কিছু ঘাতক এখনও পলাতক। তেমনি বিচার হয়নি আরও অনেক হত্যা ও অপরাধের। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে কেউ বন্দীশালায়, কেউ পুলিশ হেফাজতে কেউবা স্বগৃহে বা শিক্ষাঙ্গনে। অজস্র হত্যা, ধর্ষণের বিচার এখনও হয়নি। অনুসন্ধান বা তদন্ত থামিয়ে দেয়া অথবা ধামাচাপা পড়েছে নানাভাবে। এভাবে অতীতে রাজনীতিকে অপরাধ আর সন্ত্রাসের সঙ্গে সংযুক্ত করে সমাজকে ধ্বংসের শেষসীমায় নিয়ে যাওয়া হয়। আইন এবং আদালতকে করা হয় নীরব দর্শক। রাজনৈতিক ও সন্ত্রাসী হত্যাকা- সংঘটিত করে জনগণের মৌলিক অধিকারকে শৃঙ্খলিত করা হয়। আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার, জীবন এবং দেহের নিরাপত্তা এসব থেকে জাতির পিতা ও তাঁর পরিবারের মতো সাধারণ মানুষও হয় বঞ্চিত। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী শাহ এএসএমএস কিবরিয়া গ্রেনেড হামলার শিকার হন। তারই প্রতিবাদে ২০০৪-এর ২১ আগস্ট সন্ত্রাসবিরোধী জনসভায় গ্রেনেড হামলা করা হয়; লক্ষ্য ছিল বঙ্গবন্ধু তনয়া বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব। শীর্ষ নেতৃবৃন্দের নিরাপত্তা বেষ্টনির চাদরের মধ্য থেকে শেখ হাসিনা প্রাণে রক্ষা পান। কিন্তু আইভি রহমানসহ ২২ জন নেতাকর্মী নিহত ও শতাধিক জন আহত হন। তার সঠিক তদন্ত করতে দেয়া হয়নি। তদন্তের নামে আসল আসামিদের আড়াল করে জজ মিয়ার নাটক তৈরি করা হয়। এই ঘৃণ্য ও পৈশাচিক ঘটনার নেপথ্য পরিকল্পনায় যারা ছিল; যারা ঘটনার পূর্বে ও পরে সহায়তা করে অর্থ ও অস্ত্র যোগান দিয়েছে-তারা এখনও আড়ালে থেকে ষড়যন্ত্র করে চলেছে। এ কোন্্ আইনের শাসন? এ কোন্্ মানবাধিকারের বাস্তবায়ন? আইনী প্রক্রিয়ার এই সীমাবদ্ধতা বা অক্ষমতা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন; আইনের শাসনের এমন অসহায় পরাজয় জনগণ মেনে নেয়নি। (চলবে)
×