ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সবই আজ ভুলে যাওয়া গীতি ॥ বিষণœ শুধু ফিরে দেখা

বৈশাখে গমগম করত ছায়ানট, বর্ণিল উৎসব চলত চারুকলায়

প্রকাশিত: ১১:১৫, ৯ এপ্রিল ২০২০

বৈশাখে গমগম করত ছায়ানট, বর্ণিল উৎসব চলত চারুকলায়

মোরসালিন মিজান ॥ তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,/বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক/এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ...। গত বছর এমন দিনে কত জায়গায় যে শোনা গেছে এই গান! এবার, হায়, কোন সুর কানে আসছে না! দিন রাত ছবি আঁকার সেই চেনা ছবিটি কোথাও নেই। লোক চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার আহ্বান, শেকড়ের সংস্কৃতিকে লালন করার তাগিদÑ সবই মনে মনে। আর যে ছায়ানট বা চারুকলা অনুষদে বর্ষবরণের মূল প্রস্তুতি চলত, দৃশ্যমান হতো প্রাক উৎসব, আজ তা যেন ভুলে যাওয়া গীতি। বিষণœ ফিরে দেখা। বাঙালীর সবচেয়ে বড় বর্ণাঢ্য এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার উৎসবটি পহেলা বৈশাখ। প্রতিবছর সকল ধর্ম বর্ণ এবং শ্রেণী পেশার মানুষ এ উৎসবে মাতেন। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন নিজস্ব সংস্কৃতির বোধ নিয়ে নতুন করে জেগে উঠে বাঙালী। ধর্মান্ধতা, মৌলবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যাওয়ার শপথ নেয়। বর্ণাঢ্য উৎসব উদ্যাপনের লক্ষ্যে চলে দীর্ঘ প্রস্তুতি। কিন্তু এবার উল্টো ছবি। আর মাত্র ক’দিন পর ১৪২৭ বঙ্গাব্দ। এক সপ্তাহরও কম সময় হাতে। অথচ প্রস্তুতি নেই কোথাও। সবখানে সুনসান নীরবতা। কারণ আর কিছু নয়, করোনাভাইরাসে প্রাদুর্ভাব। কভিড ১৯ এর সংক্রমণে বিপর্যস্ত পৃথিবী। তারই প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশে। গত ২৬ মার্চ থেকে চলছে সরকারী ছুটি। তারও আগে থেকে সবাই ঘরে। রাজধানীর রাস্তা ঘাট এখন ফাঁকা। সতর্কতামূলক পদক্ষেপের অংশ হিসেবে বাতিল করা হয়েছে বৈশাখের আনুষ্ঠানিকতাও। তাই এখন শুধু ফিরে দেখা। গত বছর এমন দিনে গম গম করতো ধানম-ির ছায়ানট ভবন। শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন মহড়ায় অংশ নিতেন। যেসব গান গেয়ে রমনার বটমূলে বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নেয়া হবে, সেগুলো সবাই মিলে গাইতেন। শুদ্ধতা নিশ্চিত করতে উপস্থিত থাকতেন শিক্ষকরাও। ভুলগুলো ধরিয়ে দিতেন। এবারও শুরু হয়েছিল মহড়া। কিন্তু কভিড ১৯-এর সংক্রমণ ঠেকাতে অচিরেই তা বন্ধ করে দেয়া হয়। বুধবার ছায়ানট ভবনে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানের দরজায় তালা। সব সময় ছোটছুটি করে যে চেনা মুখগুলো, তাদের কেউ কোথাও নেই। কথা বলার জন্য কাউকে পাওয়া গেল না। ভবনের সামনের বাগান, ফুলে থাকা ফুলগুলোও যেন বিষণœ। ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের মহড়া নিয়ে বহু বছর ব্যস্ত ছিলেন প্রতিষ্ঠানের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। ফোনে জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ছায়ানটের নিয়মিত অনেক কাজ আছে। তবে সারা বছর এ সময়টার জন্য আমরা অপেক্ষা করে থাকি। বিশেষ করে ছাত্র ছাত্রীরা বৈশাখের অনুষ্ঠানটিতে অংশ নেয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে। প্রতিদিন মহড়ায় অংশ নিতে আসে তারা। শত শত ছেলে মেয়ের আসা যাওয়া চলে ছায়ানটে। সঙ্গে আসেন অভিবাবকরাও। এবারও দৃশ্যটা দেখা গেছে। কিন্তু ওরা গাইতে পারল না। এতদিনে হয়তো ওদের জন্য একই ধরনের পোশাক তৈরি হয়ে যেত। প্রস্তুত হয়ে যেত রমনা বটমূলের মঞ্চ। অথচ কিছুই হলো না। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে তিনি বলেন, বেঁচে থাকলে আবার হবে। ভবিষ্যতে আরও বড় করে বর্ষবরণ উৎসব আয়োজনের স্বার্থেই সকল শিল্পী শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ঘরে থাকার আহ্বান জানান তিনি। পাশাপাশি ছায়ানট করোনা সঙ্কটে অসহায় মানুষের পাশে থাকবে বলেও জানান তিনি। একই সময় মুখরিত থাকত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ। ক্যাম্পাসজুড়ে দৃশ্যমান হতো মঙ্গল শোভাযাত্রার বর্ণাঢ্য প্রস্তুতি। বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা ছবি আঁকতেন। খ্যাতিমান শিল্পীরাও সময় পেলে চলে আসতেন ক্যাম্পাসে। নবীনদের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি আঁকতেন। সরাচিত্রের কথা তো বলাই বাহুল্য। মাটির সরায় লোকজ ফর্ম। দেখে শহরটাকেও গ্রামীণ জনপদ বলে মনে হতো। হরেক রকমের মুখোশ, ফুল পাখি তৈরি হতো। আর লিচু তলায় গড়া হতো সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্ট্রাকচারগুলো। বিশালাকৃতির হাতি ঘোড়া বাঘ পাখি পুতুল ইত্যাদির কাঠামো তৈরি করা হতো। বুধবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, জনমানবহীন চারপাশ। সামনের তিনটি গেট-ই তালা দেয়া। বিচ্ছিন্নভাবে দু’একজনকে ঘোড়া ফেরা করতে দেখা গেলেও, তারা কেউ চারুকলার নয়। গত বছর বর্ষবরণ উপলক্ষে বাইরের দেয়ালে যেসব ছবি আঁকা হয়েছিল, সেগুলোর কিছু এখনও আছে। দেখে নষ্টালজিক হয়ে যেতে হয়। চারুকলার শিক্ষক শিক্ষার্থীদের অনুভূতি জানতে ফোনে কথা হয় অনুষদের ডিন শিল্পী নিসার হোসেনের সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, অন্যান্য বছর এ সময় দম ফেলার সুযোগ পেত না শিক্ষার্থীরা। আমরা টিচাররাও অনেক রাত পর্যন্ত এ কাজের তদারকি করতাম। কিন্তু এবার মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজনটি বাতিল করা হয়েছে। আমরা আগেই পরিস্থিতি অনুমান করতে পেরেছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ও বন্ধ ঘোষাণা করা হয়েছিল। ফলে প্রস্তুতিপর্বের বর্ণাঢ্য ছবিটি আর এবার আর দেখা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে আমরা মানুষের মঙ্গল কামনা করি। এবার অন্য বাস্তবতা। তাই মঙ্গল চিন্তা থেকেই তাদের ঘরে থাকতে বলছি। উৎসব সামনে রেখে সবাইকে মিলিত হওয়ার কথা বলেছি এতকাল। এবার বলছি, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। এবার মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা না গেলেও, মনের রংটা ধরে রাখার ওপর জোর দেন তিনি। বলেন, হতাশ হলে চলবে না। মনের শক্তি ধরে রাখতে হবে। পহেলা বৈশাখ ঘরে বসেও সুন্দর উদ্যাপন করা যেতে পারে। সেটি নিয়ে আমাদের চিন্তা করতে হবে। তবেই আরেকটি বৈশাখ আমরা পাব। এক বৈশাখে নীরব থেকে অযুত বৈশাখের আনন্দ মনে ধরে রাখার আহ্বান জানান তিনি।
×