ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

করোনায় গৃহবন্দী ফুটবলার সাজেদা!

প্রকাশিত: ০৮:৫৫, ৩১ মার্চ ২০২০

করোনায় গৃহবন্দী ফুটবলার সাজেদা!

স্পোর্টস রিপোর্টার ॥ কৃষক বাবা মোস্তফা কামাল এবং গৃহিণী মা আনোয়ারা খাতুনের তিন ছেলে, দুই মেয়ের মধ্যে তিনি চতুর্থ। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় ফুটবল খেলা শুরু করলে তখন কোন আপত্তি করেনি তার পরিবার। কিন্তু ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠলে তখন ‘এত বড় মেয়ে ফুটবল খেললে লোকে কি বলবে’ বলে পরিবার ঠিকই আপত্তি তুলেছিল। এতে তাল দিয়েছিল পাড়া-পড়শীরাও। কিন্তু তিনি ঠিকই লুকিয়ে খেলতে চলে যেতেন। তার স্কুলের মফিজ স্যারকে অনেক বেগ পেতে হয়েছিল তার বাবা-মাকে বুঝিয়ে মেয়েকে ফুটবল খেলানোর ব্যাপারে রাজি করাতে। যার কথা বলছি, তার উচ্চতা ৫ ফুট ২ ইঞ্চি। চেহারা মায়াকাড়া। কৃষ্ণকলি। বড়ই সরলমনা প্রকৃতির। নাম সাজেদা আক্তার। জাতীয় নারী ফুটবল দলের স্ট্রাইকার। গত ১৮ মার্চ বাফুফে করোনা ভাইরাসের কারণে ক্যাম্প বন্ধের ঘোষণা দিলে তার পরদিনই গ্রামের বাড়ি ময়মনসিহের ধোবাউড়ার কলসিন্দুরে চলে আসেন সাজেদা। জনকণ্ঠকে জানান, ‘পরিস্থিতির উন্নতি হলে আমাদের খবর দিলেই আবারও ঢাকায় চলে যাবো।’ ২০০৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর পৃথিবীর আলো দেখা সাজেদা এবার বাড়িতে এসে প্রথমদিকে কয়েকদিন অনুশীলন করলেও পরে করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়াতে এখন আর অনুশীলন করছেন না। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাড়ির বাইরে যাওয়া বন্ধ। বলতে পারেন একপ্রকার গৃহবন্দী হয়ে আছি! খুব বেশি হলে পাশের বাড়িতে বা উঠানে একটু হাঁটাহাঁটি করি। আমাদের এখানে মাইকিং করে দেয়া হয়েছে একমাত্র ডাক্তারি প্রয়োজন না থাকলে কেউ যেন ঘর থেকে বের না হয়।’ সাজেদা আরও যোগ করেন, ‘ভয় নিয়ে দিন কাটাচ্ছি। সবসময় সতর্ক থাকি। গ্রামে করোনা নিয়ে বেশ আতংক আছে। দিনে ৫/৬ বার সাবান দিয়ে হাত ধুচ্ছি। স্বস্তির কথা, আমাদের গ্রামে বা আমার পরিচিতজনদের কেউই এখনও করোনায় আক্রান্ত হয়নি।’ থানকুনি পাতা খাওয়া নিয়ে সাজেদা সলজ্জ জবাব, ‘মা আমাকেসহ বাড়ির সবাইকে একবার জোর করে খাইয়ে দিয়েছেন। এখন মনে হচ্ছে থানকুনি পাতা খেয়ে করোনামুক্ত থাকার বিষয়টা গুজব!’ সাজেদার মতে যারা প্রবাসী তারাই দেশে এই ভাইরাস ছড়ানোর জন্য দায়ী। কেননা দেশে ফিরে তারা কোন নিয়মকানুন মানেননি। গরীব মানুষরা যেন অঘোষিত লকডাউনের কারণে না খেয়ে মারা যায়, সেজন্য সরকার যেন ব্যবস্থা গ্রহণ করে, এমনটাই চান সাজেদা। অনেকেই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গেলে চিকিৎসকরা তাদের চিকিৎসা করতে চাইছেন না, ভর্তি করাচ্ছেন না, অসুস্থ হয়ে ঘরে পড়ে থাকলে প্রতিবেশীরা কেউ এগিয়ে আসছেনা না, বিনা চিকিৎসায় অনেকেই মারা যাচ্ছেন, এমনকি মারা গেলে জানাজা পড়তে বাধা দেয়া হচ্ছে এমনকি এলাকায় লাশের কবর পর্যন্ত দিতে দেয়া হচ্ছে না ... এ প্রসঙ্গে সাজেদার প্রতিক্রিয়া, ‘এসব ঘটনা খুবই দুঃখজনক। এসব শুনে খুবই কষ্ট পাই। আশা করবো এমনটা যেন আর কখনও না ঘটে।’ সরকার ঘোষিত দশ দিনের ছুটির মূল উদ্দেশ্য ছিল যে যার বাসায় অবস্থান করে হোম কোয়ারিনটাইন মেনে চললে করোনার প্রকোপ কমিয়ে আনবে। কিন্তু এই ঘোষণায় অনেকেই ‘ঈদের ছুটি’র কাটানোর মতো বিভিন্ন গণপরিবহনে চড়ে গ্রামে চলে গেছেন। এতে করে তারা নিজেরা তো বটেই, অন্যদেরও করোনায় আক্রান্ত করা মহাঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে সাজেদার ভাষ্য, ‘এই কাজটা করা মোটেও ঠিক হয়নি। তারা এটা বোকার মতো কাজ করে ফেলেছে। এখন গ্রামগুলোই সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে। এজন্যই এখন সবার অতিমাত্রায় সতর্ক থাকতে হবে।’ তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় ২০১২ সালে ফুটবল খেলা শুরু সাজেদার। বঙ্গমাতা স্কুল ফুটবলে কলসিন্দুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে। শেষের দুই বছর চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য ছিলেন সাজেদা। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে জেএফএ অনুর্ধ-১৪ বালিকা চ্যাম্পিয়নশিপ-এ অংশ নিয়ে টানা দুবার চ্যাম্পিয়ন হয় ময়মনসিংহ অনুর্ধ-১৪ মহিলা জেলা ফুটবল দল। প্রথম বছর না খেললেও শেষের বছর দলের অধিনায়ক ছিলেন সাজেদা। এছাড়া ওই আসরে ১২ গোল করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন। ২০১৪ সালেই সাজেদা ডাক পান জাতীয় অ-১৪ মহিলা ফুটবল দলে। এরপর পর্যায়ক্রমে খেলেছেন অ-১৫, ১৬, ১৭, ১৮ ও ১৯ দলেও। এই দলগুলোতে খেলে ১০টিরও বেশি গোল করেছেন সাবিনা খাতুন, লিওনেল মেসি এবং কিলিয়ান এমবাপ্পের ভক্ত সাজেদা। সাজেদার ভবিষ্যত লক্ষ্য দুটি। সিনিয়র জাতীয় দলে খেলা, এবং মহিলা সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের অধরা শিরোপা জেতা। এ পর্যন্ত ফুটবল খেলে ১৪ লাখ টাকা উপার্জন করেছেন কদিন আগে এসএসসি পরীক্ষা দেয়া সাজেদা। ‘বাবা-মা এতে অনেক খুশি। তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছেন। এই সেদিনও বাবাকে মনে করিয়ে দিলাম তিনি যে আমার খেলার ব্যাপারে আপত্তি করেছিলেন। শুনে বাবা লাজুকভাবে হেসেছেন!’ জাতীয় অ-১৯ দলে সাজেদার জার্সি নম্বর ২২। তবে তার পছন্দ ১২ নম্বরের জার্সি। আশা করে সিনিয়র দলে ডাক পেলে এই নম্বরের জার্সিটা একদিন তারই হবে। বাড়িতে এসে এখন অখণ্ড অবসর। সময কাটছে কি করে? ‘ফেসবুকে সতীর্থ ফুটবলারদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে কথা বলি। মাঝে মাঝে মাকে সংসারের কাজে সাহায্য করি।’ সবশেষে তিনি বলেন, ‘করোনা থেকে যদি বাঁচতে চান, তাহলে সবাইকে ঘরে থাকতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।’
×