ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সুফল অনস্বীকার্য

প্রকাশিত: ০৭:২৫, ৬ এপ্রিল ২০২০

 সুফল অনস্বীকার্য

কোলাহলমুক্ত সৈকতে বাড়ছে সাগরলতা- এমন শিরোনাম একটি খবরের। করোনায় মানবকুলের বিপর্যয়ের বিপরীতে ছোট্ট একটি খবর জানিয়ে দিচ্ছে বঙ্গোপসাগরের প্রাণ ফিরে পাওয়ার কথা। সবুজ উদ্ভিদজগত আমাদের শ্বাসের বাতাস (অক্সিজেন) দেয় এটা সত্য। কিন্তু সাগরও যে আমাদের অক্সিজেনের বিরাট ভান্ডার এই মহাসত্য তেমন আলোচনা হয় না। স্থলভাগের জৈব ও কৃত্রিম পদ্ধতিতে ফলন বাড়ানো মনুষ্যখাদ্যচক্র হরেকরকম প্রাণীর তুলনায় সাগর একটুও কম আমিষের জোগান দেয় না। অথচ সাগরকে মানুষ নানাভাবে বিপন্ন করে তুলছে। শুধু বর্জ্য, কেমিক্যাল বর্জ্যই নয়, প্লাস্টিক দূষণের ফলে সমুদ্র অধুনা অনেকটাই বিপন্ন। সেইসঙ্গে পর্যটকদের উপচেপড়া ভিড় ও বাড়াবাড়ির কারণেও সাগর ক্ষতিগ্রস্ত, বিপর্যস্ত। এসবের মধ্যে করোনাভাইরাসের ভয় মানুষকে গৃহমুখী করে তোলায় জীব ও প্রাণীজগতে ইতিবাচক ফল মিলতে শুরু করেছে। সে কারণেই কোলাহলমুক্ত সৈকতে বাড়ছে সাগরলতা। বেড়েছে ডলফিনের দাপাদাপি। সংবাদটিতে উঠে এসেছে সাম্প্রতিক চিত্র। করোনা পরিস্থিতির কারণে গত তিন সপ্তাহ ধরে কক্সবাজার সৈকতে চলছে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা। জনকোলাহল না থাকায় সৈকতে ডালপালা মেলে বিস্তার লাভ করেছে সাগরলতা। বালিয়াড়িতে জনকোলাহল না থাকায় অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে লাল কাঁকড়ার দল। পেরুর লিমা সমুদ্র সৈকতে হারিয়ে যাওয়া পাখির ঝাঁকের দাপিয়ে বেড়ানোর কথা উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক জার্নালে। কক্সকাজারের সৈকতের কাছে অবাধে খেলছে ডলফিনের দল। সৈকতের ক্ষয়রোধ এবং শুকনো উড়ন্ত বালুরাশিকে আটকে বালুর পাহাড় বা বালিয়াড়ি তৈরি করে সাগরলতা। আর সাগরে ঝড়-তুফান বা ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসকে উপকূলে ঠেকিয়ে রাখে বলে বালিয়াড়িকে বলা হয় সৈকতের রক্ষাকবচ। কিন্তু পর্যটনশিল্প বিকাশে দূষণের শিকার হয়ে গত প্রায় দুই দশকে কক্সবাজার-টেকনাফ সমুদ্র সৈকতের বালিয়াড়িগুলো প্রায় হারিয়ে গেছে। এতে বিপন্ন হয়ে গেছে বালিয়াড়ির কারিগর সাগরলতাও। তাই ভাঙ্গনের শিকার হয়ে সমুদ্রতীর অনেকটা বিলীন হয়ে গেছে সাগরগর্ভে। কিন্তু করোনার প্রভাবে কক্সবাজারজুড়ে পর্যটক আগমন বন্ধ থাকায় থেমে গেছে সৈকতের বালিয়াড়িতে নিত্যদিনের কোলাহল। এতে পদচিহ্নহীন বালিয়াড়িতে স্বকীয়তায় বিস্তার ছড়াচ্ছে সাগরলতা। করোনাভাইরাস আতঙ্ক সারা দুনিয়াকে যখন গ্রাস করে আছে এ সময়েই গোটা বিশ্বে নীরব-নির্জন ও কোলাহলমুক্ত পরিবেশে মায়াময় প্রকৃতি নিজের সুষমা সৌন্দর্যরাশি একের পর এক মেলে ধরছে। জার্মান পরিবেশবিদ পিটার ওলেনবেন তাঁর সাড়া জাগানো দ্য হিডেন লাইফ অব ট্রিজ গ্রন্থে বিস্তীর্ণ অরণ্যের উজাড় হওয়ার প্রসঙ্গ এনেছেন। উদাহরণ হিসেবে তিনি আমেরিকার বিখ্যাত ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্কের উল্লেখ করেছেন। এটি এক সময় বিশুদ্ধ অরণ্য ছিল। যেদিন থেকে মানুষ সে অরণ্যের ওপর নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা শুরু করল তখন থেকেই প্রকৃতি তার ভারসাম্য হারাতে শুরু করে। কক্সবাজার সৈকতে প্রকৃতির রাজ্যে পরিবর্তনকে ইতিবাচক দাবি করে পরিবেশবিদরা বলছেন, এসব প্রাণ-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সৈকতের কিছু অংশ প্রকৃতিবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা জরুরী। প্রকৃতি রক্ষা করেই আমাদের পর্যটনশিল্পের প্রসার ঘটানোর শিক্ষাও দিল করোনা- এই গ্রহ শুধু মানবজাতির জন্য নয়। মানুষ হাজার বছর ধরে বিশ্ব শাসন করছে, সব প্রাণীকেই বশ করেছে। উজাড় করেছে বনরাজি। মানুষ কালে কালে প্রায় সর্বভুক এক প্রাণীতে পরিণত হয়েছে। আধুনিকতা ও পরিবর্তিত ভোগবাদী জীবনের চাহিদা পূরণের জন্য প্রকৃতিকে নানাভাবে দূষিত-কলুষিত-বিপর্যস্ত করে চলেছে। করোনাভীতির কারণে এবার কিছুটা হলেও তার বোধোদয় ঘটবে বলে আশা জাগে। করোনা উত্তরকালে মানুষ প্রকৃতই প্রকৃতিবান্ধব হয়ে উঠবে, সহাবস্থানের দর্শন আরও জোরালো হবেÑ এটুকু আশা করতেই পারে শুভবোধসম্পন্ন মানুষ।
×