ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান

উচ্চতর আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার ॥ সমস্যা ও সমাধান

প্রকাশিত: ০৮:১৭, ১১ এপ্রিল ২০২০

 উচ্চতর আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার ॥ সমস্যা ও সমাধান

কোভিড-১৯ এর ভয়াল থাবায় সারা পৃথিবী আজ স্থবির। গতিহীন হয়ে পড়েছে সবকিছু। বাংলাদেশেও চলছে সাধারণ ছুটি। জরুরী প্রয়োজন ছাড়া শহর গ্রামের প্রত্যেক নাগরিককেই সামাজিক দূরত্ব মেনে নিজ নিজ ঘরে অবস্থান করতে অনুরোধ জানিয়েছে সরকার। স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়াতেই এই নির্দেশনা। গত ১৫ মার্চ থেকে সুপ্রীম কোর্টে গ্রীষ্মকালীন ছুটি চলছিল, তার সঙ্গে করোনাভাইরাসজনিত কারণে এই ছুটি প্রলম্বিত হয়। সারাদিন বাসায় বন্দী। ভাবলাম উচ্চতর আদলতে বাংলা ভাষা ব্যবহারের ওপর একটি প্রবন্ধ লিখব। প্রবন্ধটি সম্ভবত ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে লিখলেই ভাল হতো। যা হোক, ঘরে বসে ছুটি কাটানোর ফাঁকে আমার ভাবনা প্রসূত লেখা প্রবন্ধটি আইন ও বিচার সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে পাঠযোগ্য হবে বলে আশা করছি। বছর পাঁচেক আগের কথা। ২০১৫ সালের কোন একদিন, সঠিক তারিখটি আজ মনে পড়ছে না। আমি কলকাতা হাইকোর্টের অতিথিশালা সল্টলেকে অবস্থিত ‘বিজন ভবন’ থেকে সকালে বেরোচ্ছি। এমন সময় এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার সাক্ষাত। তার পরনে ছিল হালকা রঙের স্যুট, কপালে ছিল চন্দনের তিলক। দেখে বুঝতে পারিনি যে তিনি কোন সম্প্রদায় ও ভাষার মানুষ। জানতাম, কলকাতা হাইকোর্টে পশ্চিম বাংলার বাইরেরও অনেক বিচারপতির পোস্টিং হয়। স্বাভাবিক সৌজন্যতায় আমি তাকে সালাম জানিয়ে ইংরেজীতে আমার পরিচয় দিলাম। আমি ঢাকা থেকে এসেছি শুনে ভদ্রলোক আমার সঙ্গে হাত মিলিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন- ‘আরে মশাই বাংলায় কন, আমরা দু’জনেই তো বাঙালী’। তার এ ধরনের ঢাকাই ভঙ্গিমায় কথা শুনে আমি হতবাক। ভাবলাম তার পূর্ব-পুরুষ নিশ্চিত ঢাকার বসিন্দা ছিলেন। তার কাছ থেকেই জানলাম যে, তিনি পশ্চিম বাংলার বীরভূমের আদি বাসিন্দা। তিনি বিচারপতি শুভ্রকমল মুখার্জী। সময়ের আবর্তে তিনি আমার একজন অত্যন্ত প্রিয় মানুষ হয়ে ওঠেন। এখন তিনি আমার এক প্রিয় দাদা। ২০১৫ এর পরে কলকাতায় তার সঙ্গে আমার বহুবার দেখা হয়েছে। তার বাড়িতে গিয়েছি বেশ ক’বার। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের নবে¤¦র পর্যন্ত তিনি ছিলেন কর্নাটক হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি। কর্নাটকের রাজধানী ব্যাঙ্গালোরেও তার বাংলোয় আমাকে সপরিবারে নিমন্ত্রণ করেছেন। খুব প্রাণ খোলা মানুষ এই বিচারপতি শুভ্র কমল মুখার্জী। আরেক দিন বিজন ভবনের নিচে গাড়ি রাখার পার্কিং থেকে আমি গাড়িতে উঠব। ঠিক তখনই তিনি কোর্ট থেকে ফিরে গাড়ি থেকে নামছেন। এ সময় তার পিছু পিছু আরেকটি পতাকাবাহী গাড়ি এসে বিজন ভবনের নিচে থামল। ঐ গাড়ি থেকে একজন মহিলা বিচারপতি নামলেন। তার নাম বিচারপতি নিশিতা নির্মল মাহত্রী। মাহত্রী দেবীকে ডেকে বিচারপতি শুভ্র বাবু বলছিলেন -Madam, look, I am talking with a foreign Judge in my own language. ভদ্রমহিলা পুরোপুরি বুঝে ওঠার আগেই বিচারপতি শুভ্রকমল তার সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন- আমরা দু’জনই বাঙালী, আমাদের দেশ ভিন্ন কিন্তু আমাদের ভাষা এক। বিচারপতি নিশিতা মাহত্রী পরবর্তীতে কলকাতা হাইকোর্টের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন বেশ কিছুদিন। সেদিন অনুভব করেছিলাম নিজের ভাষার কাউকে কাছে পেলে মনটা উচ্ছ্বাসে গর্বে কতটা পূর্ণ হয়ে ওঠে। আমার সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো বাংলা আমার মাতৃভাষা। আমি একজন বাঙালী। বিচারিক অঙ্গনে নিজের ভাবনা জ্ঞান যুক্তি এই ভাষায় তুলে ধরার মানসিকতা ও দক্ষতা নিয়ে কিছু কথা ও প্রেক্ষাপট তুলে ধরার চেষ্টা করছি। পৃথিবীতে প্রায় ত্রিশ কোটি মানুষ বাংলায় কথা বলে। বাংলাদেশে প্রায় ১৮ কোটি, পশ্চিম বাংলায় ৯ কোটি আর ত্রিপুরা, মেঘালয়, আসাম ও ভারতের আরো কিছু রাজ্যসহ ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানকারী বাঙালীদের সংখ্যাও প্রায় ৩ কোটি। পৃথিবীতে বাংলা ভাষা-ভাষী জনগোষ্ঠীর অবস্থান পঞ্চম। ২০১৭ সালের টঘঊঝঈঙ-এর এক জরিপ অনুযায়ী পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি ভাষা হলো বাংলা। ভাষাটি যে খুবই মিষ্টি এটি উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী লতা মুঙ্গেশকর ও আশা ভোঁসলের গান শুনলেই বোঝা যায়। তাদের দুই বোনের কেউই বাংলা বলতে পারেন না। অথচ ইংরেজী অক্ষরে লিখে বা হিন্দী অক্ষরে লিখে যখন অত্যন্ত শুদ্ধ উচ্চারণে বাংলায় রচিত গানে তারা কণ্ঠ দেন তখন কোন্ বাঙালীর তা ভাল না লাগে? কার না মনে হয় তার জীবনেও একবার না একবার প্রেম এসেছিল। এ যেন বাংলা ভাষায় অঙ্কিত প্রেম যা হৃদয়কে দোলায়। বাংলা একটি ঐতিহ্যবাহী পুরনো ভাষা। অন্তত আজ থেকে এক হাজার বছর পূর্বে এ ভূখন্ডে বাংলা ভাষার প্রচলন। কিন্তু আধুনিক বাংলার প্রচলন শুরু হয় বোধ করি ইংরেজী ১৮০০ সালের পর থেকে। বিশ্ব সভায় বাংলাকে উঁচু স্থানে পৌঁছে দেয়ার পেছনে আমাদের অনেক কবি লেখক সাহিত্যিকের অবদান রয়েছে। তাদের সবার অবদানই সম্মান ও স্বীকৃতির দাবি রাখে। তবে একইসঙ্গে একথা সবাই আমরা স্বীকার করব যে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষাকে বিশ্বের দরবারে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। ১৯১০ সালের আগস্ট মাসে কবিগুরুর গীতাঞ্জলি প্রকাশিত হয়। বছর দুয়েক পরে ১৯১২ সালের নবে¤¦র মাসে তার ১০৩টি পদ্য নিয়ে ইংরেজী ভাষায় প্রকাশিত হয় ‘গীতাঞ্জলি’। বাংলা গীতাঞ্জলির ইংরেজীতে ভাষান্তর করেছিলেন কবিগুরু নিজেই। ১৯১৩ সালে বাঙালী অর্জন করে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার। কবিগুরু নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হলেন তার ‘গীতাঞ্জলি’ কবিতা গ্রন্থের জন্য। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর অবিভক্ত বাংলার মানুষ আমরা হয়ে গেলাম পাকিস্তানী। একটি নবসৃষ্ট মুসলিম রাষ্ট্রের অধিবাসী। আমাদের বাংলাদেশের ভূখ- একদিন পরিচিত ছিল পূর্ববঙ্গ হিসেবে। দেশ বিভাগের পর তা হয়ে গেল পূর্ব পাকিস্তান। শুরু থেকেই আমরা বাংলাভাষীরা হতে থাকি সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণ ও বৈষম্যের শিকার। আমাদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির ওপর নেমে আসতে থাকে পাকিস্তানী আঘাত। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় রেসকোর্স ময়দান, বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এক জনসভায় ঘোষণা করেন যে ‘উর্দু এবং শুধু উর্দুই হবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা’। অন্য কোন ভাষা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পাবে না। ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে এক বিশেষ সমাবর্তন সভায় জিন্নাহ আবারও ঘোষণা দেন যে কেবলমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এমন ঘোষণায় তদানীন্তন ছাত্র নেতা শেখ মুজিবসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাৎক্ষণিক প্রতিবাদে গর্জে ওঠে এবং ঐ সভাতেই তারা পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনকের সামনেই ‘না না’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত করে তোলে সভাস্থল। ঐ প্রতিবাদের রেশ থেমে থাকেনি। ১৯৫২ সাল এর ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনা আমার সবাই জানি। এটি এখন আমাদের ইতিহাসের গর্বিত অংশ। রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকাসহ সারা বাংলার রাজপথ প্রকম্পিত করে দাবি জানানো হলোÑ ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’। সেদিনের বাঙালীর এই প্রাণের দাবিকে পদদলিত করার জন্য পাকিস্তান সরকারের অনুগত পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীনের নির্দেশে ঢাকায় ছাত্র-জনতার ওপর চালানো হয় গুলি। প্রিয় মাতৃভাষার জন্য শাহাদাৎ বরণ করেন রফিক, সালাম, বরকতসহ অনেকে। শহীদদের তালিকায় ঠাঁই করে নেন তদানীন্তন ঢাকা হাইকোর্টের কর্মচারী শফিউর রহমান। ১৯৫৬ সালে তৎকালীন সরকার বাংলাকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্যতম ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু ১৯৫৬ সালের যে সংবিধান পাকিস্তান গণপরিষদে গৃহীত হয় সেখানে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে কোন ভাষারই উল্লেখ করা হয়নি। অথচ পাকিস্তান এবং ভারত একই সময়ে পৃথক দুটো রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীনতা পেলেও ভারতের গণপরিষদ তাদের সংবিধান রচনা করে ১৯৪৯ সালেই। ভারতীয় সংবিধানের ৩৪৩ (১) অনুচ্ছেদে ভারত রাষ্ট্রের দাফতরিক ভাষা হিসেবে হিন্দীকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় যা দেব নাগরী হরফে লিখিত হবে। ভারতের এই সংবিধানের ৩৪৩ (২) অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা আছে যে, উপ-অনুচ্ছেদ (১) এ যা কিছু বলা থাকুক না কেন সংবিধান রচনার সময় হতে ১৫ বছর সময় পর্যন্ত ইংরেজী ভাষায় সমস্ত দাফতরিক কাজ সম্পন্ন হবে। উপ-অনুচ্ছেদ ৩(এ) এ উল্লেখ করা আছে যে, ভারতের সংসদ আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে প্রয়োজনে ১৫ বছর পরও দাফতরিক ভাষা হিসেবে ইংরেজীকে ব্যবহার করতে পারবে। ভারতীয় সংবিধানের মর্মার্থ অনুযায়ী এটা বোঝা যায় যে, তারা হিন্দী ভাষাকে দাফতরিক ভাষা হিসেবে প্রচলনের একটি চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৪৫ অনুযায়ী প্রত্যেকটি রাজ্যের বিধানসভা ঐ রাজ্যের দাফতরিক ভাষা কি হবে তা নির্ধারণ করতে পারবে, তবে শর্ত থাকে যে, এ ধরনের কোন সিদ্ধান্ত না নেয়া পর্যন্ত ইংরেজীই তাদের দাফতরিক ভাষা হিসাবে গণ্য হবে। ভারতের সংবিধানের ৩৪৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রের দাফতরিক ভাষাই রাজ্যসমূহের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হবে। তবে শর্ত থাকে যে, যদি একাধিক রাজ্য হিন্দী ভাষাকে তাদের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে চায় তাহলে উভয় রাজ্যের বিধানসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সে ধরনের আইন বা উপ-আইন প্রণয়ন করতে পারবে। ভারতীয় সংবিধানের ৩৪৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ভারতীয় সুপ্রীম কোর্ট ও বিভিন্ন রাজ্যে অবস্থিত হাইকোর্টসমূহের কার্যক্রম বিশেষত রায়সমূহ ইংরেজীতে প্রদান করতে হবে। সংসদে অথবা বিধান সভায় সমস্ত বিল বা সংশোধনী ইংরেজী ভাষায় উত্থাপিত হবে। এক কথায় বলা যায়, ভারতীয় উচ্চ আদালত, সংসদ, রাজ্যসভা ও বিধানসভার কার্যক্রমের ভাষা ইংরেজী। (চলবে) লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২
×