ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

করোনাভাইরাস

প্রকাশিত: ০৮:২৮, ৩ এপ্রিল ২০২০

 করোনাভাইরাস

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে লোকমান হোসেনের মৃত্যু হয়েছে। তাকে কবর দেওয়া হয়েছে দশ কিলোমিটার দূরের গঞ্জে। লোকজন মরদেহের ধারকাছে ভিড়তে পারেনি। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নিয়মে দাফন করা হয়েছে। গ্রামবাসীর কাছে অবিশ্বাস্য। তাজা- নিরোগ- জোয়ান বাইশ বছরের যুবক লোকমানের অকাল মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না মানুষ। এমন সংবাদ তার মায়ের কাছে পৌঁছাতে হবে। খবরটি দেওয়া যায় কিভাবে? বয়স্কা রহিমা বিবিকে জানাবার পথ কী। কাশেম সমাদ্দার এমন সমস্যাসঙ্কুল প্রশ্নটি ছেড়ে দেন সবার ওপর। বেঞ্চ পাতা রয়েছে। এতে বিক্রি বাড়ে দোকানির। বসে চা-বিস্কিট-সিগারেট খাওয়া, গল্প করা। জুয়েল মিয়া, রবি সরকার, কাছন আলীসহ চায়ের স্টলে পেতে রাখা বেঞ্চে বসে থাকা সঙ্গীরা ভীষণ চিন্তিত লোকমানের মৃত্যু নিয়ে। কেউ চায়ে শেষ চুমুক দেয়, কেউ খালি কাপ দোকানিকে ফিরিয়ে দেয়। দোকানি সেই কাপ ধুয়ে পরিষ্কার করে থরে থরে সাজিয়ে রাখে। দোকানিকে বিড়ির ফরমাস দেয় কাশেম, ‘বিড়ি দ্যাও।’ ম্যাচলাইট জে¦লে বিড়ি ধরায় জুয়েল মিয়া। আকাশে ধোঁয়া ছুড়ে হতাশকণ্ঠে বলে, মাইয়াডার কী হইব অখন? কাশেমের জিজ্ঞাসা, কোন্ মাইয়াডা? ‘আরে ঐ মাইয়াডা। আমাগো মাইধ্যের হাটির রোসনা। লোকমানের লগে বিয়া দেওনের কথা চলছিল মাইয়ার।’ দোকানি আলোচনায় যোগ দেয়, ‘হুনলাম লাশ কেউ ছুঁইয়া দ্যাখতে পারে নাই।’ পান বাড়িয়ে দিতে দিতে দোকানি ফের প্রশ্ন করে, ‘রোগডার নাম য্যান কি?’ রবি সরকার জবাব দিয়ে বলে, ‘করোনাভাইরাস রোগডা সারা দুনিয়ায় ছড়াইয়া পড়ছে। বিজ্ঞানীরা কিছুই করতে পারতাছে না।’ ‘আহারে কেমন পোলাডা আছিলো। ওর কুনু শত্রু আছিল না। কিন্তুক মরল কেমনে?’ কাছন আলীর আফসোস। ‘করোনাভাইরাস?’ জুয়েল মিয়ার নির্লিপ্ত জবাব। ‘এইডা বুঝলাম। উপসর্গটা বুঝি নাই। অমনিতে কেউ মরে?’ কাছন আলীর এমন প্রশ্নে বিরক্ত হয় জুয়েল মিয়া। ‘হোনো না, জ্বর-সর্দি-কাশি হয়, এরপর শ্বাসকষ্ট। কেউ বাঁচে, কেউ বাঁচে না। টিভিতে দিনভর কয়, হোনো নাই!’ ‘কতকিছুই হুনি। হগ্গল কথার এককথা মাইয়ার অখন উপায়?’ গ্রামের মেয়ে রোসনা যাচ্ছিল মাঠে, ব্র্যাক থেকে পাওয়া গাইগরু নিয়ে আসতে। দৃষ্টি কেড়ে নেওয়ার মতো চেহারা, গঠন। গোলগাল মুখ। শ্যমল রঙ। পরিপাটি শাড়ি পরা সতেরো-আঠার বছরের মেয়ে। মুখ তুলে তাকাল, রবি সরকার। ‘ওই তো যায় মাইয়া। রহিমা বিবির ইচ্ছা লোকমানের বউ করব। এতিম মাইয়া। পালক মাইয়া অখন বড় অইছে। মাথা ভালা আছিল কিন্তুক নানাকিসিমের মানুষের চোখ পইড়া গেলে ওর উপর। এইখানেই বিদ্যা শ্যাষ।’ রবির কণ্ঠে এমন আফসোস ভাল লাগেনি বেঞ্চের কয়েকজনের। ছাপ্পান্ন কি আটান্ন বছরের তাগড়া শরীরের জুয়েল বলল, ‘বিবাহ হইব। দরকার অইলে আমি করুম। এই গেরোমের মাইয়া এই গেরামেই থাকব।’ উপস্থিত সবাই অবাক। আকস্মিক এমন কথা জুয়েলের মুখ থেকে শুনে তারা বিস্মিত। চোখ কপালে তুলে কাশেম বলল, ‘কথাডা কি বুইঝা কইলা?’ ‘কথাডা অখন মুখে আইল কেমুন করে?’ জুয়েল মিয়ার দিকে মুখ রেখে প্রশ্ন করে রবি সরকার। ‘খারাপ আবার কইলাম কী। থাকব-খাইব সুখে। আমি তো ক্ষেতি দেহি না।’ কাছন আলী বিরক্ত হলো কিন্তু প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘সমোয়ে দেহা যাইব।’একটু থেমে বলল, ‘অখন খবরটা পৌঁছাইবার ব্যবস্থা করো আগে। লোকমানের মায়েরে জানাইবার দায়িত্ব কেডা নিবা?’ রবি সরকারের দিকে তাকিয়ে কাশেম সমাদ্দার বলল, ‘দায়িত্বডা কী আমারেই নিতে কও?’ ‘ক্যান, আমি আছি না?’ জুয়েল মিয়ার এমন আগ্রহের কারণ খোঁজার চেয়ে লোকমানের মৃত্যুসংবাদ অনেক বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ। বেঞ্চে বসা সবাই দাঁড়িয়ে গেল। ২. যে যার প্রয়োজনে গেলেও কাছন আলীকে দেখে নন্দন স্যার হাঁটার গতি কমিয়ে দিলেন। দুই হাতে ব্যাগ ভরা বাজার নিয়ে ফিরছিল কুদ্দুস। তার থেকে প্রায় ছয় ফিট এগিয়ে রয়েছেন নন্দন স্যার। গ্রামের সবাই জানে সবধরনের ফুটফরমাস করতে অভ্যস্ত কুদ্দুসকে পছন্দ নন্দন স্যারের। এ যুবকের কথাবার্তা ভীষণ পছন্দ তার। ঠোঁট লাল করে পান খাওয়ার জন্য তল্লাটজুড়ে বিশেষ পরিচয় বহন করে সে। আজ তার মুখে মাস্ক। ষাটোর্ধ্ব বয়সী নন্দন স্যার। মুখে মাস্ক পরেছেন। দুজনের চলার পথ ইচ্ছা করেই যেন যথেষ্ট দূরত্বে, ফাঁকা রাখা হয়েছে। এতো ফাঁকা রাখার বিষয়টি কিছুটা হলেও বিস্মিত করে কাছন আলীকে। এগিয়ে এসে কারণ জানতে চায়। ‘শোনো দূরত্বে থাকো, কমপক্ষে ছয় ফিট।’ ‘কারণডা কি স্যার?’ কাছন আলীর জিজ্ঞাসা। ‘করোনাভাইরাস। দূরত্বে থাকতে হবে। সচেতনতা দরকার।’ ‘স্যার বাজার থেইকা আইলেন নাকি?’ ‘হ কাছন।’ একটু দাঁড়িয়ে নন্দন স্যার বললেন, ‘কী এক ধরনের ভাইরাস আসলো, করোনাভাইরাস এর নাম। বাজারে সবার মুখে মুখে ভাইরাসের কথা।’ কুদ্দুসের দিকে কাছন আলীর চোখ যেতেই শব্দ করে সে বলে উঠল, ‘হাঁ-হাঁ বাজার। বাজারের যেন আগুন লাগছে। কী য্যান দাম সওদাপত্র। খালি কয় করোনাভাইরাস।’ নন্দন স্যারের মুখ থেকে বাকি কথা শুনতে আগ্রহ কাছন আলীর। তার চোখে তাকিয়ে নন্দন স্যার জানতে চাইলেন, ‘কিছু বলবা কাছন?’ ‘স্যার, হুনলাম করোনাভাইরাসের হাত থেকে বাঁচনের পথ নাই। ওষুধ-বড়ি বাইর অয় নাই।’ ‘ঠিক শুনেছো, টিকা বের হয় নাই। বিশ্ববাসী অসহায়। সারাবিশ্ব অচল। বিশ্বসংকট। দেশের সরকার অসহায়। ২০২০ সালে আমাদের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান হলো না। বোঝো কী ভয়ংকর অবস্থা। মানুষ এই প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সুচিকিৎসা নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।’ ‘এইডা, মানে ভাইরাসডা নাকি ছড়াইয়া দেওয়া হইছে?’ কাছন আলীর এমন প্রশ্নে অবাক হন নন্দন। ‘তুমি কই থেকে শুনেছো?’ ‘নানাজনে কয়। মনুষ্যসৃষ্টি কাজ।’ বাজারের দুই ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নরম গলায় কুদ্দুস বলল, ‘স্যার, আমি যাইগা বাজার নিয়া।’ ‘ঠিক আছে, যাও। যার হাতেই বাজারের ব্যাগ দাও না কেন তার সঙ্গে দূরত্ব ঠিক রাখবা। মানে ফাঁকা রাখবা। করোনাভাইরাস- মনে থাকবে তো?’ হ্যাঁ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে কুদ্দুস। কপাল কুঁচকালেন। এদিক ওদিক তাকিয়ে নন্দন বললেন, ‘গুজব। প্রমাণ লাগবে, তাই না?’ এখন হাত ধোয়া একমাত্র পথ। খাওয়ার আগে এই কাজটা অবশ্যই করতে হবে। পরিষ্কার থাকতে হবে। বেতার- টেলিভিশন, পত্র-পত্রিকা এই কথাই প্রচার করছে।’ কথা শেষ করে নন্দন স্যার বাড়িমুখো মুখ ঘুরিয়ে নিতেই কাছন আলী বলল, ‘স্যার, কথাডা আপনে হুনছেন কিনা?’ ‘কি কথা?’ ‘লোকমান মারা গেছে।’ আশ্চর্য হলেন নন্দন স্যার। কয়েক সেকেন্ড নির্বাক। জানতে চাইলেন, ‘আমাদের লোকমান নাকি, কিভাবে?’ ‘গঞ্জে বাজার করতে গেছিলো। আপনিতো জানইন, সে বিদেশে আছিলো, এরপর করিন্টেনে ছিল। ডাক্তারের কথামতে টাইম পার হইছে। এরপর এই দুসংবাদ।’ ’করিন্টেন নয়, কোয়ারেন্টাইন।’ ‘হ, স্যার এইডা-ই।’ নিজের কাছে বিশ্বাস হচ্ছিল না এমন সংবাদ। বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্ন করলেন নন্দন স্যার, ‘খবর দিলো কে? জানলা কেমনে?’ ‘খবর পাইছি হাট থেইকা। হুনছি, লাশ কবর দিবো সরকারের লোকজনে। কেউ দেখবার পারব না, ছুঁইবার পারব না।’ ধীর গলায় বলল কাছন। ‘ওর মোবাইল ফোন এখন কার কাছে?’ ‘কেউ জানে না স্যার।’ কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন নন্দন স্যার। অনুমান করে বুকের ভেতর নিঃশব্দ কান্না হচ্ছে। চক্ষু অশ্রুভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। লোকমানের স্মৃতি তাকে পীড়া দেয়। একদা ছিল তারই এক মেধাবী ছাত্র। অভাবের সংসার। এসএসসি পরীক্ষার আগে অকালে বাবা মারা যাওয়ায় সে কাজের সন্ধানে নামে। এরপর বিদেশ পাড়ি দেয়। চার বছরে টাকা পয়সা রোজগার করে মায়ের মুখে হাসি ফিরিয়েছে। গ্রামবাসী জানে পালক মেয়ে রোসনাকেই রহিমা বিবি পুত্রবধূ করে ঘরে তুলবেন। নন্দন স্যার ওপরের দিকে অসহায় মুখ করে আকাশে তাকালেন। ‘আমি লোকমানের সঙ্গে কথা বলেছি এই সেদিনও। এখন উপায়? তার মোবাইল নাম্বার..।’ কাছন আলী বলল, ‘মোবাইল বন্ধ অইয়া আছে।’ নন্দন স্যার নিজের মোবাইল ফোন পকেট থেকে বের করে চেষ্টা করলেন কল করার। ফোনে উত্তর আসে, ‘আপনি যে নাম্বারে কল করেছেন সেটি বন্ধ আছে। দ্য নাম্বার ইউ আর কলিং ইজ ফ্রিস্টপ। প্লিজ ট্রাই এগেইন লেটার থ্যাংক য়্যূ।’ লোকমানের ভাবনায় স্থির থাকতে পারছিলেন না নন্দন স্যার। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আমিও আসছি রহিমা বিবির বাড়িতে। তোমরা যাও।’ ৩. রহিমা বিবির বাড়িতে কান্নার রোল। বিদেশ থেকে বাড়ি ফিরেই দোচালা টিনের ঘর তুলেছিল সে। চমৎকার ঘোছানো বাড়ি। উঠোনে গাইগরু বাঁধা। নারকেল গাছ সারি সারি। ছেলেকে নিয়ে কত ভাবনা ছিল রহিমা বিবির মনে। লোকমানের মুখটি বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। মুখে কোন কথা উঠছে না মায়ের। এ অবস্থায়ই পানি ঢেলে দেওয়া হচ্ছে রহিমা বিবির মাথায়। ছেলের মৃত্যুসংবাদ কানে পৌঁছতেই দাঁড়ান অবস্থা থেকে মাটিতে পড়ে যান তিনি। হাতের বস্তু পড়ে যায় নিচে। এরপর দীর্ঘক্ষণ প্রায় উন্মাদের মতো চিৎকার দিয়ে প্রলাপ বকছিলেন। কয়েকবার বলে উঠলেন, ‘আমারে ধইরা রাখো ক্যান তোরা? আল্লাহ আমারে নিয়া যাও গো আল্লাহ।’ নন্দন স্যার বাড়ির একটিমাত্র চেয়ারে বসেছেন। তার ছাতাটি চেয়ারে হেলান দেওয়া। মাথা নিচু করে বসে আছেন তিনি। ভেবে কূল পাচ্ছিলেন না কিভাবে সান্ত¦না দেবেন রহিমা বিবিকে। ঘরে মাথায় পানির ধারা দিতে দিতে নানাকথা মনে পড়ে রোসনার। বিদেশ থেকে ফিরেই আদর কণ্ঠে লোকমান বলেছিল, ‘সাজলে তোমায় খুব সুন্দর লাগে রোসনা।’ মাথাকোলে ফেলে রোসনা বলেছিল, ‘পাড়ার মাইনষে নানা কথা কয়। পালক মাইয়ারে বউ করবা না তুমি। তুমি পরীর লাহান সুন্দর মাইয়া বিবাহ করতে পার।’ লোকমানের মায়াময় মুখখানি নেচে ওঠে, ‘কি যে কও তুমি। গেরামের মানুষ নানাকথা কইব। এইসব কথা কী বিশ্বাস করো তুমি?’ স্মৃতির দোলায় চলে গিয়েছিল রোসনা। রহিমা বিবির হাত ধরে এক সমবয়সী বৃদ্ধা প্রায় কঁকিয়ে উঠলেন, ‘যানডা আছে ওর?’ সম্বিৎ ফিরে পায় রোসনা। রহিমা বিবির হাতের শিরা নড়ে না। নাড়ি কাঁপে না। বুকে হাত দিয়ে, কপালে হাত ঠেকিয়ে সাড়া পায় ন রোসনা। ঘর থেকে বের হয়ে কোনো একজন নারী চিৎকার দেয়, ‘তুমরা কেডা আছ, কেডা কই আছো, হুইনা যাও, রহিমা বিবি নাই। আর দুনিয়ায় নাই।’ উঠোনে জড়ো হয়েছিল পাড়ার মানুষ। এ সংখ্যা আরও দ্রুত বাড়ে। নন্দন স্যার দাঁড়িয়ে পড়েন। এগিয়ে এসেছিল পাড়ার লোকজন। কাছন আলীর চোখে পানি ঝরে। ৪. এমন ঝড়ের মুখোমুখি হয়নি এ গ্রামের কেউই। দশদিন কেটে গেছে। পাড়া খুঁজে আবিষ্কার করা হলো লোকমানের এক নানিকে। গ্রামের দুঃসম্পর্কের নানি এ বাড়িতে রাত কাটান। উঠতি বয়সের মেয়ে রোসনাকে একা রাখা অসম্ভব। পূর্ব নির্ধারিত বৈঠক আজ। নন্দন স্যার নিশ্চিত করেছিলেন মাস্ক পরে বৈঠকে আসতে হবে। সুতরাং তার নির্দেশ মানা হয়েছে। উপস্থিত সবার না হলেও কয়েকজনের মুখে মাস্ক। মৃত লোকমানের সহায়সম্পত্তির উত্তরাধিকার বাছাই করা ও রোসনার ভবিষ্যত নিয়ে মতামত দেওয়াই আলোচনার বিষয়। ঘরের সামনেই বাঁশের চটা দিয়ে তৈরি একটি বেঞ্চ। এখানে বসেছে গ্রামের মানুষেরা। নন্দন স্যার মাথা নিচু রেখেই কাছন আলীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘তুমিই শুরু করো।’ জুয়েল মিয়া পরিবেশ জটিল করতে চাইছে এটা আঁচ করতে পেরেছেন নন্দন স্যার। তিনি নিঃশব্দে এদিক ওদিক তাকালেন। ‘সহায়-সম্পদগুলানের মালিক অখন রোসনা। সবকিছুই ওর। এ্যাই কারণেই কই, রোসনার ক্ষতি হোক এ্যাইডা য্যান না অয়।’ থেমে থেমে কথাগুলো বলছিল কাছন আলী। রবি সরকার মাথা ঝুলিয়ে সায় দিয়ে বলল, ‘আমরা এ্যাইডাই চাই।’ একরকম জোর করে আনা হয়েছে রোসনাকে। এরপর জলচৌকিতে বসানো হয়েছে। বড় প্যাথেটিক সে-চেহারা। বড় অসহায় মুখ। বারান্দায় আড়ালে দাঁড়িয়ে একদল নারীর সঙ্গে সালিশের কথাগুলো শুনছিল রোসনা। বিরক্ত নানি ফিসফিস করে বলল, ‘বেডারা বিচার-সালিশে বইচে নাকি আঙুল চুসতে বইচে?’ জুয়েল মিয়া যাতে বেফাঁস কোনো কথা না বলে ফেলতে পারে এজন্য অনেক বেশি সতর্ক সঙ্গীরা। কিন্তু সঙ্গীসাথী সবাইকে ছাপিয়ে জুয়েল মিয়া বলে উঠল, ‘মাইয়া-মানুষ এই সম্পত্তির মালিক হইতে পারে না।’ বিচারসভা নীরব। একে ওপরের মুখের দিকে তাকাল। দু’ আঙুলের ভাঁজে পুড়তে থাকা সিগারেটে লম্বাটান দিলেন নন্দন স্যার। বারান্দার আড়ালে দাঁড়ানো রোসনার দিকে জুয়েল মিয়ার দৃষ্টি। শুধু রোসনা নয় বিচারে বসা সবাই তার আচরণের হেতু বুঝে নিয়েছে। কাছন আলী মনে করার চেষ্টা করল রোসনার বিয়ে নিয়ে সেদিন কী কথা হয়েছিল। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে আজ তার বক্তব্য কী ধরনের হওয়া চাই। চিন্তার ভিতরের অস্পষ্টতা তাকে কাবু করে ফেলেছিল। একটু শক্ত হয়ে বলল, ‘রোসনারে জুয়েল মিয়া বিবাহ করবার চায়। কথাডা সেদিনই বলেছিল।’ আবার বিস¥য় সভার। গ্রামবাসী যুবকদের মধ্যে কেউ একজন আপত্তির সঙ্গে হাত নেড়ে বলল, ‘না না, তা অইতে পারে না।’ পাল্টা জবাব জুয়েল মিয়ার। ‘আপত্তির কি অইল? সমাজ আছে না, মসজিদ-মাদরাসা আছে না। গেরামের কথা মাথায় রাখতে অইব।’ নন্দন স্যার মুখ খুললেন, ‘জুয়েল মিয়া কী বলতে চাও? এখানে মসজিদ-মাদ্রাসার প্রসঙ্গ আসবে কেন? তুমি বিষয়টা কোনদিকে ঘুরাতে চাও সবাই বুঝতে পারছে। যেকথাটা বুঝাতে চাও তা একাত্তর সালে কবর দিয়া আসছি। মা-মাটির জন্য অস্ত্র হাতে নিয়েছিলাম, দেশ স্বাধীন করেছি।’ মাথা নেড়ে সায় দেয়, কাছন আলী। ‘তুমি কী ভেবে নিয়েছে, স্বপ্ন ফলে যাবে আর চুকে যাবে সব?’ সামান্য মেজাজ চড়িয়ে বললেন, নন্দন স্যার। বাঁকা চোখে বিশেষ ভঙ্গিমা করে জুয়েল বলল, ‘স্যার কি য্যান কন। আমি কইবার চাই, সবটাই তো আমাগো চক্ষের সম্মুখে। লোকমান কেডা, কী আছিল বেবাকতেই জানে। আমি কই, রোসনারে তো ফালান যাইব না। আমার পরথম ইস্ত্রী রাজি আছে।’ রবি সরকার বলল, ‘গায়েপড়ে লাগনের স্বভাব ছাড় মিয়া।’ নন্দন স্যার রবিকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘শুধু তোমার প্রথম স্ত্রী রাজি থাকলেই হবে না। রোসনার ব্যক্তিগত মত নিতে হবে। এছাড়া বয়সে রোসনার চেয়ে তুমি পঁয়ত্রিশ বছরের বড়। একবার ভাবছো মিয়া?’ বারান্দা থেকে গর্জন করে নামল বৃদ্ধা নানি। ‘কী যা-তা কইতাচো বিচার-সালিশের বেডারা? লোকমানের কী পরিমাণ সহায়-সম্পদ আছে এ্যাইডা জানি না। এ্যাইসব খুঁইজা বার করতে হইব। আমি হের কেডা তুমরা বেবাকতে জানতাছ। লোকমানের সম্পদে আমার ভাগি অংশ নাই?’ ‘কী পাগলের মতো যা-তা বকছে নানি’। ফিসফিসিয়ে বলল রোসনা। কেউ একজন গ্রামের ভাঙা ইটবিছানো পথের দিকে চোখ রেখে বলল, ‘ঐ তো দেহা যায় লোকমান ভাইরে, আসতাছে।’ সবাই ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল লোকটার মুখের দিকে। ধন্দে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা কাছন আলীর। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না রোসনা। তার চোখ সর্বদাই প্রস্ফুটিত। তবু আস্তে উচ্চারণ করল, ‘ লোকমান ই তো।’ অতি সন্তর্পণে যেন চলে গেল অশ্রুপাত। ভূত দেখার মতো চোখ করে জুয়েল মিয়া বলল,‘বেডা মনে অয় লোকমান।’ চোখ জোড়া আনন্দে ছলছল করছিল নন্দন স্যারের। কাছে এলে ভেজাকণ্ঠে জানতে চাইলেন, ‘এতো দিন কোথায় ছিলে লোকমান?’ বাড়ির উঠোনে জড়ো হওয়া লোকজন দেখে খানিকটা আশ্চর্য হয় লোকমান। এরপর দম নিয়ে বলে, ‘স্যার, আমি মরি নাই। আমার করোনাভাইরাস হয় নাই। ফেরার পথে রাস্তায় রাস্তায় মানুষ আমারে অবাক হইয়া তাকাইয়া দেখছে। মাইনষে জিগায়, তুমি বাঁইচা আছো। স্যার, এ্যাইডা গুজব।’ বাড়ি ফেরার কাহিনী মাকে একান্তে বলতে উদগ্রীব লোকমান ঘরে ঢোকে। তার কণ্ঠে, ‘মা ওমা, তুমি কই?’
×