ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন হওয়ার শঙ্কায় ডিপিডিসির প্রিপেইড গ্রাহকরা

প্রকাশিত: ০৯:১৭, ৩ এপ্রিল ২০২০

  বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন হওয়ার শঙ্কায় ডিপিডিসির প্রিপেইড গ্রাহকরা

রশিদ মামুন ॥ বিদ্যুত বিভাগের আদেশ অমান্য করে করোনা আতঙ্কের মধ্যে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) গ্রাহকের সঙ্গে ভাঁওতাবাজি শুরু করেছে। সারাদেশের বিদ্যুত এবং গ্যাসের বিল জমা দেয়ার সময়সীমা আগামী জুন পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছে সরকার। কিন্তু গ্যাস এবং বিদ্যুতের প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারীরা এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এরপরও অন্য বিতরণ কোম্পানিগুলো জরুরী অবস্থা মোকাবেলার সময়ে বিকল্প ব্যবস্থা করেছে। কেবল রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় বিদ্যুত বিতরণকারী কোম্পানি ডিপিডিসি গ্রাহকদের জন্য বিকল্প যে সুযোগ তৈরির যে ঘোষণা দিয়েছিল তা আদৌও বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না তার খবরই রাখছে না। আর এতে লাখ লাখ গ্রাহককে করোনা ঝুঁকিতে ঠেলে দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। ডিপিডিসির পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি বিদ্যুত বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মাদ শফিক উল্লাহর কাছে জানতে চাইলে বলেন, আমরা ব্যবস্থা করেছি। কোন গ্রাহককে আসতে হচ্ছে না, আমাদের এজেন্ট বাড়ি বাড়ি গিয়ে রিচার্জ করে দিয়ে আসছে। বিষয়গুলো প্রতিটি বিতরণ জোনের নির্বাহী প্রকৌশলীরা নিয়মিত তদারকি করছে বলে দাবিও করেন তিনি। যখন বলা হয় ডিপিডিসির ওয়েবসাইটে দেয়া তালিকা ধরে বিভিন্ন এলাকার ১২ এজেন্টকে ফোন করে জানতে চাওয়া হয়েছে তারা কিভাবে রিচার্জ করছেন? এদের সকলেই বলছেন কেউ বাড়ি যাচ্ছেন না। গ্রাহকের রিচার্জের প্রয়োজন হলে দোকানেই আসতে হবে। এবার এই তথ্যের ব্যাখ্যা জানতে চাইলে মোহাম্মাদ শফিক উল্লাহ বলেন, এর কোন ব্যাখ্যা নেই। আমরা তো গ্রাহককে উদ্বুদ্ধ করছি যাতে তারা না বের হন। এখন আমরা তো কাউকে জোর করতে পারি না। তাহলে মানুষের ঘরে বিদ্যুত চলে গেলে তারা কি করবে? এই প্রশ্নে শফিক উল্লাহ বলেন, আমাদের হট লাইনে ফোন দিলে আমরা গিয়ে রিচার্জ করে দিয়ে আসব। তিনি বলেন, এটি উল্লেখ করার দরকার নেই। তবে আমরা তাদের মিটারের ফ্রেন্ডলি আওয়ার তিন দিন পর্যন্ত বাড়িয়ে রেখেছি। কেন তিন দিন, কেন আরও বেশি সময় নয়? এই প্রশ্নে ডিপিডিসির সভাপতি বলেন, আমাদের মিটারে এর চেয়ে বেশি সময় বৃদ্ধি করা যায় না। মিটারের ফ্রেন্ডলি আওয়ার আবার কেউ বলেন ইমার্জেন্সি ব্যালেন্স যাই বলা হোক কাজ একটিই। আর এখানেই আসল গলদ বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে বিদ্যুত কেন্দ্রের বাণিজ্যের দিন শেষ হয়ে গেছে। এবার যা কাজ হবে তার পুরোটাই হবে সঞ্চালন আর বিতরণকে ঘিরে। প্রিপেইড মিটারও নির্মম বিদ্যুত বাণিজ্যের আরেক নাম। যেখান থেকে এই প্রিপেইড মিটার কেনা হয় সেই চীনই প্রিপেইড মিটার ব্যবহার করে না। এরপরও অগ্রিম বিদ্যুত বিল আদায় সিস্টেম লস হ্রাস নানা যুক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশের সব গ্রাহকের ঘরে প্রিপেইড মিটার বসানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রতিটি মিটারের দাম সর্বনিম্ন তিন হাজার ৫০০ টাকা করে হলেও সাড়ে তিন কোটি গ্রাহকের আঙ্গিনায় মিটার বসাতে গিয়ে ১২ হাজার ২৫০ কোটি টাকার প্রিপেইড মিটারের বাণিজ্যের সুযোগ তৈরি হয়েছে। কিন্তু এই বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করে যে মিটার বসানো হচ্ছে সেখানে গ্রাহকের সুবিধার কথা বিবেচনা করেনি ডিপিডিসি। প্রিপেইড বাণিজ্যের সুযোগ নিয়ে যা খুশি তাই মিটার ধরিয়ে দিয়ে গেছে কোম্পানিগুলো। আর তা যাচাই বাছাই করে নেয়ার বদলে অজানা কারণে মুখ বন্ধ রেখেছিল কোম্পানির সংশ্লিষ্টরা। এখন মানুষকে মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে তার দায় মেটাতে হচ্ছে। এই দায় কিভাবে মেটাচ্ছেন জানতে চাইলে মোহাম্মদপুরের ডিপিডিসির গ্রাহক শাহনাজ বেগম জানালেন, মঙ্গলবার সকাল নয়টায় তার বাসার বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তাকে কেউ একজন জানিয়েছিলেন জরুরী অবস্থায় বিদ্যুত চলে গেলেও সংযোগ বিচ্ছিন্ন হবে না। তিনি সেই ভরসাতেই ছিলেন। কিন্তু এখন কি অবস্থা জানতে চাইলে বলেন, আমি এখন ডিপিডিসির অফিসে এসেছি টাকা জমা দিতে। ওই অফিসে ডিপিডিসির দায়িত্বপ্রাপ্তরা কি বলছেন জানতে চাইলে বলেন, তারা কোন কথা বলছে না চুপ করে রয়েছে। সরকারের জারি করা আদেশে বলা হয়েছে জুন পর্যন্ত বিদ্যুত আর গ্যাসের বিল বিলম্ব মাসুল ছাড়াই দেয়া যাবে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে বিদ্যুত এবং গ্যাসের বিল দিতে গিয়ে ব্যাংকগুলোতে অনেক লোক জড়ো হয়। আর এতে করোনা আক্রান্তের ঝুঁকি বাড়ে। সারাদেশে গত ২৬ মার্চ থেকে ছুটি শুরু হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় এই ছুটি বেড়ে হয়েছে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত। সরকারের তরফ থেকে বারবার জনসাধারণকে ঘরের বাইরে যেতে নিষেধ করা হচ্ছে। কিন্তু ডিপিডিসির প্রিপেইড মিটারের ব্যালেন্স শেষ হয়ে গেলে বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন অবস্থায় কিভাবে থাকবে গ্রাহক। সরকারের নির্দেশনার সঙ্গে ডিপিডিসি একটি আদেশ জারি করে। ওই আদেশে বলা হয় গ্রাহক ফোন করলে বাড়ি গিয়ে তাদের এজেন্টরা রিচার্জ করে দিয়ে আসবেন। ডিপিডিসি এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে কি করেছে। এজেন্টরা বলছেন তাদের ডিপিডিসি এ সংক্রান্ত একটি খুদে বার্তা পাঠিয়েছে। ডিপিডিসির তরফ থেকে এজেন্টদের ফোন করা হয়েছিল কি না বা কেউ এসে এ ধরনের আদেশ প্রতিপালন করতে বলেছেন কি না জানতে চাইলে এজেন্টরা বলেছেন না তাদের কাছে কেউ আসেননি। ডিপিডিসির এজেন্ট তালিকায় ১ নম্বরে নাম থাকা ইসলামপুরের ১৯১৮- আহসান উল্লাহ নবাব বাড়ির ওয়াই এ টেলিকমে ফোন করা হলে স্বত্বাধিকারী জানালেন, তিনি বিশেষ এই অবস্থায় দোকান বন্ধ রেখেছেন। বাসায় গিয়ে রিচার্জ করে দিচ্ছেন কি না জানতে চাইলে বলেন, দোকানই তো বন্ধ। এরপর কত রিচার্জ করবেন কি করবেন এসব বিষয়ে কিছুক্ষণ কথা বলে জানালেন, তিনি বাসায় যেতে পারবেন না। তালিকার-৪ নম্বরে নাম থাকা কামরাঙ্গীরচরের কুইন্স টেলিকম থেকে রিফাত জানালেন, তার দোকানও বন্ধ। তিনি ব্যাংক থেকে টাকা পাচ্ছেন না। মোবাইলে ব্যালেন্স নেই। তবে তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন ওই মার্কেটে যান ওখানে গেলে পাবেন। এজেন্ট তালিতার ২৭৭ এর নাম থাকা শ্যামলির চমক অডিও কর্নারের বিদ্যুৎ কুমার সাহা বলেন, লোক নাই বিশেষ অবস্থায় দোকানও বন্ধ। তবে দোকানের সামনে কেউ আসলে রিচার্জ করে দিচ্ছি। অর্থাৎ তিনিও বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন না। রাজধানীর শেরে বাংলা নগরের এস এস এন্টারপ্রাইজ আর ভাই ভাই হেয়ার কাটিং তালিকার ২৯৯ এবং ৩০০ তে রয়েছে এই দুই এজেন্টের নম্বর। দুটি নম্বরে ফোন দিয়ে দুটিকেই বন্ধ পাওয়া গেছে। স্বামীবাগের মেহেরবান টেলিকম-এর আসাদুর রহমানের নাম রয়েছে এজেন্ট তালিকার ৩৪২ নম্বরে তিনি কি বাসায় যাচ্ছেন? এমন প্রশ্নে তিনি বুঝতেই পারলেন না বাসায় যেতে হবে কেন? তার দোকানই খোলা রয়েছে। রাত আটটা নয়টা পর্যন্ত খোলা থাকছে। আবার সকাল আটটায় দোকান খুলছেন। ফলে এখানে আসলে রিচার্জ করে দেয়া হচ্ছে। তালিকায় ৩৮৯ এর আজিমপুরের বারাকাত টেলিকমের সোহাগ এবং একই এলাকার ৩৮৭ এ নাম থাকা স্টার টেলিকমের নাসির উদ্দিন জানালেন একই কথা। তাদেরে দোকান খোলা রয়েছে। একজন মাত্র মানুষ দোকান চালায় তিনি কিভাবে দোকান বন্ধ করে বাসায় যাবেন। কাউকে রিচার্জ করতে হলে দোকানেই আসতে হবে। তেজগাঁও এর মা এন্টারপ্রাইজের নাম রয়েছে ৩৭৯ নাম্বারে। দোকানের মালিক বাসায় গিয়ে রিচার্জের কথা শুনে খানিকটা বিরক্তই হলেন। একই এলাকার সাউদিয়া এ্যান্ড জোবায়ের জেনারেল স্টোরের মালিক শফিকুল ইসলামের নাম রয়েছে তালিকার ৩৪৬ নাম্বারে। মালিকের অনুপস্থিতিতে আক্তার নামের একজন ফোন ধরে বললেন, না রিচার্জ করতে হলে দোকানেই আসতে হবে। তবে একেবারে কেউ যে এই আদেশ মানছে না তা নয়। শ্যামপুরের রাশেদ জানালেন তিনি চার জনের বাসায় গিয়ে রিচার্জ করে দিয়ে এসেছেন। তালিকার ৩০৯ এ নাম থাকা রাশেদ জানালেন, এখন তার দোকান খোলাই আছে। দোকানে এসে রিচার্জ করা যাবে। প্রসঙ্গত তিতাসসহ অন্য গ্যাস বিতরণ কোম্পানি ইমার্জেন্সি ব্যালেন্স ২০০ টাকার স্থলে দুই হাজার টাকা করে রেখেছে। আবার ঢাকার আরেক বিতরণ কোম্পানি তাদের মিটারের ফ্রেন্ডলি আওয়ার ২ দিনের স্থলে ১৫ দিন করে রেখেছে। যাতে গ্রাহকের বিদ্যুত নিয়ে বিড়ম্বনা না ঘটে।
×