ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিবি হাফসা

ভয়াল রাতের স্মৃতিচারণ ও অনুপ্রেরণা

প্রকাশিত: ০৭:৩৫, ২৮ মার্চ ২০২০

 ভয়াল রাতের স্মৃতিচারণ ও অনুপ্রেরণা

২৫ মার্চ রাত ১৯৭১ সাল। পাকবাহিনী কর্তৃক বাঙালী জাতির নিধনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, যা বদলে দিয়েছে বাংলার জাতীয় সত্তাকে, গড়ে উঠেছে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র। ২৫ মার্চের ভয়াল রাত, আনুমানিক রাত বারোটার দিকে, প্রথম পাকবাহিনী ফার্মগেটের মুক্তিবাহিনী কর্তৃক বাধার সম্মুখীন হয়। পাকবাহিনী বিভিন্ন কৌশলে ২৫ মার্চের পূর্বে সকল বাঙালীকে নিরস্ত্র করে ফেলে। ফলে তারা মনে করেছিল খুব সহজে বাঙালী জাতিকে দমন করতে পারবে কিন্তু তারা বুঝে উঠতে পারেনি, বাঙালী জাতি ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অমর বাণী- তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা কর, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল- অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। এই জাতিকে তথাকথিত অস্ত্র থেকে নিরস্ত্র করলেও মনের অস্ত্রকে নিরস্ত্র করতে পারেনি। তাইতো বঙ্গবন্ধুর সেই অমর বাণীকে মনে প্রাণে পালন করেছে বাঙালী জাতি। প্রতিটি বাঙালী (রাজাকার, আলবদর, আল-শামস, শান্তিবাহিনী ব্যতীত) ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলেছিল। বাঙালীরা তাদের যা কিছু ছিল– বাঁশ, গাছ, ঘরের খুঁটি, লাঠি, ইত্যাদি নিয়ে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল পাকবাহিনীর জন্য। সে রাতে পাকবাহিনী আক্রমণ করতে পারে আশঙ্কা করে বাঙালী মুক্তিবাহিনীরা ঢাকার রাস্তায় বিভিন্ন ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। পাক আর্মিরা সেই রাতে প্রথম ফার্মগেটে মুক্তিবাহিনী কর্তৃক ব্যারিকেডে বাধার সম্মুখীন হয়। সেখানে তারা সকল দোকানপাট, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। এরপর আক্রমণ করে নিউমার্কেট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে। সেরাতে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনীরা গণহত্যা, বধ্যভূমি ও গণকবর সৃষ্টি করেছিল। সে রাতে প্রথম গণহত্যা চালায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, রোকেয়া হল, কার্জন হল, রমনা কালীবাড়ি, পত্রিকা অফিস, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, জর্জ কোর্ট, সদরঘাট, শাখারিবাজার, কোতোয়ালি, তাঁতী বাজার, পিলখানা, ইকবাল হল (জহরুল হক হল), মতিঝিল জিন্দা বাজার, ঢাকা সেনানিবাস, ধানম-ি, মতিঝিল ইত্যাদি এলাকায়। সে রাতে পুরো ঢাকা শহরকে জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি মনে হয়েছিল। তারা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আগুন জ্বালিয়ে দেয়। সর্বপ্রথম গণকবর ঢাকার শহীদ মিনারের পেছনে প্রায় একশত ফুট লম্বা গর্ত। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে ছাত্রদের গণহত্যা চালানোর পর গণকবর দেয়। তাছাড়া, জগন্নাথ হলের পুকুরপাড় মাঠ, রমনা কালীমন্দির, সদরঘাট টার্মিনালে বহু লাশ খোলা আকাশের নিচে জমা করে রেখে দিয়েছিল ধলপুর ডিপোতে ফেলার জন্য। পঁচিশে মার্চ রাতে এই ধ্বংসযজ্ঞের মধ্য দিয়ে পাকবাহিনী ভারি ভারি আধুনিক অস্ত্র কামান নিয়ে যুদ্ধ শুরু করলেও নিরস্ত্র বাঙালীর কাছে পরাস্ত হয় ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে। যার ফলে আমরা অর্জন করি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশে দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের ফল। সুতরাং আজকের বাংলাদেশের পেছনে রয়েছে লাখ লাখ শহীদের রক্ত, লাখ লাখ মুক্তিযুদ্ধের আত্মত্যাগ, শত শত মা বোনদের নির্যাতিত হওয়ার ইতিহাস। আমরা যেন এই আত্মত্যাগ ভুলে না যাই, ভবিষ্যত প্রজন্ম যেন এই আত্মত্যাগ মনে রাখে এবং দেশের যে কোন স্বার্থ রক্ষায় মুক্তিযুদ্ধের মতো একসঙ্গে একাগ্রতার সঙ্গে কাজ করে। যার যা কিছু আছে তা নিয়েই। আমরা বঙ্গবন্ধুর অমর বাণীকে- তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করো - এগিয়ে যাচ্ছি, যেতে চাই। বাঙালী জাতির অনুপ্রেরণার উৎস সেই কণ্ঠ যা আমাদের সকল পরিস্থতি মোকাবেলার পথপ্রদর্শক। (তথ্যসূত্র : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র) লেখক : সহকারী অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
×