ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

করোনাভাইরাস ও মৌলবাদ

প্রকাশিত: ০৮:৪৮, ২ এপ্রিল ২০২০

করোনাভাইরাস ও মৌলবাদ

বিশ্বব্যাপী মহামারী সৃষ্টিকারী মরণব্যাধি করোনাভাইরাস (কোভিক-১৯) বাংলাদেশেও তার করাল থাবা ফেলেছে। রোগটি বাংলাদেশে কোন মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেনি, কিন্তু পৌঁছানোর আশঙ্কা দৃশ্যমান। করোনাভাইরাসের উপত্তিস্থল চীনও বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়েছে, বাংলাদেশে করোনাভাইরাস প্রতিরোধের ব্যবস্থা এখনও যথেষ্ট নয়। তা যে এখনও নয় তার বহু প্রমাণ আছে। বিষয়টি গোপন কিছু নয়। বিমানে করে প্রতিদিন কয়েক শ’ মানুষ ঢাকা বিমানবন্দরে ইউরোপ-আফ্রিকা-এশিয়ার দেশগুলো এসে পৌঁছাচ্ছে। কিন্তু ঐ প্রবাসীরা কোয়ারেন্টাইন আবেগজনিত কারণে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মেলামেশা করার ফলে অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন ও হতে পারেন। কোয়ারেন্টাইন, হোম কোয়ারেন্টাইনের বাণী নীরবে নিভৃতেই কেঁদে মরছে। করোনাভাইরাস সংক্রান্ত ব্যাপক প্রচারণা সকল প্রকার গণমাধ্যমে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনবরত করা হচ্ছে কিন্তু যারা সরাসরি যাবতীয় নিয়মকানুন নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে হাজার হাজার লাখো লাখো মানুষকে বিপদে ফেলার বা হাজারে হাজারে প্রাণহানি ঘটার আশঙ্কা তৈরি করে চলেছে, তাদেরকে তো কোন রকম শাস্তি দেয়ার ন্যূনতম উদ্যোগ দেখি না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সকল মহলের ব্যাপক দাবি ও নিন্দা প্রকাশের পর সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এপ্রিল পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষও তাবৎ ক্লাস ও আবাসিক হলগুলো বন্ধ ঘোষণা করেছে। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ কেউ বিপজ্জনক পোস্ট দিচ্ছেন। কেউ কেউ লিখছেন, ‘মুসলমান হলে মসজিদে জুমার নামাজ পড়বেই। তাতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাজারে হাজারে মরলেও তারা সরাসরি বেহেশতে যাবেন।’ অতঃপর এই জাতীয় পোস্ট দিয়ে ধর্মপ্রাণ কোমলমতি মানুষকে বিপদে ফেলতে সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে যারা উদ্যত হয়েছেন, তারা আসলে ধর্মপ্রাণ ও দেশপ্রেমিক ও নন, নন মানব প্রেমিকও। এ কথা নির্দ্বিধায় বলে দেয়া যায়, যে কোন জায়গায়, যে কোন উপলক্ষে বা যে কোন মুহূর্তে এই দুর্যোগের দিনগুলোতে জমায়েত সৃষ্টি করার পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ। তাই এমন জমায়েত সৃষ্টিকারীদের কঠোরভাবে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া জরুরী প্রয়োজন, যদি আমরা সত্যি সত্যি করোনাভাইরাসের আক্রমণ প্রতিহত করতে চাই। মৌলভীবাজার, লক্ষ্মীপুরে সম্প্রতি যে বিশাল বিশাল সমাবেশে ওয়াজ মাহফিলের নামে বিজ্ঞানবিরোধী প্রচারণা চালানো হলো তার বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করাতে সকল স্তরের মানুষ হতাশ ও ক্ষুব্ধ। স্পষ্টতই বোঝা যায়, সরকার এক্ষেত্রে অনেকটা অসহায় এবং তারা মৌলবাদী না হলেও মৌলবাদীদের কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে আছেন। বড় দুটি রাজনৈতিক দল করোনাভাইরাস এবং তা প্রতিরোধে বাংলাদেশ সরকারের আগ্রহ-অনাগ্রহ নিয়ে দ্বন্দ্ব-কলহে লিপ্ত। কিন্তু কেউই এগিয়ে আসছেন না দলীয়ভাবে এই রোগ সংক্রমণের ব্যাপারে জনসচেতনতা তৃণমূল পর্যন্ত সৃষ্টি করতে। সাবান, হ্যান্ড ওয়াশ, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক, কিটস প্রভৃতি জনগণকে বিনামূল্যে সরবরাহ করতে। যেন রাজনৈতিক অঙ্গনটি নিকষ কালো অন্ধকারে দিন দিন ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। একদিকে দেখি আত্মতৃপ্তির ঢেকুর, অপরদিকে চূড়ান্ত নেতিবাচক প্রচার। ফলে সমগ্র রাজনীতিই মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। একটু সম্ভাবনার আলো দেখাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন শাখা। ছাত্র ইউনিয়নের ছেলেমেয়েরা এক লাখ হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করে দরিদ্র পবিারগুলোর মধ্যে বিতরণ করতে শুরু করেছে। ছাত্র ইউনিয়নকে অভিনন্দন। অনুরূপ কাজে কি ছাত্রলীগ-ছাত্রদলও অনেক বেশি সাধ্যশক্তি নিয়ে এগিয়ে আসতে পারে না? পারল না তেমন কিছু করতে। পারছেও না দশকের পর দশক যাবত। তারা এখন রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে কামাই-রুজি, গাড়ি-বাড়ির স্বপ্নে বিভোর। আর্ত জনগণের কথা ভাবার সময় তাদের নেই। ডাঃ জাফরুল্লাহর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র অত্যন্ত প্রশংসনীয় একটি কাজ করে ধন্যবাদ পেয়েছে। তারা সম্প্রতি সস্তা দামে করোনাভাইরাস চিহ্নিতকরণে কিট আবিষ্কার করেছে, মাত্র ৩০০ টাকা খরচ পড়বে ঐ কিট তৈরিতে। আর তার মধ্যে রোগ শনাক্ত করতে মাত্র ৩৫০ টাকা লাগবে প্রতিটি ব্যক্তির টেস্ট করা বাবদ। উল্লেখ্য, এখন ঐ কাজে ৫০০০ টাকা জনপ্রতি নেয়া হচ্ছে, যার ফলে দরিদ্র সন্দেহভাজনরা রোগ চিহ্নিত করতেও ব্যর্থ হচ্ছেন। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী জানিয়েছেন, ঐ কিটস তৈরির কাঁচামাল ইংল্যান্ড থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে এসে পৌঁছাবে এবং দুই সপ্তাহের মধ্যেই তারা বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে দ্রুতই এটি বাজারজাতও করবেন। সরকারের উচিত সকল প্রকার রাজনৈতিক সংকীর্ণতার উর্ধে উঠে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের এই উদ্যোগ এবং ছাত্র ইউনিয়নের শুভ পদক্ষেপকে অভিনন্দন জানানো এবং সর্বাত্মক সহযোগিতার হাত বাড়ানো। অবশ্য সরকার তা করেছেও। চীন থেকে উৎপত্তি হওয়া এই ভয়াবহ রোগ সংক্রমিত হয়েছে চীন থেকে ইউরোপে, মধ্যপ্রাচ্যে, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায়। গোটা বিশ্ব আজ গভীর উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছে। এই পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশের মৌলবাদীরা ধর্মের নামে যে আয়োজন করছে তা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। চীনে ধর্মের বাড়াবাড়ি নেই। তারা কিছুদিনের মধ্যেই বিজ্ঞানের সাহায্যে দেশটাকে করোনামুক্ত বলে ঘোষণা করেছে। অবশ্য তিন সহ¯্রাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটেছে এবং লক্ষাধিক মানুষ সে দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিল। আবার গভীরভাবে ধর্মাশ্রয়ী দুটি দেশ সৌদি আরব ও ইরান দোয়া দরুদ বা ধর্মীয় মাহফিলের পথে না হেঁটে প্রায় সব মসজিদ বন্ধ করে দিয়েছে এবং শুক্রবারের জামাত নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। পরামর্শ দেয়া হয়েছে নিজ নিজ বাড়িতে নামাজ আদায়ের। আর আমরা? ধর্মের নামে মানবতা হত্যায় আমরা কুণ্ঠিত নই কেন? পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ইরাকে পর্যন্ত মসজিদগুলো সরকারী নির্দেশে বন্ধ ঘোষণা এবং জুমার নামাজ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস তাতে এতটুকুও কমছে না, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না। ঐ সব দেশের মুসলিমরা কি মুসলিম নন? আর কালবিলম্ব না করে সরকারকে কঠোর হতে বলি। রাজনীতির নামে, ধর্মের নামে বা অন্য কোন নামেই যেন কোন জমায়েত না হয়। অন্ততপক্ষে করোনাভাইরাস থেকে দেশটা সম্পূর্ণ মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত। প্রার্থনাগুলো মন্দিরে নয়, গির্জায় নয়, প্যাগোডায় নয়, মসজিদে নয় বা মাঠেও কোন জমায়েত নয়। সর্বাগ্রে মানুষ বাঁচানো সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ বাঁচলে ধর্ম বাঁচবে, মন্দির-মসজিদ-গির্জা-প্যালেস সবই বাঁচবে। লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক
×