ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ত্রাণ তহবিলে অনুদান গ্রহণকালে প্রধানমন্ত্রী

প্রতিটি মানুষকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে

প্রকাশিত: ১০:২৬, ৩০ মার্চ ২০২০

 প্রতিটি মানুষকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সতর্ক থাকার পাশাপাশি ধৈর্যের সঙ্গে এ সঙ্কট মোকাবেলার জন্য দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, এই সঙ্কটে সবকিছু নিয়ে সরকার জনগণের পাশে আছে। আমরা বিজয়ী জাতি, কাউকে ঘাবড়ানো চলবে না। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় সকলকে প্রস্তুত থাকতে হবে। আমাদের এমনভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে যেন দেশের প্রতিটি জনগণকে সুরক্ষিত রাখতে পারি। বাঙালী কখনও হারেনি। আমরা হারব না। এই আত্মবিশ্বাস সবাইকে নিয়ে চলতে হবে। শুধু নিজেকে একটু সুরক্ষিত রাখতে হবে, আর অপরকেও সুরক্ষিত রাখতে হবে। রবিবার গণভবনে থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে করোনা সঙ্কট মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রীর কল্যাণ ও ত্রাণ তহবিলে অনুদানের চেক ও ২০ হাজার পিস পিপিই মেডিক্যাল সামগ্রী প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এমন আহ্বান জানান। অনুষ্ঠানে সশস্ত্রবাহিনীসহ সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একদিনের সমপরিমাণ বেতনের অর্থ প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেয়া হয়। এ সময় দেশের খ্যাতনামা কয়েকটি ব্যবসায়ী গ্রুপের পক্ষ থেকেও প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে করোনা সঙ্কট মোকাবেলায় অর্থ সহায়তা দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এ অনুষ্ঠানে অংশ নেন। আর সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তাঁর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউসের কাছে অনুদানের চেক হস্তান্তর করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে ধৈর্যের সঙ্গে এই সঙ্কট মোকাবেলা করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশের কাছ থেকে করোনা সঙ্কট মোকাবেলায় সহযোগিতা চায়। আমরা সেটা করব। অতীতের বিভিন্ন মহামারীর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, শত বছর পর পর এমন একটা মহামারী পৃথিবীতে আসে। অতীতে যেহেতু প্রযুক্তির ব্যবহার এত ছিল না, কাজেই কোন দেশে, কোন অঞ্চলে, কোথায় কি ধরনের ঘটনা ঘটেছে তা জানার সুযোগ ছিল না। বর্তমানে বিশ্বটা গ্লোবাল ভিলেজ হয়ে গেছে, কোথাও একটা ঘটনা ঘটলে আমরা গণমাধ্যমের কারণে সব ঘটনাই জানতে পারি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, চীনের উহানে যখনই এই ঘটনা ঘটেছিল তখনই আমরা সেখান থেকে আমাদের শিক্ষার্থীদেরও ফিরিয়ে এনেছি। তাদের কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছিল। আমরা শুধু তাদের কোয়ারেন্টাইনে রেখেই ক্ষান্ত হয়নি, সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র বাংলাদেশের মানুষকে সচেতন করা। এটা প্রতিরোধে কি কি ব্যবস্থা নেয়া যায়, তা একটার পরে একটা নিয়ে নিয়েছি। বিশেষ করে আমরা দেশের মানুষকে সচেতন রাখতে চেষ্টা করছি। পাশাপাশি আমাদের উৎপাদন যাতে ব্যাহত না হয়। মানুষ যাতে আর্থিকভাবে কষ্টে না পড়ে সেই দিকটাও সচেতন থেকেছি। প্রতিটি পদক্ষেপ অন্তত পরিকল্পিতভাবে যখন যেটা প্রয়োজন হয়েছে সেটাই নিয়েছি। বলতে গেলে জানুয়ারি মাস থেকেই আমাদের পদক্ষেপগুলো চলছে। এ প্রসঙ্গে সরকারপ্রধান আরও বলেন, একটা পর্যায় যখন আসল তখন আমরা সবাইকে ছুটি দিয়েছি। কিন্তু ছুটি মানে এই না সবাই কাজ ছেড়ে ঘরে বসে থাকবে। যার কাজ করতে পারবে, ঘরে বসেই কাজ করবে। কিন্তু মানুষের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। কারণ এটা মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়। তিনি বলেন, সারা বাংলাদেশে কিছু বিদেশীরা চলে আসছিল, যার ফলে প্রবাসীরা আসার ফলে এই ধরনের লক্ষণ দেখা দিল। কোন কোন জায়গায় দেখা দিল তা আমরা সঙ্গে সঙ্গে খোঁজ নিয়েছি। এর বিস্তার ঠেকাতে আমরা সঙ্গে সঙ্গে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হয়েছি এবং সেটা অব্যাহত রাখছি। তাই সকলকে বলব- ঘর থেকে বের হয়ে ঘুরে বেড়াবেন, এটা তো হয় না। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে বিভিন্ন সরকারী সংস্থা ও বেসরকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের দেয়া অনুদান সরাসরি গ্রহণ করতে না পারায় প্রধানমন্ত্রী দুঃখপ্রকাশ করেন। বলেন, ‘আমি ভিডিও কনফারেন্সে আছি, আমার পক্ষ থেকে প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি তা গ্রহণ করছেন। এটা আমার কাছে খারাপও লাগছে কারণ আপনাদের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা করতে পারলাম না। কারণ এটার আরেকটা কারণ হচ্ছে আমি নিজেই যদি না মানি তাহলে অপরকে মানতে বলব কিভাবে? যেহেতু সবাইকে বলছি দূরত্ব বজায় রাখতে, ঘরে থাকতে। তিনি বলেন, আমরা এই সময়টাও পার করতে পারব। আমাদের শিল্প কারখানার মালিক-শ্রমিকরা বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যেখানে চালাতে পারবে, সেখানে সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। অর্থাৎ যারা কাজ করবে তাদের সুরক্ষিত রেখেই চালাতে হবে। আল্লাহর কাছে দোয়া কামনা করতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সকলের কাছে আহ্বান আপনারা মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। সৃষ্টিকর্তাই পারেন। কারণ আমরা দেখি যে শতবছর পরে এই ধরনের মহামারী আসে কেন? কাজেই একমাত্র নিজেরা সুরক্ষিত থাকা, আশপাশে যারা আছেন তাদের সুরক্ষিত রাখা। সেই সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ক্ষতি যত কম হয়, ক্ষতি যেন একেবারেই না হয়- সেটার জন্য ব্যবস্থা নেয়া। তা আমাদের নিতে হবে। শেখ হাসিনা বলেন, কষ্টে থাকে খেটে খাওয়া মানুষ, দিনমজুর, সাধারণ নিম্নবিত্ত। অনেকই আছেন যারা তাদের ব্যবস্থা এমন না যে তারা অনেক কিছু জমিয়ে রাখতে পারবেন, দিনের পর দিন চলতে পারবেন। কর্মসংস্থান থাকার ফলে তারা খেয়ে পরে চলতে পারলেও কিন্তু বর্তমানে এই অবস্থা চলার ফলে তারা সত্যিই খুব কষ্টে আছেন। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে খাদ্যশস্য আমরা জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি। তা পর্যায়ক্রমে দেয়া হবে। পাশাপাশি ভিজিএফসহ যে সকল আর্থিক সহায়তা আমরা দিয়ে থাকি তা অব্যাহত থাকবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সড়ক ও নৌপরিবহন যেহেতু বন্ধ, তাই তাদের শ্রমিকরা কাজ পাচ্ছে না। তারা ঘরে বসা। খাবার কিনে মজুদ করার মতো অবস্থা তাদের নেই। এই শ্রেণীর মানুষের কথাও আমাদের চিন্তা করতে হবে। তাদের তালিকা করে, আমাদের খাদ্যশস্য যা যা প্রয়োজন তা পৌঁছে দিতে হবে। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য ডাক্তার ও নার্সদেরও সুরক্ষিত করা দরকার। সেই বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। এরই মধ্যে আমরা সরকারীভাবে কাজ করছি। আবার কিছু বেসরকারী প্রতিষ্ঠানও সহযোগিতা করছেন, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিচ্ছেন। হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট সকলকেও প্রয়োজনীয় সুরক্ষার পোশাক দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দিনমজুর, খেটে খাওয়া মানুষদের কাছে খাদ্য পৌঁছে দেয়া একান্তভাবে জরুরী। প্রতিটি জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত খাদ্য সামগ্রী হতে শুরু করে যা যা প্রয়োজন তা পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা আমরা নিচ্ছি। আমাদের তালিকা তৈরি করা আছে, আরও তালিকা করা দরকার। কারণ মানুষকে ঘরে আটকে রাখলেই হবে না, তাদের খাদ্য ও জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা আমাদের করে দিতে হবে। সরকারী যে সকল প্রতিষ্ঠান তাদের একদিনের বেতন প্রদান ও বিত্তবানদের এগিয়ে আসার জন্য ধন্যবাদ দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমরা বিজয়ী জাতি, যে কোন দুর্যোগ মোকাবেলা করার মতো সাহস ও শক্তি আমাদের আছে, আমি বিশ্বাস করি। এই অবস্থা মোকাবেলা করার জন্য সকলকে প্রস্তুত হতে হবে। যাতে করে দেশের প্রতিটি জনগণকে আমরা সুরক্ষিত করতে পারি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেক দেশ আমাদের কাছে সহযোগিতা চাচ্ছেন। আমরা সেই সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। আমাদের কৃষকদের ফসল ফলাতে হবে। পাশাপাশি অনেকই গ্রামে চলে গেছে, তাদের যার যেখানে যতটুকু জমি আছে, এতটুকু জমিও যাতে অনাবাদি না থাকে। যে যা পারেন ফসল ফলাবেন। কারণ বিশ্বব্যাপী যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে ব্যাপকভাবে খাদ্যেও অভাব দেখা দিতে পারে। আমাদের সুবিধা হলো বাংলাদেশের মাটি উর্বর, মানুষ কর্মঠ। মাটি ও মানুষ মিলে যদি পরিশ্রম করতে পারি তাহলে আমরা নিজেদের খাদ্যেও পাশাপাশি অন্যকেও আমরা সহযোগিতা করতে পারব। শেখ হাসিনা আরও বলেন, ওষুধ কোম্পানিগুলো আমরা খোলা রাখার ব্যবস্থা করেছি। যাতে ওষুধ উৎপাদনটা থাকে। পাশাপাশি পিপিই যা দরকার তা উৎপাদন শুরু হয়েছে। আরও উৎপাদন করা দরকার। আমাদের কাছ থেকে যারা সহযোগিতা চেয়েছে তাদেরও সহযোগিতা করতে পারব। তার সক্ষমতা আমাদের আছে। মানবিক কারণেই আমরা করব। কারণ দুঃসময়ে আমরা সবার পাশে দাঁড়ায়। নিজেদের পাশাপাশি অন্য দেশেরও যদি প্রয়োজন হয়, আমরা সেইদিকে দৃষ্টি দিব। বাঙালী কখনও হারেনি। আমরা হারব না। এই আত্মবিশ্বাস সবাইকে নিয়ে চলতে হবে। শুধু নিজেকে একটু সুরক্ষিত রাখতে হবে। আর অপরকেও সুরক্ষিত রাখতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ২৫ কোটি টাকা, নৌবাহিনী ৪ কোটি ৫০ লাখ ৪৭ হাজার টাকা, বিমানবাহিনী ১ কোটি ২০ লাখ টাকা, বসুন্ধরা গ্রুপ ১০ কোটি টাকা, বাংলাদেশ এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এ্যাসোসিয়েশন ১ কোটি টাকা, বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী ১ কোটি টাকা অনুদান দেয়। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ, নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল নিজামউদ্দিন আহমেদ ও বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চীফ মার্শাল মাসিহুজ্জামান সেরনিয়াবাত, বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল সাফিনুল ইসলাম, বাংলাদেশ এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ, মহাসচিব জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসুফ হারুন, বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল কাজী শরীফ কায়কোবাদ নিজ নিজ বাহিনীর পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলে অনুদানের চেক হস্তান্তর করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে তাঁর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস অনুদানের চেক গ্রহণ করেন। গণভবন প্রান্তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মোঃ তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও ওরিয়ন গ্রুপ কোটি টাকা, নাভানা গ্রুপ ২৫ লাখ টাকা, হোসাফ গ্রুপ ৫ কোটি টাকা, আবুল খায়ের গ্রুপ ৫০ লাখ টাকা, সামিট পাওয়ার লিমিটেড ৩ কোটি টাকা, কনফিডেন্স পাওয়ার কোম্পানি ৩ কোটি টাকা, দ্য ওয়েস্টিন হোটেল ২ কোটি, লা মেরিডিয়ান ২ কোটি টাকা অনুদান প্রদান করে। সিএমসি-চায়না ১ মিলিয়ন মাস্ক, ১০ হাজার পিপিই এবং কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স ১০ হাজার পিপিই প্রদান করে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে।
×