ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

করোনা সংক্রমণ রোধের চেষ্টা

তিন হাজারের বেশি কারাবন্দীকে জামিন দেয়ার উদ্যোগ

প্রকাশিত: ১০:৪৩, ৩১ মার্চ ২০২০

তিন হাজারের বেশি কারাবন্দীকে জামিন দেয়ার উদ্যোগ

মশিউর রহমান খান ॥ দেশের ৬৮ কারাগারে ছোটখাটো অপরাধ ও জামিনযোগ্য ধারায় বিচারাধীন ৩ হাজারের বেশি কারাবন্দীকে জামিন দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। করোনাভাইরাসে সৃষ্ট দুর্যোগের কারণে কারাগারে আটক বন্দীর সংখ্যা কমাতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে কারাসূত্রে জানা গেছে। বর্তমানে দেশের সব কারাগারে বন্দী ধারণক্ষমতা রয়েছে ৪১ হাজার ৩১৪ জন। এর বিপরীতে বর্তমানে ৮৯ হাজারের বেশি বন্দী আটক রয়েছেন। কয়েকদিন পূর্বে যা ৯০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অপরাধের কারণে এসব বন্দী আদালতে বিচারাধীন অবস্থায় মাসের পর মাস কারা প্রকোষ্ঠে দিন কাটাচ্ছেন। অধিক বন্দীর কারণে সরকারের বিশেষ নির্দেশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগ কারা অধিদফতরের এসব বন্দীর তালিকা তৈরি করে পাঠাতে নির্দেশ দিয়েছে বলে জানা গেছে। কারা কর্তৃপক্ষ সারাদেশের সব কারাগার থেকে ইতোমধ্যেই এসব বন্দীর তথ্য সংগ্রহের কাজ দ্রুততার সঙ্গে করছে বলে জনকণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক ও পাবলিক হেলথ বিশেষজ্ঞ কর্নেল আবরার হোসেন। তালিকায় থাকা এসব বন্দীকে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত গ্রহণ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশক্রমে ও চূড়ান্ত মতামতের ভিত্তিতে যাচাই বাছাই ও আইনানুগ পদ্ধতি অবলম্বন করে জামিন দেয়া হবে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। অপর একটি সূত্র জানায়, বিভিন্ন সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এমন বন্দীর তালিকা করে আইনানুগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে লঘু অপরাধে অভিযুক্ত অথচ দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে আটক রয়েছেন এমন বন্দীদের তালিকা করে মুক্তি প্রদান করা হয় বলে জানা গেছে। এরই অংশ হিসেবে সরকার মরণঘাতী মহামারী করোনার ক্রান্তিলগ্নে আইনানুগ প্রক্রিয়া অবলম্বন করে এসব বন্দীদের মুক্তি প্রদানের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বলে জানা গেছে। তবে মুক্তির আগে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত প্রয়োজন হবে। কারা সূত্র জানায়, জামিনের উদ্যোগ নেয়া এমন বন্দীর সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার ১০০ এর মতো। তবে একইসঙ্গে বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত যার বেশিরভাগ অংশ তথা যেসব বন্দীর কমপক্ষে ২০ বছর কারাবাস অতিক্রান্ত হয়েছে কিন্তু কারাভ্যন্তরে থাকাবস্থায় কোন ধরনের অন্যায় আচরণ করেননি এমন বন্দী ও জেলকোড অনুযায়ী সরকারের কাছে আবেদন করে রাষ্ট্রের ক্ষমা পেতে পারের কারা কর্তৃপক্ষ এমন বন্দীদের তালিকাও তৈরি করছে বলে জানা গেছে। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে এমন আসামি আটক রয়েছেন যারা কারাভ্যন্তরে চলাচলে অক্ষম অর্থাৎ এসব বন্দী নিজেরা একা চলতে পারে না অন্য বন্দীর সাহায্য নিয়ে চলাফেরা করতে হয় এমন বন্দীও রয়েছে বলে জানা গেছে। কারাসূত্রে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। সরকারের নির্দেশে তৈরি এসব বন্দীর তালিকা পাওয়ার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোন বিবেচনায় তাদের জামিন দেয়া হতে পারে তা যাচাই করবে। এছাড়া কোন কোন ধারায় করা মামলায় কতদিন পুরুষ ও নারী বন্দী কতদিন ধরে আটক রয়েছেন তাও বিবেচনা করবে বলে জানা গেছে। কারাসূত্র জানায়, এমন আসামিও রয়েছেন যাদের বিচারাধীন অবস্থায় কারাগারে কেটে গেছে ৬ মাসের বেশি সময় অথচ আদালতের রায়ে সর্বোচ্চ ৬ মাস পর্যন্ত সাজা হতে পারে। জানা গেছে, ক্ষুদ্র অপরাধ হিসেবে যারা চুরি, মারামরি, ছিনতাই বা পকেটমার, যৌতুক নিরোধের কিছু ধারায় আটক ছোটছোট অপরাধ করেছে এমন বন্দী। জানা গেছে, জামিনযোগ্য ধারা হিসেবে ৩২৩, ৩২৪, ৩৭৯, ৩৮০,৩৮১ ৫১১, ৫০৬, ৪২০, ৪০৬, ৪৫৭ ধারাসহ কিছু ধারা রয়েছে। সূত্র জানায়, এসব বন্দীর সর্বোচ্চ সাজা ২ বছর ও সর্বনি¤œ ৬ মাস জেল হতে পারে। এর মধ্যে এমন অনেক আসামি রয়েছে যে, যারা ৬ মাসের বেশি কারাভোগ করেছেন অথচ এসব মামলায় আইনী দীর্ঘসূত্রতায় আসামিরা জামিন পাচ্ছেন না। এমতাবস্থায় কারাগারের গাদাগাদি করে বন্দীদের থাকতে হয়। ফলে বন্দীদেও মাঝে করোনার আতঙ্ক সর্বাবস্থায় কাজ করছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সরকার করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমাতে কারাবন্দীর সংখ্যা কমাতে এ উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা গেছে। প্রাথমিকভাবে ৩ হাজারের বেশি কারাবন্দীকে মুক্তি প্রদানের কথা বললেও পরবর্তীতে নানা রকম মামলায় যেখানে সরকার নিজস্ব ক্ষমতাবলে বিশেষ ক্ষমতায় বা নির্বাহী আদেশে আসামি মুক্তি দিতে পারে এমন আসামিদেরও মুক্তির পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার তবে এক্ষেত্রে আরও কিছু সময় নেয়া হবে বলে জানা গেছে। এমন আসামির সঙ্গে আদালত ও সরকারের উভয়ের সম্পর্ক থাকায় একইসঙ্গে আইনানুগ প্রক্রিয়া থাকায় তা করার প্রক্রিয়া চলছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। সূত্র জানায়, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তুলনামূলক ছোটখাটো অপরাধে আটক রয়েছেন এমন বন্দী হচ্ছে ১ হাজার ১৪৮ জন। কোন নারী বন্দী এ কারাগারে আটক রাখার ব্যবস্থা না থাকায় যার সবাই পুরুষ। অপরদিকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক রয়েছেন ১১৮ জন এর মধ্যে পুরুষ ১১০ ও নারী ৮। নারীদের প্রায় সবাই চুরি ও মারামরি মামলায় আটক রয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে দেশের সব কেন্দ্রীয় কারাগার ও গুরুত্বপূর্ণ জেলা কারাগারগুলোতে এসব বন্দীর সংখ্যা বেশি বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মাহবুবুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, কারা অধিদতরের নির্দেশে আমরা তুলনামূলক লঘুঅপরাধে অভিযুক্ত আসামির তালিকা করেছি। ঢাকা জেলে এর সংখ্যা মোট ১ হাজার ১৪৮ জন। তালিকায় ছোট ছোট অপরাধের আসামিরা রয়েছে। বর্তমানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ধারণক্ষমতার দ্বিগুণের বেশি বন্দী আটক রয়েছেন স্বীকার করে তিনি বলেন, বন্দীর সংখ্যা বেশি হলেও করোনার এ প্রাদুর্ভাবের সময় সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে আমরা করোনাভাইরাস মোকাবেলায় নানা উদ্যোগ গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করছি। তবে বন্দী সংখ্যা বেশি হওয়ায় ও প্রয়োজনের তুলনায় স্টাফ কম থাকায় বন্দী ব্যবস্থাপনাই আমাদের কিছুটা হিমশিম খেতে হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক ও পাবলিক হেলথ বিশেষজ্ঞ কর্নেল আবরার বলেন, কারাগারে বর্তমানে ধারণক্ষমতার দ্বিগুণের বেশি বন্দী আটক রয়েছে। সর্বোচ্চ চেষ্টার সঙ্গে করোনার এ প্রার্দুভাব ঠেকাতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি অবিরত। সরকারের নির্দেশে কারা কর্তৃপক্ষ সবসময়ই কারাবন্দীর হার কমাতে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে কাজ করে। এরই অংশ হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সারাদেশের ৬৮ কারাগারে আটক বিচারাধীন হাজতি আসামি যারা তুলনামূলক লঘুঅপরাধে আটক এমন বন্দীদের তালিকা তৈরি করছি। তবে এ তালিকায় কোনক্রমেই খুনী, ধর্ষণ মাদক বা কোন মামলার দুর্ধর্ষ আসামির নাম অন্তর্ভুক্ত করা হবে না। দেশের সব কারাগার থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এমন বন্দীর সংখ্যা সারাদেশে প্রায় ৩ হাজারের বেশি। যার চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। চুরি, পকেটমার, ছিনতাইয়ের চেষ্টা, যৌতুকের ৩ ধারার মতো বেশ কিছু মামলার আসামি জামিনযোগ্য অপরাধে আটক রয়েছেন এমন বন্দীও রয়েছেন। যাদের আদালতের বিচারে সর্বোচ্চ সাজা ৬ মাস থেকে ২ বছর পর্যন্ত হতে পারে। এর মধ্যে মাসের পর মাস ধরে বিচারাধীন অবস্থায় কারাগারে আটক রয়েছেন। আইনী জটিলতায় যাদের জামিন প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। পাবলিক হেলথের এ বিশেষজ্ঞ বলেন, আমরা বন্দীদের সব তথ্যসহ তালিকা চূড়ান্ত করার পর কোন কোন মামলায় কতদিন ধরে কোন আসামি কোন কারাগারে আটক রয়েছেন তার পূর্ণাঙ্গ তথ্যসহ একটি তালিকা তৈরির কাজ করছি। যা প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। সরকারের উর্ধতনদের নির্দেশে তৈরি এ তালিকা চূড়ান্ত করার পর আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর পর মন্ত্রণালয় এ তালিকা যাচাই বাছাই করে হয়তো আইনানুগ পদ্ধতিকে কিভাবে এসব আসামিকে জামিনে মুক্তি দেয়া যায় তার প্রক্রিয়া শুরু করবেন। এজন্য আইন মন্ত্রণালয়সহ প্রয়োজনীয় সব পর্যায়ে মতামত নেয়া হবে। এরপরই সরকারের সর্বোচ্চ নির্দেশ পেলেই কেবল এসব আসামিকে আমাদের পক্ষে জামিন প্রদান করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, নিয়মানুযায়ী আমরা সারাবছরই এমন আসামিদের তালিকা তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠাই। পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইনানুগ পদ্ধতিতে তাদের জামিন প্রদান করেন। কারাগারে বন্দীর হার কমানো প্রসঙ্গে কর্নেল আবরার বলেন, এসব আসামির বাইরেও ৫৬৯ ধারা অনুযায়ী যেসব দ-প্রাপ্ত আসামি ইতোমধ্যেই ২০ বছরের বেশি সাজা ভোগ করেছে ও কর্মক্ষম অচল আসামিদের সরকারের আদেশে তাদের মুক্তি প্রদানের প্রক্রিয়া চলছে। এ সম্পর্কে ব্যবস্থা নিতে আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিয়মিত চিঠি প্রদান করে আসছি। এসব আসামিদেরও জামিনে মুক্তি দিতে সরকারের নির্দেশে স্বারাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গুরুত্বের সঙ্গে কাজ করছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব মোঃ শহীদুল্লাহ জনকণ্ঠকে বলেন, কারাগারে বন্দীর সংখ্যা অবশ্যই ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ তা অনেকদিন ধরে। তবে নিয়মানুযায়ী আমরা সব সময়ের মতো কারাগারে আটক লঘু অপরাধের আসামিদের তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছি। চূড়ান্ত তালিকা তৈরির পর সরকার এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। তবে তাদের জামিন দেয়া হবে হবে কি না তা এখনই বলা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, বন্দীর জামিনে মুক্তির বিষয়ের এখনও কোন প্রস্তাব হাতে পাইনি। তাই বিষয়টি ভাল জানি না। কারণ বন্দীর মুক্তি প্রক্রিয়ার কাজটি করবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে বন্দীর চূড়ান্ত তালিকা তৈরির পর এদের জামিন নিয়ে লিখিত কিছু পাওয়ার পরই তা আইনানুগ পদ্ধতিতে মতামত দেয়া সম্ভব হবে। এর আগে এ নিয়ে কিছু বলা সম্ভব হচ্ছে না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এমপি জনকণ্ঠকে বলেন, করোনার প্রদুর্ভাবের এ সময় জামিনযোগ্য ধারায় নির্দিষ্ট ধারার বেশ কিছু আসামিকে কিভাবে প্রাথমিকভাবে জামিনে মুক্তি দেয়া যায় তার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের সব কারাগারে ধারণক্ষমতার দ্বিগুণেরও বেশি আসামি আটক রয়েছেন। তাই নিয়মানুযায়ী বন্দী সংখ্যা কমাতে আমরা নিয়মিত কাজ করছি। তিনি বলেন, মূলত দেশের সব কারাগারের আটক তুলনামূলক লঘু অপরাধে অভিযুক্ত ও জামিনযোগ্য ধারায় আটক বিচারাধীন আসামিদের সংখ্যা বের করতে ও কোন কোন ধারায় তারা কতদিন ধরে আটক রয়েছেন তার জন্য আমরা কারা কর্তৃপক্ষের কাছে তালিকা চেয়েছি। কোন দ-িত আসামি এ তালিকায় আসবে না। স্বরাষ্ট্র বলেন, দেশের সব কারাগার থেকে আসা চূড়ান্ত তালিকা প্রাপ্তির পর কিভাবে আইনানুগ প্রক্রিয়ায় তাদের জামিন দেয়া যায় তার প্রক্রিয়া চলছে। তবে অব্যশ্যই আইনমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে ও আইন মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজনীয় মতামত প্রদান স্বাপেক্ষে ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশনা ও মতামতের ভিত্তিতে বিষয়টি সমাধান করা হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সব আইনকানুন মেনেই ব্যবস্থা নেয়া হবে। নিয়মের কোন ব্যত্যয় ঘটতে দেয়া হবে না।
×