ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনে শেখ হাসিনার অবদান

প্রকাশিত: ২০:৪৯, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনে শেখ হাসিনার অবদান

(গতকালের পর) গণআদালত সম্পর্কে সরকারের এই অতি কঠোর মনোভাব ও হুমকি শহীদ জননী জাহানারা ইমামসহ নির্মূল কমিটির শীর্ষ নেতাদের যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ও বিচলিত করেছিল। আমরা কখনও রাজনৈতিক দল করিনি। রাজনৈতিক সহিংসতায় দুই পক্ষের কর্মী-সমর্থকরা লাশ হয়ে যায়, সে লাশ নিয়েও হয় রাজনীতি। কিন্তু আমাদের আন্দোলনের কারণে কেউ যদি লাশ হয় তার দায়িত্ব কে নেবে? ২৪ মার্চ থেকে সরকার যখন দূরপাল্লার সব বাস, লঞ্চ, স্টিমার, রেল বন্ধ করে বা সংখ্যা কমিয়ে দিয়ে রাজধানীকে সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল তখন আমাদের উদ্বেগ আরও বাড়ল। মানুষ আসতে না পারলে গণআদালত কিভাবে হবে? জাতীয় সমন্বয় কমিটির অন্যতম রূপকার জাসদের নিহত নেতা কাজী আরেফ আহমেদ আমাদের হতোদ্যম অবস্থা দেখে বললেন, আপনারা এ নিয়ে সরাসরি শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলুন। জাহানারা ইমামের সম্মতি পেয়ে তিনি নিজেই সাক্ষাতের ব্যবস্থা করলেন। ২৫ মার্চ বিকেল ৩টার দিকে আমরা বিরোধী দলের নেতার সরকারী ভবনে শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করি। জাহানারা ইমাম বললেন, সরকার যেভাবে ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে গণআদালত কীভাবে হবে? এ বিষয়ে আমাদের চেয়ে বেশি জানতেন শেখ হাসিনা। তিনি জাহানারা ইমামের কাছে জানতে চাইলেন, ‘গণআদালতে আপনারা কত মানুষ আশা করছেন?’ জাহানারা ইমাম বললেন, ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হবে। আমরা চার থেকে পাঁচ লাখ জনসমাগম আশা করছি।’ আমাদের সামনেই শেখ হাসিনা প্রথমে ফোন করলেন আদমজী জুট মিলের শ্রমিক নেতা রেহানকে। বললেন, খালাম্মা আমার সামনে বসে আছেন। আগামীকাল আদমজী ও নারায়ণগঞ্জ থেকে আপনারা পঞ্চাশ হাজার শ্রমিক পাঠাবেন। এরপর তিনি টঙ্গি, জয়দেবপুর ও আরও কয়েকটি জায়গায় ফোন করে স্থানীয় নেতাদের নির্দেশ দিলেন। জাহানারা ইমামকে তিনি বললেন, আমি আপনাদের কর্মসূচীতে দু’লাখ লোকের দায়িত্ব নিচ্ছি। বাকিটা আপনারা অন্য দলগুলোকে বলুন। জনসমাগমের বিষয়ে আশ্বস্ত হয়ে জাহানারা ইমাম বললেন, সরকার যে বলছে রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে, একজন মানুষও যদি নিহত হয় তার দায়িত্ব আমরা কিভাবে নেব? শেখ হাসিনা বললেন, কোন লাশ পড়বে না। যদি পড়ে সেটা আমি দেখব। শেখ হাসিনার এই আশ্বাস না পেলে বিএনপি সরকারের রক্তচক্ষু ও হুমকি উপেক্ষা করে আমরা গণআদালত করতে পারতাম না। শেখ হাসিনার প্রতিশ্রæতি অনুযায়ী আদমজী ও নারায়ণগঞ্জসহ ঢাকার কাছাকাছি শিল্প এলাকা থেকে অগণিত শ্রমিক-জনতা একযোগে বেরিয়ে এসে সকল ব্যারিকেড ভেঙ্গে/সরিয়ে ২৬ মার্চ যোগ দিয়েছিল গণআদালতে। শুধু বাংলাদেশের নয়, বিদেশী পত্রিকায়ও বলা হয়েছেÑ সেদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণআদালতের কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করার জন্য প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের সমাগম হয়েছিল। গণআদালতে কোন মাইক ছিল না। আগের রাতে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পূর্ব পরিকল্পিত মঞ্চ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পাঁচ শ’ মাইক লাগিয়েছিলেন মাঠের বাইরে যারা সমবেত হবে তাদের শোনার জন্য। পুলিশ মঞ্চ নির্মাণসামগ্রীসহ সমস্ত মাইক খুলে নিয়ে গিয়েছিল। এর ক্ষতিপূরণও শেখ হাসিনাই করেছিলেন। নির্দেশ অগ্রাহ্য করে গণআদালত আয়োজনের জন্য সরকার জাহানারা ইমামসহ ২৪ জন উদ্যোক্তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দায়ের করেছিল। এই চব্বিশ জনের ভেতর নির্মূল কমিটির প্রতিষ্ঠাতা, বরেণ্য বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী সংগঠনের নেতা এবং মুক্তিযুদ্ধের অধিনায়করাও ছিলেন। শেখ হাসিনা এতে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। ১৬ এপ্রিল (১৯৯২) জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা গণআদালতের যৌক্তিকতার পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন এবং ২৪ জনের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত রাষ্ট্রদ্রোহিতা মামলা প্রত্যাহার দাবি করে যে মর্মস্পর্শী ভাষণ দিয়েছিলেনÑ আমার বহু লেখায় এর উল্লেখ করে বলেছি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ এটি। তাঁর এই ভাষণের সময় বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে যা কখনও ঘটেনি সরকারী দলের অনেক সদস্য টেবিল চাপড়ে বিরোধী দলের নেতাকে সমর্থন করেছেন। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পাশে ছিলেন বিএনপির সহসভাপতি ফরিদা হাসান, যার স্বামী বিশিষ্ট শিল্পপতি সাইদুল হাসানকে মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্মমভাবে হত্যা করেছিল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। শেখ হাসিনার ভাষণ শেষ হওয়ার পর ফরিদা হাসান তার আসন থেকে নেমে এসে বিরোধী দলের নেতাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন। জাহানারা ইমামের আন্দোলনের গত ২৩ বছরে শেখ হাসিনা মাত্র তিনবার আমাদের সমাবেশে এসেছিলেন। প্রথমবার তিনি এসেছিলেন বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে ’৯২-এর ৩ মার্চ জাতীয় সমন্বয় কমিটির প্রথম সমাবেশে। অত্যন্ত আবেগপূর্ণ ভাষণ দিয়েছিলেন তিনি। এই ভাষণে তিনি বলেছিলেন, প্রয়োজন হলে বুকের রক্ত দিয়ে হলেও বাংলাদেশের মাটিতে আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করব। দ্বিতীয়বার তিনি আমাদের মঞ্চে এসেছিলেন ’৯২-এর ১৪ অক্টোবর। শেষবার এসেছিলেন ১৯৯৮ সালের ২৭ মার্চ নির্মূল কমিটির ৭ দিনব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ মেলা উদ্বোধনের জন্য। তখন তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। উদ্বোধনের পর গোটা মেলা ঘুরে দেখেছেন, নির্মূল কমিটির প্রতিষ্ঠাতাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেছেন। ঢাকায় সমন্বয় কমিটির যে কোন বড় সমাবেশের আগে জাহানারা ইমাম টেলিফোন করতেন শেখ হাসিনাকে। সমাবেশের মঞ্চ ও মাইকের ব্যবস্থা ছাড়াও জনসমাগমের বিষয় ছিল। স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে সাধারণ মানুষ একটি-দুটি কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করে বটে, তবে আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য নিয়মিত সভা-সমাবেশ করতে হলে সংগঠিত জনশক্তি প্রয়োজন, যা নিশ্চিত করতে পারে শুধু রাজনৈতিক দলগুলো। যে কারণে সমন্বয় কমিটির সমাবেশ তখনই বড় হতো যখন আওয়ামী লীগসহ শরিক দলগুলো সাধ্য অনুযায়ী জনসমাগম ঘটাত। ১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতার আসার পর আমরা দ্রæত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করে তাঁকে স্মারকপত্র দিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার শেষ করেই তিনি ’৭১-এর ঘাতকদের বিচার করবেন। ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে তিনি দেশে এবং বিদেশের অনেক বাধা উপেক্ষা করে সে কাজ আরম্ভ করেছেন। ২০০১ সালে জামায়াত-বিএনপির জোট সা-ল-সা নির্বাচন করে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নির্মূল কমিটির ওপর। সরকার গঠনের দেড় মাসের ভেতর আমাকে গ্রেফতার করেছিল। কারাগারে দেখেছি প্রতিদিন আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের হাত-পা ভেঙ্গে অর্ধমৃত অবস্থায় কারাগারের সেলে ছুড়ে ফেলে দিয়ে যেতে। আমার ওপর কী ধরনের নির্যাতন করা হয়েছে জেল থেকে বেরিয়ে তা উচ্চতর আদালতে জানিয়েছি। ঈদের দিন সব বন্দীকে বাড়ি থেকে পাঠানো খাবার খেতে দেয়া হয়। আমার স্ত্রী-পুুত্র-কন্যা আমার জন্য খাবার এনে তিন ঘণ্টা জেল গেটে দাঁড়িয়েছিলেন। তাদের দেখা পর্যন্ত করতে দেয়নি। এ খবর সব দৈনিকে বেরিয়েছিল। ডেইলি স্টারের প্রথম পাতায় এ নিয়ে সম্পাদক মাহফুজ আনাম বিশেষ সম্পাদকীয় লিখেছিলেন। কারাগারে থাকার সেই দুঃসহ দিনগুলোতে কিছু স্বস্তি ও সুখের মুহ‚র্তের কথাও মনে আছে। ঈদের আগের রাতে আওয়ামী লীগের মহানগরের নেতা বন্ধু মায়ার ছেলে দীপু একটা প্যাকেট এনে দিয়ে বলল, আঙ্কল এটা নেত্রী পাঠিয়েছেন, আপনার জন্য ঈদের উপহার। খুলে দেখি একটা সাদা নকশা করা পাঞ্জাবি। খালেদা জিয়ার নির্যাতন সেলে শেখ হাসিনার মমতাভরা উপহার পেয়ে অশ্রæ সংবরণ করতে পারিনি। জেল থেকে বেরুবার পর তিনি সুধাসদনে ডেকেছিলেন গ্রামের বাড়ি থেকে আনা পিঠা খাওয়ার জন্য। শুনেছেন কারাগারে কী ধরনের অত্যাচার করা হয়েছে আমাদের ওপর। তখন তাঁকে কোনও রাজনৈতিক দলের নেতা মনে হয়নি। নিতান্তই একজন মমতাময়ী বোন, যে কোন মানুষের কষ্টের কথা শুনলে যিনি বিচলিত হন। প্রধানত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্যই জামায়াতের জঙ্গী সন্ত্রাসীরা তাদের হিট লিস্টের এক নম্বরে রেখেছে শেখ হাসিনার নাম। জামায়াত জানে শেখ হাসিনা বেঁচে থাকলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করা যাবে না। বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানো যাবে না। যে কারণে জামায়াত এবং তাদের সহযোগী আন্তর্জাতিক প্রভুরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল, একই কারণে তারা বঙ্গবন্ধুর কন্যাকেও হত্যার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। জামায়াত ও জঙ্গীদের এসব ষড়যন্ত্র ও সন্ত্রাস প্রতিহত করেই কেবল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়া সম্ভব। শেখ হাসিনার সহযোগিতা, উদ্যোগ ও সাহসী সিদ্ধান্তের কারণে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের আন্দোলন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। বিজয়ের এই ধারা অব্যাহত রাখতে হলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কোন বিকল্প নেই। তিনি বহুবার বলেছেন, জামায়াত কোন রাজনৈতিক দল নয়, সন্ত্রাসী সংগঠন। আমরা আশা করব, তাঁর সরকার দ্রæত জামায়াত নিষিদ্ধকরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। (সমাপ্ত)
×