বিশ্ন আজ মহাসঙ্কটে। মানবসভ্যতা প্রায় যেন ভেঙ্গে পড়েছে। সৃষ্টির সেরা প্রাণী মানবজাতি তার অস্তিত্বের লড়াইয়ে নেমেছে। এমন সঙ্কটকাল মানবজাতিকে এর আগেও অতিক্রম করতে হয়েছে। মানবসভ্যতার ইতিহাস ঘাঁটলে এর সত্যতা পাওয়া যাবে। ১৯২০ সালে ভয়ঙ্কর রোগ প্লেগ হাজার হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। এ উপমহাদেশেও প্লেগের থাবার কথা কম-বেশি সকলেরই জানা আছে। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে এ পর্যন্ত বহু রোগ-ব্যাধির কথা আমরা জেনেছি, যার কোন চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল না। কলেরা, গুটিবসন্ত, যক্ষ্মা, পরবর্তীতে এইড্স নামক রোগে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। ক্যান্সার নামক রোগে পৃথিবীর লাখ লাখ মানুষ এখনও আক্রান্ত হয়ে আছে। এসব রোগ ছোঁয়াচে নয় বিধায় তেমন কোন ভীতি সঞ্চার করতে পারেনি মানুষের মনে। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় উল্লিখিত রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কার হওয়ায় মানুষ তেমন একটা শঙ্কিত নয়। তবে করোনাভাইরাসে বিশ^ যেন ঘাবড়ে গেছে। বিশ^ প্রায় স্তব্ধ আজ। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ল-ভ-। উল্লেখ্য, বিগত বিশ বছরে মানবজাতি বেশ কিছু ভাইরাসের সঙ্গে পরিচিতি লাভ করেছে- যেমন জিকা ভাইরাস, নিপা ভাইরাস, ইবোলা ভাইরাস ইত্যাদি। কিন্তু করোনাভাইরাসের মতো এমন ভয়ঙ্কর ভাইরাস পৃথিবীর মানুষ ইতোপূর্বে আর দেখেনি। এ ভাইরাসে বিশ্ব যেন থমকে গেছে। এ ভাইরাসকে কেন্দ্র করে কূটনৈতিক স্থায়ুযুদ্ধও শুরু হয়ে গেছে। বিশে^র শক্তিধর দেশ যুক্তরাষ্ট্র দোষারোপ করছে চীনকে, আবার চীন দোষারোপ করছে যুক্তরাষ্ট্রকে। তবে পরস্পরে দোষারোপের সময় এখন নয়। চীন যুক্তরাষ্ট্রকে সহযোগিতার আশাবাদ ব্যক্ত করেছে। পৃথিবীর পরাক্রমশালী যুক্তরাষ্ট্র এখন ভয়ঙ্কর বিপদে। তাই কার দোষ এ সিদ্ধান্তে পরে আসা যাবে। কিন্তু বর্তমানে কিভাবে করোনাকে মোকাবেলা করে মানবজাতি তথা মানবসভ্যতাকে বাঁচানো যায় সে চেষ্টা করতে হবে বিশ^ নেতৃবৃন্দকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে। অর্থবিত্ত, বৈভবের অহমিকা নয়, মানুষকে তার হৃদয়-মন দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে যে, কিভাবে নিজেকে সুরক্ষা করা যায় এবং অন্যকে সুরক্ষা দেয়া যায়। যেহেতু করোনাভাইরাসের কোন প্রতিষেধক এখনও কোন বিজ্ঞানী আবিষ্কার করতে পারেননি, তাই বিকল্প চিন্তার আলোকেই আমাদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
এ রোগটি ভয়ঙ্করভাবে ছোঁয়াচে। একজন আক্রান্ত হলে জ্যামিতিক পদ্ধতিতে একজনের মাধ্যমে ৫৯ হাজার সংক্রমিত হতে পারে বলে গবেষণায় বলা হয়েছে। তাই মানুষকে দরুণভাবে ভাবিয়ে তুলছে। ছোঁয়াচে রোগ বলে পরম সম্প্রীতি ও মানবতার দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ যেন আজ অমানবিক দেশের তালিকায় নাম লিখিয়ে ফেলেছে। এটা আমাদের জন্য বড় মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক। এজন্য দায়ী আমাদের রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কতিপয় ব্যক্তির উদাসীনতা। বিশেষ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রণাদাতাদের শৈথিল্য। যারা যে পদের যোগ্য নন তারা যদি সে পদ আগলে থাকেন নির্লজ্জভাবে তবে একটি রাষ্ট্রের দুর্ভাগ্যবরণ করা ছাড়া কোন উপায় থাকে না। হয়তো অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন ইউরোপ-আমেরিকার মতো উন্নত ও ধনী দেশগুলো যেখানে করোনা প্রতিরোধে ব্যর্থ হচ্ছে, সেক্ষেত্রে আমাদের কি করার আছে? কিন্তু ওদের সঙ্গে আমাদের তুলনা করার কোন যৌক্তিক কারণ নেই। আমাদের হাতে যথেষ্ট সময় ছিল। আমরা সে সময় হেলায় হারিয়েছি। ঢাকঢোল পিটিয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতির কথা বলা হলেও বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। প্রথমত, প্রবাসী বাংলাদেশীরা যখন দলবেঁধে আমাদের দেশে প্রবেশ করে তখন তাদের প্রতিরোধে ব্যর্থতা। যেহেতু তারা আমাদের দেশের নাগরিক, তাই দেশে ফিরে আসা তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার। তাই বিমানবন্দরেই করোনা পরীক্ষা করার যথাযথ ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। যে পরীক্ষাটি আইইসিডিআর-এ হচ্ছে। যাদের করোনার উপস্থিতি পাওয়া যেত তাদের সরাসরি হাসপাতালে বিশেষ ব্যবস্থায় চিকিৎসা দেয়া, বাকিদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রাখা, বিমানবন্দরের কাছেই সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে একটি অস্থায়ী করোনা হাসপাতাল নির্মাণ করা উচিত ছিল। সেজন্য চিকিৎসকদের পিপিইর ব্যবস্থাটাও পূর্বেই করে রাখা উচিত ছিল। কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয়েছে। উল্লেখ্য, ৮ মার্চ যেদিন করোনা বাংলাদেশে শনাক্ত হলো তখন পিপিইর কথাটা উঠেছিল। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছিলেন এখনই পিপিইর সময় হয়নি। প্রিয় পাঠক স্বাস্থ্যমন্ত্রী যে কতটা দায়িত্বহীন তার প্রমাণ গত বছর ডেঙ্গুর প্রকোপে উল্টাপাল্টা তথা তামাশামূলক কথা বলে প্রমাণ দিয়েছেন। আমাদের প্রিয় নেত্রী কোন্ ভরসায় তাকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বানালেন সেটা তিনিই ভাল জানেন। দ্বিতীয়ত, স্বরাষ্ট্র, বিমান, পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা, স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে একটি কার্যকরী পরিষদ গঠন করে সমন্বিত উদ্যোগে ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেয়া উচিত ছিল। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে যে কমিটি হয়েছে তা কতটা সফল হবে সন্দেহ রয়েছে। দুর্ভাগ্য, সকলেই যেন ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকেন। প্রধানমন্ত্রী গত ২৫ মার্চ গঠনমূলক ও দিকনির্দেশনামূলক একটি ভাষণ দিয়েছেন। করোনার মতো প্রাণঘাতী ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে কিভাবে মানবজাতিকে রক্ষা করা যায় তা বিশ্বব্যাপী ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। তিনি তাঁর বিশ্বাসের জায়গা থেকেই বলেছেন যে, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নিশ্চয়ই বিশ^বাসী এ দুর্যোগ থেকে দ্রুত পরিত্রাণ পাবে। এ সঙ্কটময় সময়ে আমাদের সহনশীল ও সংবেদনশীল হতে হবে। বাংলাদেশ এখন কার্যত অলিখিত লকডাউনে আছে। দেশের মানুষ এ মুহূর্তে স্বেচ্ছা অবরুদ্ধ। এ সময় যারা নিম্ন আয়ের মানুষ তাদের রুটিরুজির পথও রুদ্ধ প্রায়। ইউরোপ, আমেরিকা নিজ দেশের সাধারণ মানুষের জন্য ব্যাপক খাদ্য ও আর্থিক সহায়তার প্যাকেজ ঘোষণা দিয়েছে। ভারত সরকারও নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য ব্যাপক সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও সে ঘোষণা দিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি উচ্চবিত্তদের গরিবদের পাশে দাঁড়াবার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে প্রত্যেক জেলার গরিব তথা নিম্ন আয়ের মানুষের খাদ্য ও নগদ সহায়তার ব্যবস্থার কথা বলেছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশের অধিকাংশ জেলা প্রশাসক গরিবদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ, খাদ্য কতটা বিতরণ করবেন তাতে সন্দেহ রয়েছে। অতীতের অভিজ্ঞতা সেটাই বলে। বরং এ সহযোগিতা কার্যক্রম সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে হলে অনেকটাই সাফল্য আসবে বলে দেশবাসী মনে করে।
আজ গোটা বিশ্বে মানবজাতি এক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। পরম সৃষ্টিকর্তাই এ অবস্থায় দাঁড় করিয়েছেন, অধ্যাত্মবিজ্ঞান সে কথাই বলে। যুগে যুগে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। করোনা পরম করুণাময়েরই অন্য একটি সত্তা। তাই কোথাও অল্প প্রকাশ, কোথাও বেশি প্রকাশ, কোথাও অপ্রকাশ।
আমাদের ভাবতে হবে করোনাভাইরাস নামক জীবাণুটি ভয়ানকভাবে আকর্ষণ করে মানুষকে। জড় পদার্থে এর রাসায়নিক বিকিরণ ঘটে না। অস্তিত্বও বেশি সময় স্থায়ী থাকে না। মানুষের দেহে প্রবেশের ফলে যে বিকিরণ সৃষ্টি হয় তাতে অনেক প্রাণনাশ হয়। ভয়টা সেখানেই। যেহেতু এর প্রতিষেধক নেই, তাই দেহে প্রবেশ করলে ভীত না হয়ে সকলকে করুণাময়ের কাছে করুণা ভিক্ষা করতে হবে। করোনাভাইরাসে যিনি আক্রান্ত হন তাকে তার আত্মীয়স্বজন থেকে দূরে রাখতে হয়। মৃত্যুবরণ করলে তাকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ বিবেচনায় শেষকৃত্যেও স্বজনরা অংশ নিতে চায় না। কী নিষ্ঠুর নিয়তি! অথচ এতে কোন ঝুঁকি নেই। সাধারণ সর্দিজ¦র, মাথাব্যথা হলেই এখন করোনা ভেবে ডাক্তাররা চিকিৎসা থেকে বিরত থাকেন। বর্তমানে প্রত্যেকটি ডায়গনস্টিক সেন্টারে একজন ডাক্তারও বসেন না কি ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি! এ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের পথ এখন করুণাকাতর হয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করা। এ সময় ডাক্তারদেরও মানবিক হতে হবে অবশ্যই।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]