ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সরদার সিরাজুল ইসলাম

৭ই নবেম্বর পাকিস্তানী গুপ্তচরদের ক্ষমতা চূড়ান্তকরণের দিন

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ৭ নভেম্বর ২০১৪

৭ই নবেম্বর পাকিস্তানী গুপ্তচরদের ক্ষমতা চূড়ান্তকরণের দিন

স্মরণ করা যেতে পারে বঙ্গবন্ধুকে জুলফিকার আলী ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রথম স্বাধীনতার পর থেকেই ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে হত্যার একটি নীলনক্সা তৈরি করেন। যাতে ব্যবহৃত হয় তাদের বাঙালী দোসর। বিশেষ করে যারা মুক্তিযুদ্ধের লেবাস নিয়েছিল এবং ক্ষমতায় বসিয়েছিল জিয়াউর রহমানকে। কিন্তু ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যা আর তার দু’বছরের মধ্যেই খোদ ভুট্টোকে ফাঁসিতে (৭৭) ঝোলান পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জিয়াউল হক। ১৯৭৯ সালে জিয়াউল হক বিমান দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পরে বেনজীর ৫ বছর, নওয়াজ শরীফ কয়েক বছর ছাড়া পাকিস্তানের ৬৭ বছরের ৫০ বছরই সেনাবাহিনীর শাসন যা এই মুহূর্তে আবার নতুন করে সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।১৫ আগস্টের বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পরে জাতি প্রত্যক্ষ করল ২ নবেম্বর (৭৫) রাতে ঢাকা জেলে জাতীয় ৪ নেতা হত্যাকা-। ৭ নবেম্বর দিনটি ৭৫-পরবর্তী জিয়া, এরশাদ ও খালেদার সময় বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে ছুটিসহ সরকারীভাবে পালিত হতো স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসের চাইতেও বেশি গুরুত্বসহকারে, মহাধুমধামে। ভাবখানি এমন যেন এর আগে এদেশ স্বাধীন হয়নি। তাদের মতে এটি ছিল ভারতের তাঁবেদার রাষ্ট্র যা থেকে ১৫ আগস্ট, ৭৫ ভারতের দালাল মুজিবকে হত্যা করে হত্যাকারীরা দেশ উদ্ধার তথা স্বাধীন করেছে। আবার ২ নবেম্বর ভারতের তাঁবেদার সৈনিক ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ পুনরায় আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানো তথা ভারতের কাছে দেশকে হস্তান্তরের জন্য জিয়াকে গৃহবন্দী করে সেনাপ্রধান হন। কিন্তু ৬ নবেম্বর রাতে সিপাহী-জনতা খালেদ মোশারফের কথিত ষড়যন্ত্র নস্যাত করে জেনারেল জিয়াকে গৃহবন্দী থেকে উদ্ধার করে তাঁর অনিচ্ছা সত্ত্বে¡ও রাজতিলক পরিয়ে দিয়েছে। ১৫ আগস্ট থেকে ৭ নবেম্বর (৭৫) সময়কালে সংঘটিত ঘটনাকে বিএনপি যেভাবে দেখে তার চাইতে জাসদ ‘সিপাহী জনতার’ বিপ্লব বলে দাবি করলেও মৌলিক পার্থক্য সামান্যই। জিয়ার কৌশলে জাসদ ৭ নবেম্বরের ঘটনায় ছিল প্রধান চালিকাশক্তি। তারা জিয়াকে মুক্ত করার জন্য ক্যান্টনমেন্ট সিপাহীদের মধ্যে লিফলেট বিতরণ করেছিল এই বলে যে, খালেদ ভারতের দালাল। তাদের উত্তেজিত করার আরেকটি অস্ত্র ছিল সেনাবাহিনীতে অফিসারের কোন দরকার নেই ‘সিপাহী ভাই ভাই’ সেøাগান। এভাবেই ৩ নবেম্বর থেকে গৃহবন্দী বলে কথিত জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করার পক্ষে সাধারণ সৈনিকদের ব্যবহার করা সম্ভব হয়। (এ সময় অসংখ্য অফিসারকে জিয়ার অনুগতরা হত্যা করে)। জাসদের ভাষ্য অনুসারে তারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমের জন্য জিয়াকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল, কিন্তু জিয়া তাদের সঙ্গে সম্পাদিত ১২ দফা চুক্তি পরে অস্বীকার করে বেইমানি করেছে। জাসদ কথিত বিপ্লবের যে ব্যাখ্যা ’৭৫ সালে দিয়েছে সেখানেই এখনও অবস্থান করছে। জিয়া অনুসারীরা তাকে দুধে ধোয়া প্রমাণের চেষ্টায় বিগত বছরগুলোতে গোয়েবলসীয় প্রচারণায় ক্লান্ত হয়নি। কিন্তু এসব করেও তাকে দুধে ধোয়া বানাবার হাজার চেষ্টার মাঝেও যেসব ঘটনা এড়ানো যাবে না তা হচ্ছে- ক) ১৩ আগস্ট (৭৫) পূর্ব সপ্তাহে খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে জিয়ার দু’বার সাক্ষাত। খ) ১৫ আগস্ট সকালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে জিয়া খুনী ডালিমকে বলেছিলেন, “ণড়ঁ যধাব ফড়হব ধ ড়িহফবৎভঁষ লড়ন, শরংং সব, পড়সব ঃড় সু পধৎ.” গ) ১৫ আগস্ট দুপুরে জিয়াকে বঙ্গভবনে দেখা গেছে মোশতাকের সঙ্গে পরামর্শ এবং মন্ত্রিসভার সদস্য তালিকা প্রণয়নে স্বঘোষিত খুনীদের সাহায্য করতে। ঘ) ২৪ আগস্ট ’৭৫ খুনী মোশতাক তাঁকে সেনাপ্রধান নিয়োগ করেন। ঙ) ১৫ আগস্ট থেকে ২ নবেম্বর পর্যন্ত খুনী ফারুক-রশিদ গংয়ের নির্দেশে খুনী মোশতাক রাষ্ট্রপতির অভিনয় করেছেন আর ক্যান্টনমেন্টেও তাদের নির্দেশ মতো জিয়া চলেছেন। চ) জেল হত্যার জন্য জিয়া-ফারুক-রশিদকে নির্দেশ দেন এবং তারা মোশতাককে ঢাকা জেলে ফোন করতে বাধ্য করে। উল্লেখ্য, খুনী মোশতাকের সঙ্গে এই লেখকের ৯.১.৯০ তারিখে পুরান ঢাকার এক বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিল। ছ) জেনারেল জিয়া ১৯৭৬ সালের ৮ জুন বঙ্গবন্ধু ও জেল হত্যাকারী ১২ জনকে কূটনৈতিক মিশনের চাকরিতে নিয়োগ করেন। জ) ব্যাঙ্ককে এক সাক্ষাতকারে এবং ১৯৭৬ সালের ২ আগস্ট লন্ডন টেলিভিশনে এ্যান্থনি মাসকারেনহাস কর্তৃক গৃহীত খুনী ফারুক রশিদের সচিত্র সাক্ষাতকার প্রকাশিত হয়। এতে তারা বলেছেন, “১৯৭৫ সালের ২০ মার্চ সন্ধ্যায় জেনারেল জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত করে তারা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার অভিপ্রায় জানালে জিয়া বলেন, তোমরা জুনিয়র অফিসাররা আগ্রহী হলে এগিয়ে যেতে পার।” জিয়া সে সময় এবং পরবর্তী ৫ বছর বেঁচে ছিলেন; কিন্তু এর প্রতিবাদ করেননি। ফারুক-রশিদ কিন্তু তখনও বঙ্গভবন তথা ক্যান্টনমেন্টের হর্তাকর্তা। তাদের পালাতে সুযোগ দেয়া হয় ৬ নবেম্বর ’৭৫। ১৫ আগস্ট ও ৭ নবেম্বর সম্পর্কে ৮৩ সালে রশিদ-ফারুক স্যাটারডে পোস্ট পত্রিকায় যে সাক্ষাতকার দিয়েছিলেন তাতে সংশ্লিষ্ট বিষয়টির বিবরণ নিম্নরূপ: প্রথম কথা হচ্ছে জিয়া তার সৃষ্ট স্টাইলে নিজের বাসভবনে আটক ছিলেন। দ্বিতীয়ত, তাঁর ব্যক্তিগত দেহরক্ষী ও পদাতিক বাহিনীর একটি কোম্পানির প্রহরাধীন ছিলেন। সেখানে তার ব্যক্তিগত স্টাফ অফিসাররাও ছিলেন। বিদ্রোহ দমনের জন্য তিনি কোন চেষ্টা করেননি। বরং প্রেসিডেন্ট কর্তৃক বিদ্রোহ (খালেদ মোশারফদের) দমনের নির্দেশ পালনে অস্বীকার করেন। তার বাসভবনের টেলিফোন বরাবরই সম্পূর্ণরূপে কাজ করছিল। তার স্ত্রী আমাদের জানিয়েছেন যে, তিনি গ্রেফতার কিংবা আটকাবস্থায় নেই। তার সঙ্গে ফোনে কথা বলতে চাইলে তার স্ত্রী জানান, তিনি কতিপয় সামরিক অফিসারের সঙ্গে কথা বলছেন। চীফ অব আর্মি স্টাফ হিসেবে জিয়া সর্বদাই মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে জনগণ ও সৈনিকদের ধোঁকা দিয়েছেন। (তিনটি সেনা অভ্যুত্থান- লেঃ কঃ এম এ হামিদ)। ১৫ আগস্ট-পরবর্তী ঘটনাবলী নিয়ে সেনা অফিসাররা পত্রিকায় অসংখ্য প্রবন্ধ এবং একাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তবে ব্রিগেডিয়ার (অব) শাখাওয়াত হোসেন, পিএসসি, এনডিসি-(পরবর্তীতে নির্বাচন কমিশনার) এর ‘বাংলাদেশ রক্তাক্ত অধ্যায় (৭৫-৮৯)’ গ্রন্থের ১৫৫ নম্বর পৃষ্ঠায় একটি ব্যতিক্রমী তথ্য রয়েছে। এটি হচ্ছে ’৭৫ থেকে ১৯৮১-এর প্রায় সব কয়টি অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী অফিসারগণ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কোন না কোন পর্যায়ে পাকিস্তান হতে পালিয়ে যুদ্ধে যোগদান করেছেন। ব্রিগেডিয়ার শাখাওয়াতের এ তথ্য মোটামুটি সঠিক। তবে যে ৩১ অফিসার পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন তারা কি পালিয়ে এসেছিলেন? না তাদের পাক সরকার ছুটি দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধার লেবাস লাগাতে? সে প্রসঙ্গে বরং তাদের যে ছুটি দেয়া হয়েছিল সেটিই স্পষ্ট হয়। মেজর এএসএম সামসুল আরেফীনের ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান’ (ইউপিএল-১৯৯৫) গ্রন্থের ১৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে যে, ক্যাপ্টেন খোন্দকার আবদুর রশিদ পাকিস্তান থেকে অক্টোবর ’৭১ ছুটিতে এসে মুক্তিযোদ্ধা সেজেছেন। ফারুক বাংলা লিখতে পড়তে এমনকি বলতে পারে না এবং যার লেখাপড়া সবকিছু পাকিস্তানে (বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ৮-১১-৯৮) তার কি ঠেকা পড়ল মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার? এরা যে পাকিস্তানী গুপ্তচর ছিল তার বড় প্রমাণ ১৫ আগস্টের খুনীর তালিকায় তাদের নাম। বলা হয় খুনীদের বিরুদ্ধে এ্যাকশন নিতে জিয়ার অস্বীকৃতি তাই জিয়ার বদলে নিজে সেনাপ্রধান হয়ে চেন অব কমান্ড পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে দিয়েছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে খালেদ মোশারফ জিয়াকে আটক রাখার দায়িত্ব দিয়েছিলেন মেজর হাফিজকে। মেজর হাফিজ জিয়াকে যে আটক বা বন্দী করেননি তার বড় প্রমাণ জিয়ার অনুগত সৈনিকরাই তার বাড়িতে পাহারায় ছিল এবং জিয়া স্বয়ং কর্নেল তাহেরের সঙ্গে ফোনে কথা বলে সাহায্য চেয়েছিলেন। জিয়া ৩-৬ নবেম্বরের ঘটনাবলী থেকে নিজেকে দূরে রাখার নাটকে সফলতার পথে আর এক ধাপ এগিয়ে গেলেন এভাবে : ক) খুনী মোশতাককে সরাতে পারলেন। খ) খুনীদের দেশত্যাগ। গ) জেলে জাতীয় ৪ নেতা হত্যার মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতৃত্ব সঙ্কট সৃষ্টি। উল্লেখ্য, ২ নবেম্বর শেষ রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৭, ২০, ২২ আগস্ট (৭৫) থেকে আটক মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় ৪ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং কামরুজ্জামান এদের খুনী রশিদ, ফারুক কর্তৃক ঘাতক সৈনিক প্রেরণ করে হত্যা করা হয়। খালেদ মোশারফের সঙ্গে আর যে দু’জন শাহাদাতবরণ করেন তাদের মধ্যে কর্নেল হুদা শুধু মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তাই নয়, ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি। আর কর্নেল এটিএম হায়দার আজ স্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া একটি নাম। মুক্তিযুদ্ধের শীর্ষ পুরস্কার বীরউত্তম হায়দারকে ভুলে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। ১৬ ডিসেম্বর ’৭১ ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যাওয়ার যে দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী হয়ে আছে তাতে পাক জেনারেল নিয়াজীর একপাশে জেনারেল অরোরা আর অপর পাশে জ্যাকেট পরিহিত কোমরে পিস্তল, কাঁধে রাইফেলসহ যে যুবককে দেখা যায় তিনিই সেই মহান বীর এটিএম হায়দার বীরউত্তম। জিয়ার লোকেরা সেই ৭ নবেম্বরের প্রথম প্রহরে তাকেও হত্যা করেছে। শহীদ হায়দারের বোন ক্যাপ্টেন ডাঃ সেতারাও ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা-বীর- প্রতীক। বীর তাহেরকে অবশ্য জিয়ার জীবন রক্ষার ‘পুরস্কার’ দিয়েছিলেন ফাঁসিতে লটকিয়ে (জুলাই ’৭৬)। জাসদের অন্য নেতাদের জেলে রাখা হয়। জেলহত্যা বিচার ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকার আমলে শুরু করলেও (নবেম্বর-১২) তা এখন বিচারের ফাঁদে আপীল বিভাগ অভিমুখে। তাই চূড়ান্ত বিশ্লেষণে ৩-৭ নবেম্বর (৭৫) জাতীয় ৪ নেতাকে জেলখানায় হত্যা জেনারেল জিয়ার ক্ষমতারোহণ সৈনিক হত্যা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিনাশ একাত্তর ও পঁচাত্তরের ঘাতকদের পুনর্বাসন ও জাতীয় ঐক্য বিভাজনের কলঙ্কময় দিন হিসেবেই চিহ্নিত।
×