ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অকারণে রাস্তায় মানুষ, শত চেষ্টায়ও ঘরে রাখা যাচ্ছে না

প্রকাশিত: ১০:৩৯, ৭ এপ্রিল ২০২০

অকারণে রাস্তায় মানুষ, শত চেষ্টায়ও ঘরে রাখা যাচ্ছে না

রাজন ভট্টাচার্য ॥ প্রাণঘাতী কোভিড-১৯ থাবায় গোটা বিশ^ যখন একেবারেই মহা-বেকায়দায় তখন অঘোষিত লকডাউন ও নানা নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও সাধারণ মানুষকে ঘরে রাখা যাচ্ছে না। রাস্তা, চা-স্টল, বাজার থেকে শুরু করে সবখানেই বিনা কারণে মানুষের ঘোরাঘুরি। যা দেখে অবাক খোদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের কারণে যেসব এলাকা ইতোমধ্যে লকডাউন করা হয়েছে সেখানেও মানুষকে ঘরে থাকতে দেখা যায়নি। ২৯টি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাতেও অকারণে ঘরের বাইরে মানুষ। অথচ নিরাপত্তার স্বার্থে সবাইকে বাড়ির বাইরে বের না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সেনা বাহিনী রাতদিন কাজ করছে। চলছে মাইকিং। সেইসঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে পাড়া মহল্লায় সচেতনতা বাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা অব্যাহত। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিভিন্ন দেশের পরিসংখ্যান বলছে, আক্রান্ত শুরুর একমাস পর বেশিরভাগ দেশেই রোগীর ও মৃত্যুর সংখ্যা লাফিয়ে বেড়েছে। দেশে প্রথম করোনার রোগী ধরা পড়ে আট মার্চ। এই হিসাবে আগামী আট এপ্রিল একমাস পূর্ণ হবে। এরমধ্যে গত তিনদিনের পরিসংখ্যান খুবই আতঙ্কের। অর্থাৎ একমাস পূর্ণ হওয়ার আগে দেশে রোগী যেমন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। এই প্রেক্ষাপটে সাধারণ মানুষকে ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধে আরও বেশি সচেতন হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন তারা। সেইসঙ্গে অন্যান্য দেশের মতো পরিস্থিতি বিবেচনায় কার্ফু অথবা জরুরী অবস্থা, আনুষ্ঠানিক লকডাউন ঘোষণারও পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, জাতিকে বাঁচাতে কঠোর পদক্ষেপ ছাড়া সামনের দিনগুলোতে বিকল্প কিছু নেই। জানতে চাইলে হেলথ এ্যান্ড হোপ লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাঃ লেলিন চৌধুরী বলেন, বিশে^র অনেক দেশে করোনার মহামারী ঠেকাতে কার্ফু অথবা জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। তবুও মৃত্যুর মিছিল বন্ধ করা যাচ্ছে না। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতজুড়ে ২১ দিনের লকডাউন চলছে। তবে আমরা কেন বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিচ্ছি না। সময় দ্রুত যাচ্ছে। কঠোর হওয়ার সময় এখনই। তাই আর ভুল করা যাবে না। মানুষকে বাঁচাতে পুরোপুরি লকডাউন করতে হবে। অন্যথায় জরুরী অবস্থা বা কার্ফু সময়ের দাবি বলে উল্লেখ করেন এই চিকিৎসক। তিনি বলেন, দ্রুত এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত না নিলে অন্যান্য দেশের মতো নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে বাংলাদেশও। তখন পরিস্থিতি সামাল দেয়া আরও কঠিন হতে পারে। রবিবার থেকে জরুরী সেবা কাজে নিয়োজিত ছাড়া কেউ বিনা অনুমতিতে ঢাকার বাইরে যাওয়া আসার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে পুলিশ সদর দফতর। বন্ধ গণপরিবহনসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তিনদফা সাধারণ ছুটি বাড়িয়ে ১৪ এপ্রিল করা হয়েছে। সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে মার্কেট ও সুপারশপ বন্ধের নির্দেশনা এসেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে। সেইসঙ্গে প্রাণঘাতী নোভেল করোনাভাইরাসের সামাজিক সংক্রমণ বৃদ্ধির শঙ্কা বাড়তে থাকায় সাধারণ নাগরিকদের মসজিদসহ কোন ধরনের ধর্মীয় উপাসনালয়ে না গিয়ে বাসায় থেকে নামাজ ও প্রার্থনা সারতে বলেছে সরকার। সৌদি আরবসহ বিশ্বের বিভিন্ন মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে মসজিদ বন্ধের সিদ্ধান্ত আসার পর দেরিতে হলেও বাংলাদেশ সরকার একই ধরনের নির্দেশনা দিল। সাধারণ মানুষের বক্তব্য জনস্বার্থের কথা বিবেচনায় নিয়ে আরও আগে এসব সিদ্ধান্ত কার্যকর করা উচিত ছিল। গত ২৬ মার্চ থেকে করোনা প্রতিরোধে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। একইসঙ্গে এখন পর্যন্ত গণপরিবহন দ্বিতীয় দফায় লকডাউন করা হয়। বন্ধ রাজধানীর বেশিরভাগ দোকানপাট ও বিপণী বিতান। পাড়া মহল্লার কিছু দোকান খোলা ছাড়া নগরজুড়ে কার্যত ভুতুড়ে পরিবেশ চলছে। এরমধ্যে গার্মেন্টস খোলায় রাজধানীতে মহা স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে প্রবেশ করে কয়েক লাখ শ্রমিক। যা করোনা বিস্তারে সবচেয়ে বড় রকমের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশ্ন হলো অঘোষিত লকডাউনের মধ্যে মানুষ ঘরের বাইরে কেন। সোমবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকাঘুরে দেখা গেছে, ৯০ ভাগের বেশি মানুষ বিনাকারণে ঘরের বাইরে ঘোরাফেরা করছেন। জরুরী সেবা ছাড়া সবকিছু বন্ধের পরও অনেকেই বাইরে মহা খুশিতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। যেন উৎসবের ছুটি। রবিবার রাজধানীর সবুজবাগের বাসাবো এলাকায় নয়জন করোনা রোগী ধরা পড়ে। সেখানে কয়েকটি গলি লকডাউন করা হয়েছে। জানা গেছে, বাসাবো এলাকায় বিদেশ থেকে আসা লোকজনের উপস্থিতি অনেক বেশি। ফলে পুরো এলাকাটিতে করোনা ঝুঁকি এখন শতভাগ। কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে একেবারেই সচেতনতা নেই। সকালে বাসাবো বালুর মাঠের পাশে রাস্তার ওপর বাজার বসে দিব্যি। সেখানে ক্রেতারা সবাই বাসাবো এলাকার। বাসাবো বাজারসহ আশপাশে ক্রেতা ও সাধারণ মানুষের বেশ ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। নয়টার পর পুলিশ এসে ভাসমান বাজার উচ্ছেদ করে। এরপর সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে জীবাণুনাশক স্প্রে ছিটানোসহ সড়কগুলোতে। বাসাবোর নন্দিপাড়া এলাকায় লকডাউন করা জিরো গলিতেও মানুষের অকারণে ঘোরাঘুরি দেখা গেছে। দুপুরে সবুজবাজের আহাম্মদবাগ, মায়াকানন, মুগদাসহ আশপাশের এলাকায় আসে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর টহল টিম। গলিতে যাদের পাওয়া যায়- তাদের বেশিরভাগই কোন কারণ ছাড়াই ঘোরাফেরা করছিলেন। এক পর্যায়ে পুলিশ সবাইকে ধাওয়া দিলে মুহূর্তের মধ্যেই ফাঁকা হয়ে যায় রাস্তা। সরিয়ে দেয়া হলো বিভিন্ন পণ্যের ভ্যানগুলোও। কিন্তু একঘণ্টা পর থেকে আবারও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে। রাস্তায় নামতে থাকেন সাধারণ মানুষ। স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি রাজধানী ঢাকায়। মোট আক্রান্ত রোগীর মধ্যে ঢাকার ৬৪ জন। যা সত্যিই ভাবনার বিষয়। এই বিবেচনায় গোটা শহরেই এখন করোনার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তাছাড়া ঢাকার ২৯টি এলাকা সুনির্দিষ্ট করে ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করছে সরকার। এসব এলাকার প্রত্যেকটিতেই করোনার রোগী মিলেছে। সারাদেশে ক্লাস্টার পাঁচ এলাকার মধ্যে ঢাকায় দুটি। মোহাম্মদপুরের আদাবর এলাকার সুনিবিড় হাউজিং-এর আশপাশে রাস্তা কাটা থাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়ি প্রবেশ করতে পারছে না। এই সুযোগে করোনা প্রতিরোধে ঘরে থাকার আহ্বানে সাড়া দিচ্ছেন না অনেকেই। যে যার মতো করে রাস্তায় ঘুরাফেরা করছেন সকাল-বিকেল। খোলা রয়েছে চা-স্টলসহ জরুরী প্রয়োজনের বাইরে সব রকমের পণ্যের দোকান। রাজধানীর যেসব এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ॥ স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী রাজধানীর ঝুঁকিপূর্ণ ২৯টি স্থানের মধ্যে করোনায় আক্রান্ত, বাসাবোয় ৯ জন, মিরপুরের টোলারবাগে ৬ জন, পুরান ঢাকার সোয়ারিঘাটে ৩ জন, বসুন্ধরায় ২ জন, ধানম-িতে ২ জন, যাত্রাবাড়ীতে ২ জন, মিরপুর-১০ ২ জন, মোহাম্মদপুরে ২ জন, পুরানা পল্টনে ২ জন, শাহ আলী বাগে ২ জন, উত্তরায় ২ জন। রাজধানীর বাকি ১৮টি স্থানে একজন করে করোনা রোগী পাওয়া গেছে। এ স্থানগুলো হলো বুয়েট এলাকা, সেন্ট্রাল রোড, ইস্কাটন, গুলশান, গ্রিনরোড, হাজারীবাগ, জিগাতলা, মিরপুর কাজীপাড়া, মিরপুর-১১, লালবাগ, মগবাজার, মহাখালী, নিকুঞ্জ, রামপুরা, শাহবাগ, উর্দু রোড ও ওয়ারী। রবিবার সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) পক্ষ থেকে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এসব এলাকার বেশ কয়েকটি মহল্লায় গিয়ে বিনা কারণে সাধারণ মানুষকে ঘর থেকে বের হতে দেখা গেছে। কেউ চা খেতে, কেউবা সিগারেট কিনতে বের হন। আবার কেউ ঘরে বসে থাকতে সময় না কাটায় বাইরে এসেছেন। ইস্কাটন আবাসিক এলাকার ভেতরে ঘোরাঘুরি করছিলেন ফিরোজ মিয়া। তিনি জানান, দিনভর ঘরে বসে আর ভাল লাগছিল না। তাই একটু সামনে এসেছি। দ্রুতই বাসায় ফিরব। জিগাতলা এলাকায় একটি চা-স্টলে কয়েকজন মানুষের আড্ডা। যাদের প্রত্যেকেই চা খেতে বাইরে আসেন। গ্রিনরোড এলাকার অনেক বাসার সামনে মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। রামপুরা এলাকায় ভোর থেকে রাস্তায় সাধারণ মানুষের চলাচল দেখা যায়। রাস্তার ওপর বাজারও বসতে দেখা গেছে। শাহবাগ এলাকার চারপাশ ঘিরে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়। আছে বিশ^বিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকাও। শাহবাগ মোড়, টিএসসি, দোয়েল চত্বর, কার্জন হল, হাইকোর্টের মাজার, শহীদ মিনার এলাকায় কমবেশি সাধারণ মানুষের আড্ডা চোখে পড়ে। স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও তিন জন মারা গেছেন। এ নিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন ১২ জন। আর নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৫ জন। ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এরপর এটাই প্রথম সর্বোচ্চ রোগী শনাক্ত করা হলো। সব মিলিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা ১২৩ জন। এর মধ্যে ঢাকা জেলার ৬৪ জন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়মিত অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা আরও বলেন, নতুন শনাক্তের মধ্যে ৩০ জন পুরুষ এবং ৫ জন নারী। আক্রান্তদের মধ্য্যে নারায়ণগঞ্জে ২৩ জন এবং এরপরে মাদারীপুরে করোনায় শনাক্তের সংখ্যা বেশি। গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা সংগ্রহের মধ্যে নারায়ণগঞ্জে ১২ জন শনাক্ত হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ আবুল কালাম আজাদ জানিয়েছেন, সারাদেশে ১৫ জেলায় করোনা রোগী পাওয়া গেছে। করোনার ছোবল থেকে রক্ষা মিলছে না বিশ^ নেতাদেরও। হাসপাতালে আইসিইউতে অক্সিজেন সাপোর্টে রাখা হয়েছে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে। এর আগে গত শুক্রবার আইসোলেশনে থাকা অবস্থায় টুইটারে এক ভিডিও বার্তায় বরিস জনসন জানিয়েছিলেন যে, তার শরীরের তাপমাত্রা অনেক বেশি। আইসোলেশনে থাকার ১০ দিন পরেও তার শরীরে করোনার লক্ষণ বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এক সপ্তাহের বেশি কারও শরীরের তাপমাত্রা বেশি থাকলে তা থেকে নিউমোনিয়া হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
×