ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রেজাউল ইসলাম

বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন চিন্তা

প্রকাশিত: ০৮:৩৫, ১ এপ্রিল ২০২০

বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন চিন্তা

আধুনিক যুগে যে ক’জন মহান বাঙালী তাদের নিখুঁত মেধা ও সুনিপুণ চিন্তা-ভাবনার আলোকছটায় বাঙালী জাতিকে বেঁচে থাকার নিরবচ্ছিন্ন প্রেরণা জুগিয়েছেন, তাদের মধ্যে শীর্ষে অবস্থান করছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী, বাংলাদেশের ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধের মহান স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নাগপাশ হতে মুক্ত করে তিনি বাঙালী জাতিকে শুধু একটা দেশই উপহার দেননি; সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামো কেমন হবে- তারও একটি যুগোপযোগী রূপরেখা দাঁড় করিয়েছিলেন। প্রিয় বাংলাদেশকে নিয়ে তার উনয়ন চিন্তা আজ সর্বজনবিদিত ও বহুল আলোচিত। আজ বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের মধ্যে যে প্রভূত উন্নয়ন পরিলক্ষিত হয় তার স্বপ্নদ্রষ্টা ও রূপকার ছিলেন বাঙালীর অবিসংবাদিত রাষ্ট্রনায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর ঘটনাবহুল জীবন এবং তাঁর সমাজ ও রাষ্ট্র দর্শন পাঠ করলে দেখা যায় তিনি তাঁর মাতৃভূমি বাংলাদেশের উন্নয়ন নিয়ে রাতদিন ভাবতেন। তাঁর সমগ্র রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড জুড়েই ছিল বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের ভাগ্যের উন্নয়ন। তিনি সর্বভারতীয় রাজনীতির চেয়ে বাংলার রাজনীতি, বাংলার ভাগ্য নিয়ে বেশি ভাবতেন। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে বাংলাদেশের প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করত এবং তাদের মধ্যে প্রায় ৬০ ভাগ মানুষ ছিল ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ভূমিহীন কৃষক ও দিনমজুর এবং অর্থনীতি ছিল কৃষিনির্ভর। এই বৃহৎ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর সরকার গ্রাম উন্নয়নের এক সামষ্টিক কর্মসূচী গ্রহণ করেছিল- যার মধ্যে ছিল চাষাবাদ পদ্ধতির আধুনিকায়ন করে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, গ্রাম সমবায়, ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষি জমির খাজনা মওকুফ, গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণ, কুটিরশিল্প স্থাপন এবং কৃষকের জন্য শস্যের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করা। গ্রাম উন্নয়নের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর সরকার শিল্পক্ষেত্রে দৃশ্যমান অগ্রগতি সাধনের লক্ষ্যে বড় বড় শিল্প-কারখানা, ব্যাংক, বীমা ও বৈদেশিক বাণিজ্যের একাংশ জাতীয়করণের আওতায় নিয়ে আসে। কিন্তু পরিচালনাগত অদক্ষতা ও শ্রমিক অসন্তোষের কারণে সে পদক্ষেপ সফলতার মুখ দেখেনি। অব্যাহত বাণিজ্য ঘাটতির প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর সরকার রফতানি বৃদ্ধিকল্পে প্রচলিত পণ্যের পাশাপাশি অপ্রচলিত পণ্য রফতানি বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেয়। তারই ফলে আজ বাংলাদেশের রফতানি বৃদ্ধিতে অপ্রচলিত পণ্যের অবদান অনেক বেড়েছে। তবে শিল্প-বাণিজ্য নয়; বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল গ্রাম উন্নয়ন, কৃষির উন্নয়ন, মেহনতী মানুষের আয় ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস ইত্যাদি। শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড- এ দর্শনের আলোকে বঙ্গবন্ধু দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী, বিজ্ঞানসম্মত, মানসম্মত ও বাস্তবমুখী করার লক্ষ্যে দেশের নামকরা বিজ্ঞানী ড. কুদরত-ই খুদার নেতৃত্বে ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই ১৯ সদস্যবিশিষ্ট শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। কুদরত-ই খুদা কমিশনের রিপোর্টে বঙ্গবন্ধুর ভূয়সী প্রশংসা করে বলা হয়,’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐকান্তিকতা, আগ্রহ, উৎসাহ ও সাহায্য ছাড়া কমিশনের পক্ষে এ দুরূহ কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হতো না। আমরা তার কাছে বিশেষভাবে ঋণী ও কৃতজ্ঞ।’ এই একটি বাক্যই বলে দেয় এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অবদান কত ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী ছিল। শিক্ষার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা খাতে পুঁজি বিনিয়োগের চেয়ে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর কিছু হতে পারে না।’ জাতীয় উৎপাদনের শতকরা কমপক্ষে চার ভাগ সম্পদ শিক্ষা খাতে ব্যয় হওয়া উচিত বলে তিনি মনে করতেন। বস্তুত, বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ে ছিল শিক্ষার প্রতি অসামান্য ভালবাসা ও অনুরাগ। বঙ্গবন্ধু তার দেশকে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ একটি আদর্শ সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখতেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার লড়াই ছিল আপোসহীন। নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী বিশ্বখ্যাত আইনজীবী সন ম্যাকব্রাইড বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব বুঝতে পেরেছিলেন, স্বাধীনতা শুধু পতাকা পরিবর্তন ও দেশের নতুন নামকরণ বোঝায় না, তাঁর দৃষ্টিতে স্বাধীনতার অর্থ হলো সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ও নীতিবোধসম্পন্ন আদর্শবাদ।’ তাঁর সকল কর্মকাণ্ডের মূলে ছিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি- গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। আমৃত্যু তিনি এই আদর্শগুলো হতে বিচ্যুত হননি। দক্ষভাবে রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনার উদ্দেশ্যে তিনি প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ পদক্ষেপের লক্ষ্য ছিল রাজধানীতে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা ও সম্পদকে প্রত্যন্ত এলাকায় স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নিকট হস্তান্তর করা যেখানে স্থানীয় উন্নয়নের কাজ স্বতন্ত্রভাবে চালু থাকবে। সেখানে উন্নয়নের মূল একক হবে গ্রাম। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত গ্রাম সরকার স্থানীয়ভাবে কর সংগ্রহ করতে পারবে। স্থানীয় এ কর্তৃপক্ষের প্রধান কাজ হবে- গ্রামীণ জনশক্তির ব্যবহার, ভূমি সংস্কার কর্মসূচী, উফসি চাষ সম্প্রসারণ, শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন, পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচীর বাস্তবায়ন এবং গ্রামীণ কৃষি শিল্পের প্রসার। মোটকথা, বঙ্গবন্ধু প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে স্থানীয় সরকারের এবং গ্রাম সরকারের সঙ্গে শহরের ব্যবধান কমিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। ‘কেমন বাংলাদেশ চাই’- প্রসঙ্গে ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ প্রথম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বেতার ও টিভি ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার সরকার অভ্যন্তরীণ সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাস করে। এটা কোন অগণতান্ত্রিক কথা নয়। আমার সরকার ও পার্টি বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। একটি নতুন ব্যবস্থার ভিত রচনার জন্য পুরনো সমাজ ব্যবস্থা উপড়ে ফেলতে হবে। আমরা শোষণমুক্ত সমাজ গড়ব।’ বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন ছিল এদেশের গণমানুষের সুখ-সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এক গভীর মানবিক সংগ্রামী দর্শন। তার এ দর্শনের ভিত্তিমূলে ছিল ঐতিহাসিক বিশ্বাস, যার মতে কেবল জনগণই ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দর্শন অনুযায়ী, গণমানুষের মুক্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শেষ পর্যন্ত মুক্তি সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে জন্ম হলো ‘গণপ্রজাতন্ত্রী’ বাংলাদেশের, যেখানে সাংবিধানিকভাবেই প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। তার এ দর্শনের স্পষ্ট প্রতিফলন- তাঁর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্ন, দুর্নীতি-শোষণ, বঞ্চনা-দুর্দশামুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন। শেষ করতে গিয়ে বলতে হয়, বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন ভাবনার ব্যাপ্তি ছিল সর্বত্র এবং তা ছিল সর্বজনীন, অব্যর্থ ও কালজয়ী। আমৃত্যু তিনি যে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বুকে ধারণ করেছিলেন এবং সেই অপূর্ণ স্বপ্ন হৃদয়ে আঁকড়ে ধরে ধরাধাম ত্যাগ করেছিলেন, তাঁর সে স্বপ্ন আজ আর কল্পনা নয়, নয় কোন অলীক বাসনা। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা আজ তার সুযোগ্য তনয়া গণতন্ত্রের মানসকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বাস্তবে রূপ লাভ করেছে। আজকে আমরা যে সুখী- সমৃদ্ধ বাংলাদেশকে দেখছি, দেশের আনাচে কানাচে যে উন্নয়নের জোয়ার দেখছি, পিচঢালা রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের আধিক্য দেখছি, দেখছি মেট্রোরেল কিংবা পদ্মা সেতুর দৃশ্যমান বাস্তবতা- সেসবের স্বপ্নদ্রষ্টা আর কেউ নন, তিনি হলেন বাঙালীর গর্ব, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। লেখক : সহকারী শিক্ষক, সাতক্ষীরা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় [email protected]
×