ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শহর-নগর স্থবির, সুনসান নীরবতা

সারাদেশে ভয় হতাশা স্বেচ্ছা ঘরবন্দী, থেমে গেছে জীবন

প্রকাশিত: ০৯:৪৯, ২৮ মার্চ ২০২০

সারাদেশে ভয় হতাশা স্বেচ্ছা ঘরবন্দী, থেমে  গেছে জীবন

জনকণ্ঠ ফিচার ॥ করোনা আতঙ্কের বিষয়টি যদি ভাবনায় আনেন, তবে আপনি বলতেই পারেন যে- দেশের পরিস্থিতি এখন খুব একটা ভাল নেই। কারণ, সারাদেশে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে এখন শুধু কী হয়, কী হবে- এই ভয় আর হতাশা বিরাজমান। অবশ্য এ দুরবস্থা আমাদের একা দেশেই নয়, এশিয়া-ইউরোপ-আমেরিকা-আফ্রিকাসহ গোটা বিশ্বকেই নাড়া দিয়েছে ইতোমধ্যে। বিশ্বের মানুষ এখন করোনাভাইরাস নামক এক ভয়ঙ্কর দানবের কাছে অসহায়। প্রায় বিনা যুদ্ধেই মানুষ আত্মসমর্পণ করছে এই দানবের কাছে। ফলে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে শ’য়ে শ’য়ে মানুষ। বিশ্বের এমন কোন দেশ নেই, যেখানে হানা দেয়নি এই প্রাণ হন্তারক, মরণব্যাধি। এর ফলে শুধু রাজধানী নয়, ঢাকার বাইরেও বিরাজ করছে অস্বাভাবিক ভীতিকর পরিস্থিতি। মানুষ জীবনের টানে নিজেকে রক্ষার জন্য স্বেচ্ছায় ঘরবন্দী করে রেখেছেন, যাকে ডাক্তারি ভাষায় বলা হচ্ছে হোম কোয়ারেন্টাইন অথবা সেল্ফ আইসোলেশন। এ কারণে সরকার বাধ্য হয়ে অফিস আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান- সর্বত্র ছুটি ঘোষণা করেছে। তাই মানুষ ঘর থেকে বের না হওয়ায় শহর নগর বন্দরে নেই প্রতিদিনের হল্লা। এখন আছে শুধু সুনসান নীরবতা। সব কিছুতেই যেন লকডাউন। বাগেরহাট থেকে বাবুল সরদার জানান, করোনা আতঙ্কে পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে, বাগেরহাট শহরে এখন যেন দীর্ঘশ্বাসও নেই, নেই কান্নার শব্দ, হাপিত্যেশ- কিছুই নেই! আছে বেঁচে থাকার, ভাল থাকার নিদারুণ উৎকণ্ঠা। আর সেই অদম্য ইচ্ছায় প্রায় সবাই ঘরবন্দী জীবন-যাপন করছেন। অতিচঞ্চল শিশুটিও আর মাঠে খেলতে যেতে চাইছে না। ডায়াবেটিক রোগী বা’ স্বাস্থ্যসচেতন মানুষটিও ঘরের মধ্যে হাঁটাহাঁটি সারছেন। হাট-বাজার, রাস্তাÑঘাট সবই প্রায় ফাঁকা। ভর দুপুর কিংবা সন্ধ্যা সবই এক। সুনসান। দৃশ্যত এ যেন অভূতপূর্ব এক জীবন-যাপন। আসলে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বাগেরহাটজুড়ে ঘরে থাকছে নারী-শিশু, যুবা-বৃদ্ধ, ধনী-দরিদ্র সকলেই। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ঘরে থাকার নির্দেশের পর বৃহস্পতিবার বাগেরহাটের প্রায় সর্বত্র একই দৃশ্য চোখে পড়েছে। জেলা শহর থেকে শুরু করে উপজেলা সদর এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামের বিভিন্ন হাট-বাজার সবই প্রায় জনশূন্য। ছোট ছোট চায়ের দোকানও বন্ধ। মানুষ ঘরে। রাস্তায় যানবাহন নেই বললেই চলে। কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর টহল গাড়ি মাঝে মধ্যে চোখে পড়েছে। ওষুধের দোকান আর কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দোকান ছাড়া সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ। প্রতিদিনের জমে ওঠা বিভিন্ন মোড়ের আড্ডা নেই। রাস্তাঘাট ফাঁকা তবে ‘অতিপ্রয়োজনে’ নামা কিছু মানুষকে রাস্তায় দেখা গেছে। তাদেরও মুখে মাস্ক, হাতে হ্যান্ড গ্লাভস। জেলা প্রশাসন ও পৌরসভার পক্ষ থেকে মাইকিং করে বাসিন্দাদের সচেতন করছে। তারা সবাইকে ঘরে থাকা এবং যারা সম্প্রতি বিদেশ থেকে দেশে এসেছেন তাদের ১৪ দিনের জন্য সঙ্গ নিরোধে ‘হোম কোয়ারেন্টাইনে’ থাকতে অনুরোধ করেছেন। জেলা প্রশাসনের প্রচারণায় বলা হচ্ছে, যার যার ঘরে থাকুন, করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করুন। অন্যথায় আইনী পদক্ষেপ নেয়া হবে। জেলা প্রশাসক মামুনুর রশীদ ও সিভিল সার্জন ডাঃ কে এম হুমায়ুন কবির জানান, বাগেরহাট জেলায় ৩৮ দেশ থেকে ফেরত ৪ হাজার ২শ’ প্রবাসী অবস্থান করছেন। এর মধ্যে সম্প্রতি আসা ১১শ’ ৪৪ প্রবাসী হোম কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন। সামাজিক মেলামেশার ক্ষেত্রে এই সময়ে দূরত্ব রক্ষায় তাদের বাড়ি বাড়ি লাল পতাকা’ ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। আর হোম কোয়ারেন্টাইনের নির্ধারিত সময় পূর্ণ হওয়ায় ৪শ’ ৪৫ জন স্বাভাবিক জীবন-যাপন করছেন। রিক্সাচালক শহিদুল ইসলাম সানু বলেন, প্রতিদিন রিক্সা চালিয়ে যে টাকা পাই তা দিয়ে তিনজনের সংসার চলে। রাস্তায় কোন লোক নেই, ভাড়াও নেই, তাই ঘরে বসে আছি। তবে আয় করতে না পারলে সংসার চালাতে কষ্ট হবে উল্লেখ তিনি আরও বলেন, “তবুও ঘরে থাকলে যদি ‘করুণাভাইরাস’ (করোনাভাইরাস) এর হাত থেকে রক্ষা পাই, তাই কয়দিন ঘরেই থাকব।” বাগেরহাট সদর আসনের সংসদ সদস্য শেখ সারহান নাসের তন্ময় বলেন, মহাবিপর্যয় থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কিছুটা কষ্ট হলেও আমাদের সকলকে স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী সরকারী নির্দেশনা মেনে চলা উচিত। তিনি করোনাভাইরাস প্রতিরোধে আতঙ্কিত না হয়ে সকলকে সচেতন থাকার আহ্বান জানান। অতিপ্রয়োজন না হলে ঘরের বাইরে না যেতে সকলের প্রতি অনুরোধ করেন। বগুড়া থেকে সমুদ্র হক জানান, এখানে এখন আক্ষরিক অর্থেই লকডাউন চলছে। সেনাবহিনী ও পুলিশ শহর-নগরে টহল দিচ্ছে। সাধারণ মানুষ করোনাভাইরাস নিরাপত্তায় স্বেচ্ছায় নিজ ঘরে অবস্থান করছেন। অতি জরুরী প্রয়োজনে যারা ঘর থেকে বের হচ্ছেন তারা মাস্ক পরে কাজ সেরেই আবার ফিরে যাচ্ছেন। পথে কোন যানবাহন না থাকায় হেঁটেই যাচ্ছেন তারা। একজন থেকে আরেকজনের চলাচলে নিরাপদ দূরত্বে থাকছে। বগুড়া শহরের কেন্দ্রস্থল সাতমাথা একেবারে সুনসান। মাঝে মধ্যে সাইকেলে চেপে দু’একজনকে দেখা যাচ্ছে। রিক্সায় যাত্রী থাকলেও পুলিশকে কৈফিয়ত দিচ্ছে। জরুরী কাজের যাত্রী হলে তাকে ছেড়ে দিয়ে কাজ সেরে দ্রুত বাড়ি ফেরার অনুরোধ জানানো হচ্ছে। সেনাবাহিনীর টহলে করোনা সচেতনতার প্রচার চালানো হচ্ছে। পাড়া-মহল্লায় সীমিত পরিসরে কিছু দোকান খোলা আছে। তাও দুপুরের পর বন্ধ হয়ে যায়। শহরের ফতেহ আলী বাজারে সকালের দিকে হাতে গোনা কয়েকটি মাছ ও তরিতরকারির দোকান খোলা ছিল। দুুপুরের পর বন্ধ হয়ে যায়। দোকানি ওসমান জানালেন, গ্রামে থেকে কেউ কোন পণ্য নিয়ে শহরে আসছে না। জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, যাদের সিজনাল সর্দি-কাশি আছে তাদের টেলিমেডিসিন (ফোনে স্বাস্থ্যসেবা) চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। বগুড়া মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক নুরুজ্জামান জানালেন, নিজে নিজে ডাক্তারী না করে টেলিমেডিসিনে পরামর্শ নেয়া উচিত। এদিকে শহরের কয়েকটি ওষুধের দোকানে খোঁজখবর করে জানা গেল, কিছু অসাধু দোকানি বেশি দামে প্যারাসিটামল বিক্রি করছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে রিয়াজুদ্দিন জামি জানান, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে টহল দিচ্ছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। বৃহস্পতিবার সকালে সেনাবাহিনী শহরের টি.এ রোড, হাসপাতাল রোডসহ বিভিন্ন এলাকায় টহল দেয়। এছাড়াও জেলা প্রশাসনের বেশ কয়েকটি ভ্রাম্যমাণ আদালত শহরজুড়ে সরকারী নির্দেশনা বাস্তবায়নে কাজ করছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গত ২৪ ঘণ্টায় ১২৫ প্রবাসীকে হোম কোয়ারেন্টাইনে নেয়া হয়েছে। এ নিয়ে ৮৯০ জনকে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে বলে স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে। এদিকে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার পক্ষ থেকে ১২ ওয়ার্ড ছাড়াও বিভিন্ন যানবাহনে জীবাণুনাশক ছিটানো হয়েছে। এই কার্যক্রম উদ্বোধন করেন পৌর মেয়র নায়ার কবির। এছাড়া জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে হতদরিদ্রদের মাঝে সরকারী সহায়তা হিসেবে ২০ কেজি চালসহ নগদ টাকা ডাল, তেল ও বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে শহরের ফারুকী পার্কে ২৫ জন হতদরিদ্রের মাঝে জেলা প্রশাসক হায়ৎ উদ্ দৌলা খান এসব সামগ্রী বিতরণ করেন। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব প্রতিরোধে সাধারণ মানুষ জরুরী প্রয়োজন ছাড়া বের হচ্ছে না। এতে আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ছিন্নমূল এসব মানুষকে সহায়তা করার জন্য এসব ত্রাণ-সামগ্রী দেয়া হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত এ সহায়তা চালু থাকবে বলে জেলা প্রশাসক জানান।
×