ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সুযোগ আসবে বাংলাদেশের ॥ করোনায় বিশ্ব অর্থনীতির চিত্রই বদলে যাচ্ছে

প্রকাশিত: ০৯:৫৪, ৪ এপ্রিল ২০২০

   সুযোগ আসবে বাংলাদেশের ॥ করোনায় বিশ্ব অর্থনীতির চিত্রই বদলে যাচ্ছে

কাওসার রহমান ॥ কোভিড নাইনটিনে স্থবির বিশ্ব অর্থনীতি। এশিয়া থেকে ইউরোপ, আমেরিকা থেকে অস্ট্রেলিয়া কিংবা আফ্রিকা-সবখানেই বন্ধ দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। উৎপাদনও নেমেছে প্রায় শূন্যের কোটায়। করোনাভাইরাসের মহামারীতে বিশ্বজুড়ে বিমান চলাচল কার্যত বন্ধ। পর্যটন খাত স্তব্ধ। হোটেল, খাবারের দোকানসহ সবখানেই তালা ঝুলছে। ঝড়ের বেগে ধাবমান মানবসভ্যতা অতর্কিতে থেমে গেছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে বিশ্বের প্রতিটি দেশের জিডিপির ১০ শতাংশ। এই হিসাবে করোনার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে আড়াই লাখ কোটি টাকারও বেশি। আর যদি অর্ধেক ক্ষতিও হয় অর্থাৎ জিডিপির ৫ শতাংশও ক্ষতি হয় তাহলে বাংলাদেশের মোট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে সোয়া এক লাখ কোটি টাকা। তবে আশার কথা হলো, প্রায় সব ধরনের পণ্যসামগ্রীর কাঁচামালের ক্ষেত্রে চীনের ওপর যে অতিনির্ভরতা গড়ে উঠেছে, তা থেকে এবার বোধহয় সকলেই বেরিয়ে আসতে চাইবে। সে ক্ষেত্রে একটি বড় সুযোগ আসতে পারে ভারত, বাংলাদেশ আর ভিয়েতনামের কাছে। ম্যাকেঞ্জির বৈশ্বিক ব্যবস্থাপনা অংশীদার কেভিন স্নেডার বলেন, করোনার ধাক্কায় পৃথিবীর চিত্রই বদলে যাচ্ছে। ফলে নতুন এক অর্থনৈতিক পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত হবে পৃথিবীর মানুষ। করোনা যত বাড়বে ক্ষতির পরিমাণও তত বাড়বে। গত দুই মাস ধরেই শিল্প-বাণিজ্য-বিশ্বায়ন, পরিবেশ দূষণের উদ্যম গতি সবকিছু থমকে দাঁড়িয়েছে করোনার আঘাতে। অথচ করোনা-উত্তর পৃথিবীতে মানুষ কবে আবার ঘর থেকে বেরিয়ে কাজে ফিরবে, তার উত্তর এখনও কেউ জানে না। তবে করোনা থেকে মুক্তির দিনক্ষণ অজানা থাকলেও বিশ্বে স্থবির এই অর্থনীতির পরিবেশ আর আগের মতো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে না বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বরং এই স্থবির অবস্থা থেকেই বিশ্বে নতুন এক অর্থনীতির জন্ম নিবে। যার সূচনা হতে পারে ২০২১ সালেই। এমনই এক নতুন অর্থনৈতিক পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে বিশ্ববাসী। এমন পূর্বাভাস দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী অর্থনৈতিক পরামর্শক সংস্থা ম্যাকেঞ্জি এ্যান্ড কোম্পানি। পরামর্শক সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোভিড নাইনটিন মানুষের শুধু স্বাস্থ্যই নয়; স্বাধীনতা, গোপনীয়তা, সেবা পাওয়ার সুযোগ সবকিছুকেই নতুন করে ভাবাচ্ছে। আরও ভাবাচ্ছে কি হবে বিশ্ব অর্থনীতির? সামনে কি একটি মহামন্দা? ম্যাকেঞ্জি এ্যান্ড কোম্পানি বলছে, করোনা বিশ্ববাসীর জীবন-জীবিকার ওপর এমন ধাক্কা দিবে যে, তা গত শতাব্দীতেও দেখা যায়নি। ম্যাকেঞ্জির পূর্বাভাস, স্বাভাবিকের সংজ্ঞাই হয়ত বদলে যাবে এ ধাক্কায়। বিশ্ববাসীকে অভ্যস্ত হতে হবে নতুন এক পরিস্থিতির সঙ্গে। বিমান-পর্যটন, জ্বালানি, তৈরি পোশাকসহ কয়েকটি খাতে করোনার যে প্রভাব পড়বে, তা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে আগামী বছরের প্রায় মাঝামাঝি পর্যন্ত। করোনা ইস্যুতে ম্যাকেঞ্জির পূর্বাভাস নিয়ে খুব একটা দ্বিমত নেই অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের। বিশ্ব অর্থনীতিতে মহামন্দা যে অবশ্যম্ভাবী তামাম বিশ্বের অর্থনীতিবিদরাও জানাচ্ছেন। বহুপাক্ষিক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সংস্থাগুলোও কথা বলছেন একই সুরে। অনেক অর্থনীতিবিদ তো বলছেন, মন্দা ইতোমধ্যে শুরুই হয়ে গেছে। কেউ কেউ আবার বলছেন, মহামন্দা আসন্ন। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাও (ডব্লিউটিও) বলেছে, অর্থনীতির নেতিবাচক গতি ও লাখ লাখ মানুষ বেকার হওয়ার ফলে পরিস্থিতি ২০০৯ সালের মন্দার চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে। করোনায় থমকে যাওয়া সব অর্থনৈতিক কর্মকা-, পুরো বিশ্বকে ঠেলে দিচ্ছে আরও একটি মন্দার দিকে। কারও কারও আশঙ্কা ১৯৩০ সালের মতো মহামন্দার। যার স্থায়িত্ব ছিল টানা দশ বছর। আর এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে কর্মসংস্থান, রফতানি, প্রবাসী আয়সহ অভ্যন্তরীণ বাজারেও সৃষ্টি হবে বড় সঙ্কট। এমন অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচিত হবে সুপরিকল্পিত এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপের মাধ্যমে প্রস্তুতি নেয়ার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মহাপরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বলছেন, বিশ্বে তারল্য সঙ্কট তীব্রতর হচ্ছে। এবারের অর্থনৈতিক সঙ্কট ২০০৯ সালের বৈশ্বিক মন্দাকেও ছাড়িয়ে গেছে। ফলে ২০২০ সালের সঙ্গে ২০২১ সালেও কমে যাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি। ২০২১ সালের মধ্যে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অর্থনীতি বিশ্লেষকদের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো খবর দিচ্ছে, বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় পুঁজিবাজারগুলো জানুয়ারি থেকে মার্চের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত সময়ে ২৬ ভাগ পর্যন্ত দরপতন হয়েছে। এই সময়ে চীনের শিল্পোৎপাদন কমেছে ১৩ শতাংশ। এর মধ্যে বেশ বড় ধরনের দরপতন হয়েছিল সোনার দামেও। শেষ পর্যন্ত সেই ধাক্কা সোনা কাটিয়ে উঠলেও তেলের দাম নেমে গেছে ১৮ বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে। এখন মাত্র ২২ ডলারে এক ব্যারেল অপরিশোধিত তেল কেনা যাচ্ছে। অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন এ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) তথ্য বলছে, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জাপান, জার্মানিসহ বিশ্বের সব দেশেই করোনাভাইরাসের কারণে জিডিপি প্রবৃদ্ধি এ বছর কমবে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। বর্তমান অবস্থা বহাল থাকলে মে মাসের মধ্যে প্রায় সব বিমান সংস্থা দেউলিয়া হয়ে যাবে। পর্যটন শিল্পেও একই কালো মেঘ। শিল্পের যে ক্ষেত্রগুলো কাজ তৈরি করে, তার মধ্যে প্রধানই হলো ভ্রমণ ও পর্যটন। বিশ্বব্যাপী আনুমানিক ২০ শতাংশ মানুষের জীবিকার উৎস ভ্রমণ ও পর্যটন। যে দেশের অর্থনীতিতে পর্যটনের গুরুত্ব যত বেশি, সেখানে আঘাতের তীব্রতাও হবে ততটাই। মূল ইউরোপের কয়েকটি দেশ যেমন ব্রিটেন ছাড়াও থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, কেনিয়া, শ্রীলঙ্কা, নেপাল প্রভৃতি দেশ রয়েছে এই তালিকায়। শিল্পোৎপাদনের কেন্দ্র হিসেবে গত কয়েক দশকে চীন নিজেকে নিরঙ্কুশভাবে প্রতিষ্ঠা করেছে। আজ পৃথিবীর কোন দেশে এমন কোন শিল্প নেই যার জন্য চীন থেকে কাঁচামাল কেনা হয় না। এই বিশ্বায়িত শিল্পসাম্রাজ্যে এখন দমবন্ধ অবস্থা। কারণ জাহাজ চলাচল থমকে গেছে। পৃথিবীর অর্থনীতির আকার মোটামুটি ৮০ ট্রিলিয়ন ডলারের। ক্ষতির প্রাথমিক হিসাব ছিল আনুমানিক এক ট্রিলিয়ন ডলারের। কিন্তু আপাতত এই হিসাব লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। পৃথিবীর সব শেয়ার মার্কেটে অবিরাম রক্তক্ষরণ চলছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মাস খানেকের মধ্যে পরিস্থিতির মোড় না ঘুরলে হয়ত বিশ্ব ১৯৩০ সালের ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’ বা মহামন্দার জায়গায় পৌঁছে যাবে। ফলে করোনা পূর্ব পরিস্থিতিতে ফিরতে পাঁচ বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। এই মহামন্দার চাপে বিশ্বজুড়ে প্রায় ২০ শতাংশ শিল্প সংস্থা দেউলিয়া হতে পারে, তার সঙ্গে থাকবে অসংগঠিত বা ক্ষুদ্র শিল্পে কাজ হারানোর ভয়াবহ ভবিতব্য। ইউরোপ-আমেরিকা এই মুহূর্তে করোনা নিয়ে নাকানি-চুবানি খাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যে নাড়া খাবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তা আর দেখেনি দেশটি। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। কৃষি উৎপাদন ছাড়া স্থবির হয়ে পড়েছে বাংলাদেশের সব খাতের উৎপাদন কার্যক্রম। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে দেশের লাইফলাইন খ্যাত ৪০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাত তৈরি পোশাক শিল্প। ইতোমধ্যে এ খাতের প্রায় ৩০০ কোটি ডলারের ক্রয় আদেশ বাতিল হয়েছে। পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতির মুখে এ খাতের ২০ লাখেরও বেশি শ্রমিক। ব্যবসায়ীদের মতে, রফতানি আয়ের সিংহভাগের জোগানদাতা এই খাতে এমন সঙ্কট আসেনি এর আগে। এই শিল্পকে চাপে ফেলতে পারেনি ২০০৮-২০০৯ সালের বিশ্বমন্দাও। এই দুর্যোগ কতটা ভোগাবে বাংলাদেশকে সেটাই এখন প্রশ্ন? হিসাব বলছে, ৩শ’ বিলিয়ন ডলার আয়তনের জিডিপিতে আমদানি-রফতানি, রেমিটেন্স মিলিয়ে ১শ’ বিলিয়নই সরাসরি জড়িত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সঙ্গে। করোনা ইস্যুতে এরই মধ্যে দেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বড় আকারের ধাক্কা খেয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনাভাইরাসের প্রভাবে অর্থনীতিতে বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাদের মতে, করোনাভাইরাসে পৃথিবীর অনেক দেশের ক্ষতির পরিমাণ তাদের মোট দেশজ আয়ের (জিডিপি) ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশে এই ক্ষতির পরিমাণ যদি জিডিপির ৫ শতাংশও হয়, তাহলেও আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় সোয়া ১ লাখ কোটি টাকা। আর ১০ শতাংশ হলে ক্ষতি হবে আড়াই লাখ কোটি টাকারও বেশি। এই ঝুঁকি মোকাবেলা করে দেশের শিল্প-কারখানা টিকিয়ে রাখতে চাইলে এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে হলে সরকার বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। যদিও এর মধ্যেও খানিকটা স্বস্তির খবর দিচ্ছে সরকারীভাবে রফতানি খাতের জন্য আর্থিক প্রণোদনার ঘোষণা। ইতোমধ্যে সরকার রফতানি খাতে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা কিভাবে খরচ হবে তার দিকনির্দেশনাও জারি করেছে। আরও একটি সুখবর হচ্ছে, পোশাক খাতের বড় বড় ক্রেতারা ক্রয়াদেশ বাতিলের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছেন। বিপরীতে এবার তারা ক্রয়াদেশগুলো বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। শিপমেন্টের অপেক্ষায় থাকা পণ্য নেয়ার বিষয়েও ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। ক্রেতাদের এমন সিদ্ধান্তের ফলে করোনার প্রভাবে যে ৩০০ কোটি ডলারের পোশাক ক্রয়াদেশ স্থগিত বা বাতিলের কথা বলা হচ্ছিল, এখন সেই পরিমাণ কমে আসবে। ডব্লিউটিওর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ভিডিও বার্তায় সংস্থাটির মহাপরিচালক রবার্তো এ্যাজেভেদো বলেছেন, এই মহামারীতে চলমান অর্থনৈতিক অধোগতি ও মানুষের চাকরি হারানোর ফলে পরিস্থিতি এক যুগ আগের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সঙ্কটের চেয়ে ভয়াবহ হতে পারে। আর এতে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ চাকরি হারাতে পারে বলে আগেই সতর্ক করেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)। ডব্লিউটিওর মহাপরিচালক বলেছেন, অর্থনীতির প্রকৃত পূর্বাভাস এখনও না মিললেও বিশ্ব বাণিজ্যে বড় ধরনের পতন হবে। তবে দেশগুলোর প্রচেষ্টা সমন্বিত হলে মন্দা মোকাবেলায় সামষ্টিক ক্ষমতা বাড়বে। বিভিন্ন দেশের সরকারের নেয়া প্রণোদনামূলক পদক্ষেপগুলো এক্ষেত্রে ‘ইতিবাচক’ হিসেবে কাজ করবে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি, স্পেন, চীন, ভারত, সিঙ্গাপুর, বাংলাদেশ- সব দেশেই সরকার এখন ব্যস্ত মন্দার গ্রাস থেকে দেশকে কিভাবে বাঁচানো যায় তার পথ খুঁজতে। আমেরিকা দুই ট্রিলিয়ন ডলারের মতো প্রণোদনা প্যাকেজ অনুমোদন করেছে। ব্রিটেন চাকরি হারানো সবার জন্য আপাতত প্রতি মাসে ২৫০০ পাউন্ড পর্যন্ত ভর্তুকি দেবে। ইউরোপের বৃহত্তম অর্থনীতি জার্মানি এক লাখ ২০ হাজার কোটি ডলারের প্রণোদনা অনুমোদন করেছে। জিএসটি আর নোটবন্দীর অভিঘাতে গত দুই বছর ধরে ধুঁকতে থাকা ভারতের অর্থনীতিতে সুনামির মতো আছড়ে পড়েছে করোনা। ভারত ২১ দিনের লকডাউনে যাওয়ার পর দরিদ্রদের নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। তাদের রক্ষায় ভারত সরকার ২২০০ কোটি ডলারের প্যাকেজ অনুমোদন করেছে। রফতানিমুখী শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদানে ২ শতাংশ সুদে প্রদানের জন্য বাংলাদেশ সরকারও ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে পৃথিবীর অনেক দেশেই তাদের জিডিপির ১০ শতাংশের বেশি আর্থিক ক্ষতি হবে। আমাদের যদি তার অর্ধেকও হয়, তাহলেও ১ লাখ কোটি টাকার বেশি আর্থিক ক্ষতি হবে। তিনি বলেন, দেশ এখন দীর্ঘ মেয়াদে ছুটিতে। এতে উৎপাদন হচ্ছে না। কিন্তু শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দিতে হবে। তাছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে টাকা খাটছে, এই টাকার বিপরীতে সুদ উঠছে, এই সুদ তো কেউ মওকুফ করছে না। পরবর্তী সময়ে উদ্যোক্তারা কিভাবে টাকা পরিশোধ করবেন? তাদের টার্নওভার থাকলেও ধীরে ধীরে বিনিয়োগের টাকা উঠে আসত। কিন্তু এখন কোন টার্নওভার নেই। ফলে এর ঋণাত্মক প্রভাবটা খুব বড় হবে। আর এটা এককভাবে উদ্যোক্তাদের পক্ষে সামাল দেয়া সম্ভব হবে না। ফলে রাতারাতি তারা ঋণখেলাপী হয়ে পড়বে। কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। এ পরিস্থিতি আমাদের কাম্য হতে পারে না। আহসান এইচ মনসুর বলেন, করোনার প্রভাবে কুটির শিল্পের লাখ লাখ লোক বেকার হয়ে যাবে। তাদের কী হবে, সেই চিন্তা সরকারকে করতে হবে। পৃথিবীর সব দেশের সরকারকেই তাই করতে হয়। তবে ব্যক্তি খাত বিভিন্নভাবে সাহায্য করতে পারে। তবে যেহেতু ব্যক্তি খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাই মূল দায়িত্ব পালন করতে হবে সরকারকেই। এ ক্ষেত্রে করণীয় প্রসঙ্গে আহসান এইচ মনসুর বলেন, করোনা পরবর্তী অর্থনীতি মোকাবেলায় পৃথিবীর অন্যান্য দেশ যা করছে, আমাদেরও তাই করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী রফতানিমুখী খাতের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। এটি ভাল দিক। অন্যান্য খাতেও ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। বিশেষ করে এসএমই খাতটি অনেক বড় খাত। এই খাতে নিয়োজিত জনবল অনেক বেশি। আরও রয়েছে পর্যটন শিল্প, হোটেল-রেস্টুরেন্ট। এগুলোও সবই বন্ধ। এদের জন্যও সরকারী সহায়তা প্রয়োজন। তার মতে, আমাদের দুটি জিনিস ঠিক রাখতে হবে- একটি অভ্যন্তরীণ চাহিদা, অন্যটি বৈদেশিক চাহিদা। বৈদেশিক চাহিদা তো এককভাবে আমরা ঠিক করতে পারব না। এটা নির্ভর করবে বাইরের সিচুয়েশনের ওপর। সেটা ওকে হলে আস্তে আস্তে অর্ডার চলে আসবে। তবে আমাদের দিক থেকে অভ্যন্তরীণ চাহিদার কিন্তু বড় পতন হয়েছে। সেটা মাথায় রাখতে হবে। ‘কঠিন’ এই পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারের করণীয় তুলে ধরে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজ বলেন, এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে আমাদের মঞ্জুরি সহায়তা বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু এ সংস্থাগুলো ঋণ দিতেই বেশি আগ্রহী থাকে। ফলে মঞ্জুরি সহায়তা খুব বেশি পাওয়া যাবে না। সে ক্ষেত্রে সফট লোন বা সহজ ঋণের জন্য দর-কষাকষি করতে হবে। এ ব্যাপারে সরকার দৃঢ় অবস্থান নিলে বাড়তি সুবিধা আদায় করা কঠিন হবে না। বিনিময়ে সুশাসন, বিনিয়োগ পরিবেশ, ব্যবসা সহজীকরণের শর্ত পূরণ করতে হবে। আবার কবে ট্রেনে বা প্লেনে মানুষ ঘেঁষাঘেঁষি করে যাতায়াত করবে, দল বেঁধে বেড়াতে যাবে, লাইন দিয়ে দাঁড়াবে, ক্লাস রুমে পাশাপাশি বসবে, ভরা গ্যালারিতে বসে খেলা দেখবে- তার উত্তর নেই। তাই পর্যটন, পরিবহন, শিক্ষা, খেলা, বিনোদন ক্ষেত্রে ব্যবসার মডেলে আমূল পরিবর্তন ঘটে যেতে পারে। শেয়ার মার্কেটে ধসের ফলে বিনিয়োগকারী সংস্থাগুলোর সম্পদ যে হারে কমছে, তাতে সংগঠিত শিল্পে বা স্টার্টআপ ক্ষেত্রে বিনিয়োগের ব্যাকরণই বদলে যেতে পারে। বহুজাতিক সংস্থাগুলো যেভাবে তাদের ব্যবসা সাজাচ্ছিল, তার খোলনলচেও বদলাতে পারে।
×