ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

রং তুলি ক্যানভাস তুলে রেখে নিজেদের অর্থে পিপিই

প্রকাশিত: ০৯:৩৫, ৫ এপ্রিল ২০২০

 রং তুলি ক্যানভাস তুলে  রেখে নিজেদের  অর্থে পিপিই

মোরসালিন মিজান ॥ বাংলা নববর্ষ সামনে। মাত্র কয়েকদিন পর ১৪২৭ বঙ্গাব্দ। সঙ্গত কারণেই মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা শিল্পীদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে প্রাক উৎসব শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা হয়নি। করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে এবার সব আয়োজন বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে শিল্পীরা হাতগুটিয়ে বসে আছে, এমন নয়। বরং উৎসবের পরিবর্তে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা। ছবি আঁকা বন্ধ রেখে চিকিৎসকদের জন্য পার্সোনাল প্রটেক্টিভ ইক্যুইপমেন্ট (পিপিই) তৈরি করেছেন। নিজেদের অর্থে তৈরি করা জরুরী সামগ্রী শনিবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। শিল্পীদের ব্যতিক্রমী এই প্রয়াস সম্ভাব্য দুর্যোগের কালে স্ব স্ব জায়গা থেকে কাজ করার বড় উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। জানা যায়, কোভিড-১৯ মোকাবেলায় নিজেদের করণীয় নিয়ে আগে থেকেই ভাবছিলেন শিল্পীরা। নিজেদের জায়গা থেকে কিছু করার তাগিদ বোধ করছিলেন। পরে জরুরী বিবেচনায় পিপিই তৈরির কাজটিকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের পুত্র প্রকৌশলী ময়নুল আবেদিন এ প্রস্তাব দিলে চারুকলা অনুষদের ডিন নিসার হোসেনসহ অন্য শিল্পীরা তাতে সমর্থন দেন। শুরু হয় অর্থ সংগ্রহ। ময়নুল আবেদিন ও নিসার হোসেন ছাড়াও তহবিলে অর্থ প্রদান করেন বরেণ্য শিল্পী রফিকুন নবী, কাজী গিয়াস, নাইমা হক, মোহাম্মদ ইউনুস, মোস্তাফিজুল হক, আবুল র্বাক আলভী, শিশির ভট্টাচার্য, শেখ আফজাল, শামসুদ্দোহা, ড. কেএএস মুরশিদ প্রমুখ। এর পর ব্যক্তিগত পরিচয়ের সূত্রে বিএসএমএমইউ’র চিকিৎসক খন্দকার মানজারে শামীমের সঙ্গে যোগাযোগ করেন শিল্পীরা। তার মাধ্যমে চিকিৎসকদের চাহিদা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেন। একইভাবে সহায়তা চাওয়া হয় বিজিএমইএ’র সহসভাপতি মশিউল আলম সজলের। তিন পক্ষের প্রতিনিধিরা চারুকলা অনুষদে বৈঠক করেন। প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি দ্রুত শেষ কাজে নেমে যান তারা। জানা যায়, পিপিই তৈরির জন্য ১০০০ গজ বিশেষ কাপড় কেনেন শিল্পীরা, যার মূল্য ১৫ হাজার ডলার। এ কাপড় দিয়ে মশিউল আলম সজলের মালিকানাধীন গার্মেন্টসেই তৈরি হয় পিপিই। একই সময় চারুকলা অনুষদে তৈরি হয় ফেসশিল্ড। শিল্পীরাই এর ডিজাইন করেন। তরুণ চিকিৎসকদের শেখাতে এ সংক্রান্ত একটি কর্মশালাও পরিচালনা করা হয়। জানা যায়, ইতোমধ্যে ১ হাজার ৫শ’ ৪৫টি পিপিই তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। শনিবার এগুলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কনক কান্তি বড়–য়ার কাছে হস্তান্তর করা হয়। উদ্যোগটি সম্পর্কে জানতে কথা হয় চারকলা অনুষদের ডিন শিল্পী নিসার হোসেনের সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, এ কাজটি আসলে শিল্পীদের নয়। কিন্তু আমাদের মধ্যে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর একটা তাগিদ ছিল। কী করা যায়, ভাবছিলাম। ঠিক তখন ময়নুল আবেদিন পিপিই তৈরির প্রস্তাবটা দেন। কারণ করোনা মোকাবেলায় প্রধান ভূমিকা রাখতে পারেন চিকিৎসকরা। তাদেরই এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। তারা নিরাপদ থেকে দায়িত্ব পালন করতে না পারলে বড় বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। এমন শঙ্কা থেকে শিল্পীরা পিপিই তৈরির সঙ্গে যুক্ত হন। তো, কী অভিজ্ঞতা হলো? জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন তো সব কিছু বন্ধ। এ অবস্থায় নানা সমস্যায় পড়তে হয়েছে আমাদের। ম্যাটেরিয়ালের জন্য পুরান ঢাকার দোকানপাট বলে কয়ে খুলাতে হয়েছে। অন্যান্য জিনিসপত্র সংগ্রহেও কম বেগ পেতে হয়নি। তিনি বলেন, বিশেষ করে ফেসশিল্ড তৈরির কাজটা সহজ ছিল না। চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে শিল্পীরাই এর ডিজাইন করেছেন। তরুণ চিকিৎসকদেরও ফেসশিল্ড বানানো শেখানো হয়েছে বলে জানান তিনি। কিন্তু এসব পিপিই বা ফেসশিল্ড চিকিৎসকদের কতটা সুরক্ষা দেবে? সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এগুলো সম্পর্কে অবগত করা হয়েছে কি? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, অবশ্যই। আমরা এসব তৈরির ক্ষেত্রে সব ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করেছি। মান নিশ্চিত হয়েছে কি না জানতে গিয়েছি স্বাস্থ্য অধিদফতরেও। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর স্বাস্থ্য অধিদফতর আমাদের এসব কাজের অনুমোদন দিয়েছে। মানের ব্যাপারে অনাপত্তি দিয়েছে। এদিকে, করোনার মতো দুর্যোগে জরুরী সহায়তা নিয়ে পাশে থাকায় শিল্পীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে শিল্পীদের উদ্দেশে লেখা চিঠিতে বলা হয়েছে: ‘বিএসএমএমইউ দেশের এই সঙ্কটকালে তাঁদের (শিল্পীদের) এই মানবদরদী উদ্যোগ কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে।’ সব মিলিয়ে চমৎকার একটি উদাহরণ সৃষ্টি করলেন শিল্পীরা। দুর্যোগেরকালে কথা নয়, যার যা আছে তাই নিয়ে কাজে নামার বার্তা দিলেন তারা। সমাজের অন্যান্য শ্রেণী পেশার মানুষ এমন উদ্যোগ দেখে নিশ্চয়ই অনুপ্রাণিত হবেন। বিশেষ করে যে ডাক্তাররা সেবার মহান ব্রত নিয়েও রোগীর সেবা দিচ্ছেন না, মানুষের দুর্দিনে পালিয়ে একলা বাঁচার চেষ্টা করছেন, চেম্বারে তালা দিয়ে যারা ঘরে বসে আছেন, তাদের বিবেক কিছুটা হলেও জাগ্রত হবে। চিকিৎসকদের মানবিক হতে পেশাদার হতে অনুপ্রাণিত করবে শিল্পীদের এই উদ্যোগ- আমাদেরও তা-ই প্রত্যাশা।
×