ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অজয় দাশগুপ্ত

সিডনির মেলব্যাগ ॥ হায় করোনা! বিশ্ব যখন শঙ্কা মগন গগন অন্ধকারে

প্রকাশিত: ০৮:৫৩, ৩১ মার্চ ২০২০

সিডনির মেলব্যাগ ॥ হায় করোনা! বিশ্ব যখন শঙ্কা মগন গগন অন্ধকারে

করোনা আক্রান্ত বিশ্বে আর কোন খবর এখন শিরোনাম হতে পারছে না। ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন থেকে স্পেনের প্রিন্সেস, যুবরাজ চার্লস কাউকে ছাড় দেয়নি করোনা। সারাবিশ্ব আজ আতঙ্ক আর ভয়ে। স্বভাবতই আমরা যারা প্রবাসী আমাদের মনে বাসা বেঁধেছে দুই দেশের জন্য চিন্তা। যে দেশে বসবাস সে দেশের জন্য তো বটেই, বাকি থাকল স্বদেশ। যেখানে আমরা শারীরিকভাবে না থাকলেও আমাদের মন বসত করে। থাকে আমাদের আত্মীয়স্বজনসহ বন্ধবান্ধব আর পরিচিতজনেরা। এ কি কাল এলো? এ কেমন বিপদ? আমাদের জাতিসত্তার একটা বড় বিষয় আবেগ। আমরা যে যেখানে থাকি না আমাদের তাড়া করে বেড়ায় এই আবেগ। আবেগসর্বস্ব বাঙালী আজ করোনা নিয়েও আছে সঙ্কটে। সঙ্কট শুধু রোগ রোগমুক্তি নিয়ে না, আবেগতাড়িত করছে বিবেককেও। অথচ আমাদের বিবেকের দুয়ারে তালা। কি আশ্চর্য এমন মহামারী নিয়েও ইচ্ছেমতো ফতোয়া আর বয়ান দিচ্ছেন অনেকে। তাদের কথা শুনলে দুনিয়ায় বিজ্ঞান বা মেধার দরকার পড়তো না। যেখানে আমেরিকা চীন রাশিয়া কানাডা যুক্তরাষ্ট্র অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলো ঘটনা সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে তারা বলছে মনগড়া কথা। দিচ্ছে টোটকার পরামর্শ। এই প্রাণঘাতী অসুখ শুধু মানুষ কেন, এর আঘাতে বিশ্ব ধ্বংস হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন বিশেষজ্ঞের দল। এটা ধরে নিতে পারেন এই দুনিয়া আর আগের মতো থাকবে না। কেন থাকবে না? ইউরোপকে ইউনিয়ন দিয়ে যুক্ত করলেও মূলত পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপের ব্যবধান যায়নি। তূলনামূলকভাবে এগিয়ে থাকা ও নেতৃত্ব দেয়া পশ্চিম ইউরোপ এখন ঘোর বিপদে। বিলেত, জার্মানি, ইতালি-স্পেনসহ নানা দেশের জনসংখ্যা উজাড় হওয়ার পথে। বিশ্ব মোড়ল নামে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা খুবই খারাপ। ডোনাল্ড ট্রাম্প মরিয়া হয়ে উঠেছেন দেশের লকডাউন তুলে দিতে। কারণ করোনায় না মরলে না খেয়ে বিনা চিকিৎসায় মরার দিন আসছে। এদিকে অস্ট্রেলিয়ার সরকারও কিছুতেই ব্যবসা বন্ধ করতে রাজি হয়নি। সরকার প্রধান লকডাউন শব্দটি নিয়েও উষ্মা প্রকাশ করেছে। এ সবই ভয় থেকে। দেশের পর দেশ বন্ধ হয়ে গেলে দুনিয়া অচল হয়ে যাবে। বলছিলাম দুনিয়া বদলে যাবে। সে দৃষ্টিকোণে মনে করব পূর্ব ইউরোপ হয়ত চলে আসবে সামনে। কারণ আমরা এখনও বুলগেরিয়া রোমানিয়া পোল্যান্ড বা চেক দেশের কথা শুনিনি। রাশিয়াও তেমন কিছু বলেনি। কমিউনিস্ট চীন ব্যতীত কিউবাসহ অন্যরা কতটা বিপদে বা আক্রান্ত জানা যায়নি। বরং তারা এগিয়ে এসে সাহায্য করছে। তার মানে কি এই যে এরপর এরাই আসবে বিশ্ব নেতৃত্বে? এরপর আসি প্রতিরোধের কথায়। ভারতের মতো জনবহুল দেশ এমন বড় অর্থনীতির সমাজ একুশ দিনের লকডাউনে। এর মানে কি? এই লোকসান এই বিপুল ধাক্কা কি সহজ সামলানো? বাংলাদেশের অর্থনীতিও এখন প্রায় অচল। কিন্তু কি করতে পারে সরকারগুলো? কি তাদের কাছে বিকল্প? এটা না মানলে আপনি বক বক করতে পারেন কিন্তু সমাধান মিলবে না। আমরা সিডনিতে ভয়ে আছি বটে, তবু জীবন থেমে নেই। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী বরিস মরিসন ২৯-০৩ সকাল বেলা পর্যন্ত সবকিছু বন্ধ করে ঝুঁকি নিতে নারাজ। তাঁকে কঠিন বা হৃদয়হীন বলা যাবে, কিন্তু কি এর বিকল্প? যতদিন বা যত সময় চলে তত সময় পর্যন্ত চালু রাখার কৌশলে জান গেলেও মানুষ যেন ভাতে না মরে। এ জন্যই তিনি বা সরকার কঠোর এবং এটা নিশ্চিত আগামীবার সব ঠিক থাকলে বা মানুষ বেঁচে থাকলে তাঁর দলের জন্য জয় শুধু কঠিন না, পরাজয় নিশ্চিতও হতে পারে। তাতে কি আসে যায় এখন? এসব দেশে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব সরকারের। উচ্চ আয়কর আর নানাভাবে খাজনা দেয়া ফাইন দেয়া বিল দেয়া মানুষ দুর্যোগের সময় সাহায্য না পেলে বাঁচবেই না। পুঁজিবাদী সমাজে মানুষ স্বার্থপর। তাকে তা হতেই হয়। আমাদের দেশের মতো না। সেখানে যেভাবে অল্পে তুষ্ট আর মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়ায় বা দাঁড়াতে পারে, সেটা এখানে অসম্ভব বলে সরকার বা রাষ্ট্রকেই দায়িত্ব নিতে হয়। বাংলাদেশের কথা বললে একটা কথাই বলব, অন্ধত্ব বা সংস্কারের সময় এটা নয়। মনে রাখা দরকার এই রোগ একজনের হলে আরেকজনও নিরাপদ নয়। এর সংক্রমণ বড় মারাত্মক। বড় প্রাণঘাতী। সে দিকে দৃষ্টি না রেখে মনগড়া কিছু কথা আর সরকার বিরোধিতায় কিছু হবে না। আমরা তো বলব বাংলাদেশ সরকার জনসংখ্যা ও ঘনত্বের বিবেচনায় সঠিক কাজ করেছে। সঙ্গে এটাও বলি জনগণকে স্যালুট। তারা বুঝতে পেরেছেন এটা কতটা মারাত্মক। কথায় কথায় মানুষকে মন্দ বলা বা দোষারোপ করার আগে সরকার বা রাষ্ট্রকে সমালোচনা করার পূর্বে দুনিয়ার দিকে তাকান। এক শ’ ভাগ লেখাপড়া জানা মানুষের দেশ অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে বন্ডাই বিচ নামে খ্যাত বিশ্বের পর্যটন আকর্ষণ সৈকতটি কেন বন্ধ হয়েছে জানেন? সামাজিক দূরত্ব ঘোষণার পর সেখানে হল্লা করতে স্নান করতে আর মেলামেশা করতে গিয়েছিল হাজারও মানুষ, যা সারাবিশ্বকে চমকে দিয়েছে। আমাদেরও করেছে লজ্জিত। এরপর কড়া জরিমানা আর আর কড়া ঘোষণা দিয়ে বন্ধ করা হয়েছে। আরও শুনুন এই গতকালও মেলবোর্নের সেন্ট কিলডা সৈকতে একই ঘটনার কারণে বন্ধ করা হয়েছে সেটি। এরপর আসুন আফ্রিকার কথায়। বুরুন্ডি নামে একটি দেশ আছে। যার সরকার প্রধান কি বলেছে জানেন? তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল সারাবিশ্ব যেখানে আক্রান্ত সেখানে তার দেশ কিভাবে শূন্য বলছে? তার সাফ জবাব আমাদের পরীক্ষা করার কোন যন্ত্র নেই, তাই কোন করোনা কেসও নেই। সে দিক থেকে আমরা বাংলাদেশের সরকার ও মানুষকে স্যালুট জানাই। স্যালুট জানাই সামাজিক মিডিয়াকে, যারা সব সময় অতন্দ্র প্রহরী। বলব এরাই বাঁচিয়ে রেখেছে আশা। করোনা চিরকাল থাকবে না। শুধু সাময়িক সচেতনতা আর নিয়ন্ত্রণই পারবে আমাদের বাঁচাতে। কারও জন্য সহানুভূতির সময় এটা নয়। যারা বিদেশ থেকে এসেছেন বা আসছেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে। কঠোরতা চাই আইনের। চাই মন্ত্রীদের দায়িত্বশীলতা। কেউ জানে না কি হতে পারে? করোনা চলে যাবার পর এখনকার শক্তিশালীরা হয়তো পারবে না দুনিয়া শাসন করতে। তখন যদি এখন পিছিয়ে পড়া সাম্যবাদীরা নেতৃত্ব দেয়, কি চেহারা নেবে দুনিয়া? কেউ জানে না সর্বমোট কত মানুষ প্রাণ হারাবেন? সবাইকে আপনজন বিয়োগের জন্য তৈরি থাকতে বলা বরিস মরিসন নিজেই আছেন বিপদে। দুনিয়াজুড়ে আজ বিপন্নতার পাশাপাশি সহযোগিতারও একটা নতুন বাতাবরণ তৈরি করেছে করোনা। এ কাজ অব্যহত রাখতে হবে আগামী বছরগুলোতে। করোনা কতটা ক্ষতি করবে, তার ওপর নির্ভর করবে বিশ্বের ভবিষ্যত। [email protected]
×