ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ট্রাইব্যুনাল আপীলের রায় হাতে পেলেই মৃত্যু পরোয়ানা জারি করবে

প্রকাশিত: ০৫:২১, ১০ নভেম্বর ২০১৪

ট্রাইব্যুনাল আপীলের রায় হাতে পেলেই মৃত্যু পরোয়ানা জারি করবে

আরাফাত মুন্না ॥ একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধী কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী মৃত্যুদ-প্রাপ্ত জামায়াত নেতা মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকে দ- কার্যকরের বিষয়ে দেশের প্রচলিত আইনের সব সুযোগই দেয়া হতে পারে। সুপ্রীমকোর্টের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের পর এই যুদ্ধাপরাধী রায় রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন করারও সুযোগ পেতে পারেন। এমনটাই ধারণা সংশ্লিষ্টদের। ধারণা করা হচ্ছে, রিভিউ নিয়ে চলমান বিতর্কের সমাধানে খুব শীঘ্রই কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদনের বিষয়ে আপীল বিভাগের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপিও প্রকাশ করা হবে। এর মাধ্যমেই সকল বিতর্কের সমাধান হবে বলেই আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে, কামারুজ্জামানের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের আগে দ- কার্যকর আইন সম্মত হবে না বলেই মত দিয়েছেন দেশের প্রখ্যাত আইনজীবীরা। তবে যুদ্ধাপরাধের কোন আসামি রিভিউ আবেদন করতে পারবেন না বলেই মত দিয়েছেন তাঁরা। তাঁরা আরও বলেছেন, এরপরও সুপ্রীমকোর্ট সংবিধান ও দেশের সকল আইনের অভিভাবক। সবশেষে সুপ্রীমকোর্ট যে সিদ্ধান্ত দেবে তাই চূড়ান্ত বলে মত দেন আইনজ্ঞরা। অন্যদিকে, আপীল বিভাগের রায় পেলেই ট্রাইব্যুনাল ফাঁসির আসামি মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করবে বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম। তবে সর্বোচ্চ আদালত রায়ের সংক্ষিপ্ত না পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি ট্রাইব্যুনালে পাঠাবে তা আপীল বিভাগের ওপরই নির্ভর করছে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। এছাড়া রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার সময়সীমার বিষয়ে আইনমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন তা সঠিক নয় বলে দাবি করেছেন মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের আইনজীবী শিশির মনির। এদিকে, যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তদের মৃত্যুদ- স্থগিত করতে আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। সংস্থাটি তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ আহ্বান জানিয়েছে। এতে বলা হয়, ১৯৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত জামায়াত নেতা মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকে দেয়া ফাঁসির রায় অবিলম্বে স্থগিত করা উচিত। মৃত্যুদ-াদেশের বিরুদ্ধে তার আপীলের সুযোগ দেয়া উচিত। এই সংস্থাটি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের শুরু থেকে এর বিরোধিতা করে আসছিল। এই সংস্থাটি এর আগেও যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে নানা ধরনের বিবৃতি দিয়েছে। আইনজ্ঞরা বলেছেন, দেশে এর আগে আরও এক যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে। সেখানেও তাকে সর্বোচ্চ আইনী সুবিধা দেয়া হয়েছিল। কাদের মোল্লা রিভিউ আবেদনও দায়ের করেছিলেন। তার রিভিউ আবেদনের ওপর দুই দিন শুনানি হয়েছে। পরে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদন খারিজ করেছে। তাকে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ারও সুযোগ দেয়া হয়েছিল। সেই হিসেবে কামারুজ্জামানকেও সর্বোচ্চ আইনী সুবিধা দেয়া হবে। তাঁরা বলছেন, নিয়ম অনুযায়ী, সুপ্রীমকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর রায়ের অনুলিপি বিচারিক আদালতে যাবে (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল)। পরে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যু পরোয়ানা জারি করবে। মৃত্যু পরোয়ান কারাগারে গেলেই কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদ-ের বিষয়টি অবহিত করে সরকার ও কারা কর্তৃপক্ষ দ- কার্যকরের সিদ্ধান্ত নেবে। এর মধ্যে তাকে প্রচলিত জেল কোড অনুযায়ী সাত দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার সময় দেয়া হবে। আইনজ্ঞরা আরও বলেছেন, যদি কামারুজ্জামান রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইতে না চান তাহলে যে কোন সময় তার দ- কার্যকর করা যাবে। এ বিষয়ে প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক উল হক বলেন, ফাঁসি হয়েছে এটা আসামির জানতে হবে। রায়ের কপি না পেলে আসামি ক্ষমা চাইবে কোন গ্রাউন্ডে। রায়ের কপি দেখেই আসামি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইবে। তবে রিভিউ আবেদনের বিষয়ে তিনি বলেন, রিভিউ হবে না। কারণ তা আইনে নেই। তিনি বলেন, সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে রিভিউর সুযোগ থাকলেও সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের জন্য ওই অধিকার বাতিল করা হয়েছে। এ বিষয়ে সুপ্রীমকোর্টের আরেক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক জনকণ্ঠকে বলেন, আইনে সব কিছু স্পষ্ট সাদা বা কালো বলে দেয়া থাকে না। সব কিছু বলে দেয়া সম্ভবও নয়। তিনি বলেন, যখন সব কিছু স্পষ্ট বলে দেয়া থাকে না, তখন ওই আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা থাকতে হয়। তিনি বলেন, যে ব্যক্তির আপীল গ্রহণ হয়নি, মৃত্যুদ- হয়েছে তার মৃত্যুদ- কার্যকরও হয়ে গেল। তবে কি কারণে তার মৃত্যুদ- হলো সে তা জানল না। এমন ভাবে কারও মৃত্যুদ-ই কার্যকর করা যৌক্তিক নয়। যৌক্তিক হলো যে ব্যক্তির আপীল খারিজ হয়েছে সে রায়টি পড়ুক, জানুক। কি কারণে তার আপীল খারিজ হয়েছে তা বুঝুক। শাহদীন মালিক বলেন, আপীল বিভাগের রায় হচ্ছে নজির। এ রায় মানে শুধু ওই ব্যক্তিই সাজা পেল তা নয়, অন্যরাও যাতে সতর্ক হয়। আর নজির মানে এই রায়টি সকলের জানতে হবে পড়তে হবে। সিদ্ধান্ত আপীল বিভাগের ॥ এ্যাটর্নি জেনারেল আপীল বিভাগের রায় পেলেই ট্রাইব্যুনাল ফাঁসির আসামি মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করবে বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম। তবে সর্বোচ্চ আদালত রায়ের সংক্ষিপ্ত না পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি ট্রাইব্যুনালে পাঠাবে তা আপীল বিভাগের ওপরই নির্ভর করছে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। রবিবার নিজ কার্যালয়ে এক ব্রিফিংয়ে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল রয়েছে, নাকি রদবদল হয়েছে সেটা আপীল আদালতের রায় পৌঁছালে ট্রাইব্যুনাল জানতে পারবে। আমি আগে বলেছি, একটা সংক্ষিপ্ত অর্ডারেই চলবে। তিনি বলেন, এখন আপীল বিভাগ যদি মনে করে, তারা শর্ট অর্ডার পাঠাবেন না, পূর্ণ আদেশই পাঠাবেন তাহলে সেটা তাদের বিষয়। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের মামলায় ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদ-ের রায়ের বিরুদ্ধে কামারুজ্জামানের আপীলে গত ৩ নবেম্বর সর্বোচ্চ সাজাই বহাল রাখে আপীল বিভাগ। এর এক দিন পর এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, যেহেতু আপীল বিভাগ ট্রাইব্যুনালের সাজাই বহাল রেখেছে, সেহেতু দ- কার্যকরে রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপির জন্য অপেক্ষার প্রয়োজন নেই। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে একই মত প্রকাশ করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানের মৃত্যুদ- কার্যকরের প্রস্তুতি নিতে তিনি কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন। আসামিপক্ষ মন্ত্রীর বক্তব্যকে এখতিয়ারবহির্ভূত আখ্যায়িত করে বলেছে, তারা রায় পর্যালোচনার আবেদন করবেন এবং এর আগে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার বিষয়টি নিয়ে তারা ভাবছেন না। দুই পক্ষের এই পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে অস্পষ্টতা তৈরি হওয়ায় যে কোন সময় কামারুজ্জামানের দ- কার্যকর হয়ে যেতে পারে বলে গুঞ্জন তৈরি হয়। ফলে সাংবাদিকরাও বার বার একই প্রশ্ন নিয়ে এ্যাটর্নি জেনারেল ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের সামনে যেতে থাকেন। মাহবুবে আলম বলেন, যখন ট্রাইব্যুনাল আপীল বিভাগের আদেশের কপি পাবে তাদের দ- বহাল থাকলে তখনই তারা মৃত্যুপরোয়ানা জারি করবে। জেলখানায় সেটা যাবে। তখন আসামিকে জানানো হবে যে, আপনার দ- বহাল রয়েছে এবং পরোয়ানা এসে গেছে। আরেক জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ করে আপীল বিভাগের দেয়া পূর্ণাঙ্গ আদেশের অনুলিপি প্রকাশ হলেই ‘রিভিউ’ নিয়ে অস্পষ্টতা ঘুচবে বলে মন্তব্য করেন এ্যাটর্নি জেনারেল। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আসামিপক্ষ বলছেন, তারা রিভিউ করবেন। আমি আগেরবারও বলেছি, ৪৭(ক) ধারা মতে আমি যা বুঝেছি, রিভিউ চলবে না। তারপরও কাদের মোল্লার রিভিউর রায়ে যদি দেখা যায় যে আদালত ‘রিভিউ চলবে’ বলে মত দিয়েছে, তাহলে সেটাই চূড়ান্ত হবে। আমি ধরে নেব আমার আগের মন্তব্য সঠিক ছিল না। তিনি বলেন, কাদের মোল্লার মামলার রিভিউ’র রায় যদি আমরা পেয়ে যাই, তাহলেই এ সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ্ব ঘুচে যায়। মাহবুবে আলম আরও বলেন, আমরা আইনজীবীরা যেভাবে বুঝি সেভাবে আইনের ব্যাখ্যা দেই। কিন্তু তখনই বিষয়টি চূড়ান্ত হয় যখন আদালত এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কাদের মোল্লার রায় প্রকাশিত না হলে আমার ব্যাখ্যা নিয়ে তো আসামিপক্ষ বসে থাকবে না। তারা নিশ্চই কোন একটা চেষ্টা করবে। তখন এমনিতেই কাদের মোল্লার ব্যাপারে আদালতের অবস্থান বেরিয়ে আসবে। এ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন, নিয়ম অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার জন্য সাত দিন সময় পাবেন আসামি কামারুজ্জামান। ‘যখন তাকে জানান হবে’ তখন থেকে এই দিন গণনা শুরু হবে। কাদের মোল্লার রিভিউর রায় না পাওয়া গেলে কামারুজ্জামানের রায় কার্যকর বন্ধ থাকবে কি না- এমন প্রশ্নে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আপীল বিভাগ স্থগিত না করলে রায় কার্যকর বন্ধ থাকবে না। আইন মন্ত্রীর বক্তব্য সঠিক নয় ॥ আসামি পক্ষ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের আইনজীবী শিশির মনির দাবি করেছেন, রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার সময়সীমার বিষয়ে আইনমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন তা সঠিক নয়। রবিবার দুপুরে সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে শিশির মনির এ দাবি করেন।
×