ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সঙ্কটে আস্থার প্রতীক সেনাবাহিনী

প্রকাশিত: ০৭:২৮, ৬ এপ্রিল ২০২০

 সঙ্কটে আস্থার প্রতীক সেনাবাহিনী

করোনাভাইরাস এখন বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এক আতঙ্কের নাম। বিশ্ববাসীর প্রতিটি মুহূর্ত এখন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় কাটছে। প্রতি মিনিটে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে এ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। পরিস্থিতি এতটাই বিপজ্জনক যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বৈশ্বিক জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেছে। করোনাভাইরাসের ভয়াবহতায় সমগ্র পৃথিবী প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। পৃথিবীর ক্ষমতাধর রাষ্ট্রনায়করা মানুষের জীবন বাঁচানোর লড়াইয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। আগে এক একজন রাষ্ট্রনায়কের দাম্ভিকতায় পৃথিবী কেঁপে উঠত। আজ তারা একটি ক্ষুদ্র ভাইরাসের কাছে বড়ই অসহায়। প্রকৃতির এই প্রতিশোধে ছোট, বড়, ধনী, গরিব, ইসলামী রাষ্ট্র, হিন্দু রাষ্ট্র, বৌদ্ধ রাষ্ট্র, খ্রীস্টান রাষ্ট্র, ইহুদী রাষ্ট্র- কেউই বাদ যাচ্ছে না। বিশ্বের ব্যস্ততম শহরগুলো আজ নীরব-নিথর। সারা পৃথিবীই কার্যত লকডাউন হয়ে আছে। বিচ্ছিন্ন সকল যোগাযোগ ব্যবস্থা। দেশে দেশে চলছে কার্ফু। বাংলাদেশেও ২৬ মার্চ থেকে কার্যত এক প্রকার লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। মাঠে ডাকা হয়েছে সেনাবাহিনীকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাাহিনীকে দ্রুত মাঠে নামানো ছিল প্রধানমন্ত্রীর একটি সময়োপযোগী ও বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত। শুধু বাংলাদেশেই নয়, শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালনকালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্কটময় মুহূর্তে দায়িত্ব পালনে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। শান্তিরক্ষা মিশনগুলোতে সেনাবাহিনী বিভিন্ন সঙ্কটে থাকা দেশগুলোর শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। কাজেই এই সঙ্কট মুহূর্তে বাংলাদেশেও করোনা মোকাবেলায় সেনাবাহিনীকে মোতায়েন সঠিক সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশে এর আগেও বিভিন্ন সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগে যেমনÑ বন্যা, সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড়ের সময় সেনাবাহিনী অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে দেশকে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে নিয়ে আসতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সেনাবাহিনীকে যখনই কোন দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তখনই সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি আস্থার জায়গা তৈরি হয়েছে। সেনাবাহিনী যতটুকু সময় দায়িত্ব পালন করে থাকে সে সময় নিয়ম-নীতির মধ্য থেকে তারা কারও প্রতি রাগ-অনুরাগের বশবর্তী না হয়ে সঠিক কাজটি করে থাকে। সিভিল প্রশাসন যেহেতু সব সময় জনগণের কাছাকাছি থাকে, সেহেতু তাদের সঙ্গে জনগণের একটি বিশেষ সম্পর্ক তৈরি হয়। যার ফলে তাদের অনেক কথা অনেক সময় মানুষ মানতে চায় না। সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষেত্রে সাধারণত তেমনটা হয় না। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সুন্দর একটি ইমেজ আছে। দেশের যে কোন সঙ্কটময় মুহূর্তে তারা জনগণের পাশে এসে দাঁড়ায়। তারা সৎ, নির্ভীক ও দেশপ্রেমিক। তাদের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থাটা অনেক বেশি। সেনাবাহিনী মাঠ পর্যায়ে কাজ করার ফলে সাধারণ মানুষের চলাচল অনেকটা সীমিত হয়েছে। কোয়ারেন্টাইনে যত বেশি মানুষ থাকবে তত সংক্রমণের ঝুঁকি কমবে। এরই মধ্যে আমরা ফল পেতে শুরু করেছি। মানুষ রাস্তাঘাটে কম বের হচ্ছে। জনজীবনে শৃঙ্খলা চলে এসেছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী গত ২৪ মার্চ থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সারাদেশে ৫২০টি টিম করোনাভাইরাস প্রতিরোধে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ শুরু করেছে। এই কার্যক্রমের আওতায় জনসচেতনতা সৃষ্টিতে হেঁটে হেঁটে প্ল্যাকার্ড নিয়ে মানুষের ঘরে ঘরে ছুটে যাচ্ছে সেনাবাহিনীর ভাইয়েরা। কারও হাতের প্ল্যাকার্ডে লেখা ‘ঘনঘন হাত ধুই, করোনা থেকে নিরাপদ রই’, ‘বিদেশ থেকে এসেছে যারা, কোয়ারেন্টাইনে থাকবে তারা।’ করোনা নিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি না করার আহ্বান জানিয়ে লেখা হয়েছে, ‘আতঙ্ক না ছড়াই, সতর্ক থাকি, সাহায্য করি।’ করোনা থেকে রক্ষা পেতে হলে কিভাবে চলাফেরা করতে হবে সে বিষয়ে ঘরে ঘরে লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও জনগণের কাছে ফুল নিয়েও হাজির হচ্ছেন তারা। সেইসঙ্গে সকলকে বুঝিয়ে অনুরোধ করা হচ্ছে ঘর থেকে বের না হওয়ার জন্য। কেউ যদি জরুরী প্রয়োজনে বের হন তাহলে তিনি যেন হ্যান্ড গ্লাভস, মাস্ক পরে বের হন, সে ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। ঢাকা শহরসহ জেলা শহরগুলোর অলিগলিতে জীবাণুনাশক স্প্রে করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। অনেকেরই ধারণা ছিল সেনাবাহিনী মাঠে নামলে পিটিয়ে জনগণকে ঘরে ফেরাবে। কিন্তু আমরা দেখতে পেলাম অত্যন্ত ধৈর্য ধরে পেশাদারিত্বের সঙ্গে মানুষকে বুঝিয়ে, ভালবাসা দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাচ্ছে সেনাবাহিনী। একইভাবে উপকূলীয় অঞ্চলে সচেতনতা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। সেনাবাহিনী স্থানীয় প্রশাসনকে সহায়তার অংশ হিসেবে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের তালিকা প্রস্তুত, বিদেশফেরত ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা, সরকারী ত্রাণ কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে জনগণের মাঝে হাজির হয়ে স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক নানা পদক্ষেপের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছে। করোনা পরিস্থিতি যদি আরও বেশি বিস্তার লাভ করে তাহলে বিভাগ ও জেলা পর্যায়ও সেনাবাহিনীর মেডিক্যাল সহায়তা প্রদানেরও চিন্তা-ভাবনা নিয়েছে। ঢাকায় সেনাবাহিনীর মেডিক্যাল কোরের সদস্যরা ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করে দিয়েছেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের সম্পদ। মানুষের ভরসা ও বিশ্বাসের প্রতীক। স্বাধীন বাংলাদেশের যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় রেখেছে বলিষ্ঠ ভূমিকা। দেশের সকল প্রাকৃতিক দুর্যোগে সশস্ত্র বাহিনী অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে দ্বিধাহীনভাবে সঙ্কট মোকাবেলায় সব সময় ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী যতদিন প্রয়োজন মনে করবেন ততদিন সেনাবাহিনী মাঠে থাকবে। প্রয়োজনে সরকারের চাহিদা অনুযায়ী আরও সেনা মোতায়েন করা হবে। করোনা মোকাবেলায় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে যা যা করা প্রয়োজন তা করা হবে। সেনাপ্রধান নিজেই এ কার্যক্রম মনিটরিং করছেন এবং সরকারপ্রধানকে নিয়মিত আপডেট দিচ্ছেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে বিশ্বের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের গর্বিত অংশীদার। বিশ্বের ৫৪টি শান্তিরক্ষা মিশনে শান্তি ও সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠায় তারা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বিশ্বের বিরোধপূর্ণ স্থানে শান্তি স্থাপনে তার ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধের পাশাপাশি উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় স্থানীয় প্রশাসনকে সব ধরনের সহায়তা করে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এই যুদ্ধেও জয়ী হতে হবে। মানবসভ্যতার ইতিহাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় সঙ্কটে পড়েছে সারাবিশ্ব। এ সঙ্কট কারও একার পক্ষে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টায়ই কেবলমাত্র করোনাভাইরাস সঙ্কট হতে মুক্তিলাভ করতে পারব আমরা। সরকারের আহ্বানে আমাদের গর্বের সেনাবাহিনী যেভাবে ভালবাসার ডালি নিয়ে জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে, আমাদের বিশ্বাস দ্রুতই এ সঙ্কট থেকে আমরা উদ্ধার পাব। লেখক : সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা [email protected]
×