ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এনামুল হক

নতুন যুগের সম্ভাবনা আবর্জনার দিন শেষ

প্রকাশিত: ০৭:৩৪, ২৮ মার্চ ২০২০

 নতুন যুগের সম্ভাবনা আবর্জনার দিন শেষ

(গতকালে পর) খাদ্যের অপচয় কমাতে হবে ওয়েস্ট এ্যান্ড রিসোর্সেস এ্যাকশন প্রোগ্রাম (র‌্যাব) খাদ্যের অপচয় নিয়ে ২০০৮ সালে প্রথম বড় ধরনের এক সমীক্ষা চালায়। ফলাফল যা পাওয়া যায় তা রীতিমতো মর্মাহত হওযার মতো ব্যাপার। যাবতীয় সালাদের প্রায় অর্ধেক ও এক-চতুর্থাংশ ফলের শেষ ঠাঁই হয় ময়লা ফেলার বিনে। একই পরিণতি হয় বছরে ৪ লাখ টন আলুর। সবশুদ্ধ হিসাব করলে দেখা যায় যে ব্রিটেনরা প্রতি তিন ব্যাগ গ্রোসারির একটি ব্যাগ স্রেফ পরিত্যক্ত হিসেবে ফেলে দেয়। কোন কোন ব্যাপারে আস্ত মুরগিও পাওয়া গেছে। এটা শুধু ব্রিটেনের একক চিত্র নয়, মোটামুটি সারাবিশ্বে যাবতীয় খাদ্যের প্রায় এক- তৃতীয়াংশই নষ্ট বা অপচয় হয় যার বার্ষিক মূল্য প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলার। র‌্যাপের ওই সমীক্ষার আগে কেউ জানত না যে ব্রিটেনে কি পরিমাণ খাদ্য ও অর্থের অপচয় হচ্ছে। র‌্যাপ ‘লাভ ফুড হেইট ওয়েস্ট’ নামে একটি প্রচারাভিযান শুরু করে। এতে কাজ হয়। ২০১২ সালের মধ্যে ব্রিটেনে অপচয় হওয়ার খাবারের পরিমাণ এক-পঞ্চমাংশ কমে আসে। ইদানীং এক্ষেত্রে অগ্রগতি তেমন একটা হয়নি। তবে একটু সচেতন হলে এবং কমনসেন্স প্রয়োগ করলেই কিন্তু খাদ্যের অপচয় বন্ধ হতে পারে। মানুষ যখন একটা সমস্যা পরিমাপ করতে শুরু করে তখন তার সমাধান করার কাজেও নেমে যায়। যখন সে জানতে পারে যে তার ফেলে দেয়া খাবারটুকু দিয়ে আরেকজনের ক্ষুধা নিবৃত্ত হতে পারে, তখন সে অপচয় করা বন্ধ করবে। শুধু দরকার তার বিবেক সর্বক্ষণ সচেতন রাখা এবং তার জন্য প্রয়োজন নিয়মিত প্রচারাভিযান। খাদ্যের অপচয় ঠেকাতে যে কাজগুলো করতে হবে তা হচ্ছে এক. বেশি কেনাকাটা পরিহার করুন। ফ্রিজ ভর্তি খাবার থাকলে খাদ্যের অপচয় হতে পারে যদি সেই পরিবারটি সব খাবার খেতে না পারে। তাই একবারে ফ্রিজ ভর্তি খাবার না কিনে সপ্তাহে দু-একবার গিয়ে অল্প করে কিনুন। দ্বিতীয়ত, খাবার ফেলে দেয়ার আগে দুবার ভাবুন। সবজি ফল ইত্যাদি পুরনো বা একটু বাসি হলেই বা রং বিবর্ণ হলেই ফেলে দেবেন না। বাসি রুটি দিয়ে ও টোস্ট বা ব্রেড ক্রাম্বস বানানো যেতে পরে। তৃতীয়ত, কিনতে যাওয়ার আগে লিস্ট বানান। তাতে করে বাড়িতে ইতোমধ্যে আছে এমন খাবার অহেতুক কেনা পরিহার করা এবং এভাবে অপচয় রোধ করা যায়। ফল ও সবজির মতো পচনশীল দ্রব্যগুলো সংরক্ষণ করার সর্বোত্তম উপায়গুলো মেনে চললে অপচয় কম হবে। সপ্তাহের খাবারের মেন্যু আগে থেকে ঠিক করা থাকলে খাদ্যের ব্যবহার সুসংগঠিত করা ও অপচয় কমানো যায়। পাতের পুরো খাবার খেতে না পেরে যা পড়ে থাকল তা ফেলে না দিয়ে পরে খেয়ে নেয়ার জন্য ফ্রিজে সংরক্ষণ করতে হবে। এতে অপচয় হয় না। ফল বেশি দিন ভাল থাকে না। পচন ধরার লক্ষণ দেখা দেয়ার আগেই সেগুলো সস বা জুস বানিয়ে রাখা যেতে পারে। পোশাকের পুনর্ব্যবহার করতে হবে আমরা যে কাপড়চোপড় পরি বা ব্যবহার করি কিছুদিন পর পরিত্যক্ত হিসাবে ফেলে দেই। অথচ সেগুলোর ব্যবহার অব্যাহত রেখে অপচয় কমানো যায়। এতে বর্জ্য কম হয়। ২০০০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সময়ে বিশ্বের জনসংখ্যা বেড়েছে এক-পঞ্চমাংশ। কাপড়ের উৎপাদন হয়েছে দ্বিগুণ। সস্তায় কাপড় পেয়ে আমরা ঘন ঘন কিনি। অল্প দিন ব্যবহার করে আবার ফেলে দেই। ২০১৫ সালে সারা বিশ্বে ৪৫ হাজার কোটি ডলার মূল্যের কাপড় পরিত্যক্ত হিসেবে ফেলে দেয়া হয়েছে। নেদারল্যান্ডসে বোয়ের গ্রুপ নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে। এক শতাব্দী আগে পারিবারিক ব্যবসা হিসাবে এর যাত্রা শুরু হয়। তখন এর উদ্যোক্তারা একটা ঠেলাগাড়িতে করে পুরনো কাপড়চোপড়, ধাতব পদার্থ ও কাগজ সংগ্রহ করত। আজ এই প্রতিষ্ঠানটি নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, ফ্রান্স ও জার্মানিতে পাঁচটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান চালায়। একত্রে এগুলো দিনে ৪৬০ টন পর্যন্ত পরিত্যক্ত কাপড়চোপড় সংগ্রহ ও সর্টিং করে পুনর্ব্যবহার বা রিসাইক্লিংয়ের জন্য বিশ্বব্যাপী বিক্রি করে। রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে এ ধরনের কাপড় বেশি বিক্রি হয়। বেশি দাম মেলে মহিলাদের অন্তর্বাসে। প্রতি কিলো আড়াই ডলার। সবচেয়ে নিম্নমানের পোশাকগুলো চালানো হয় আফ্রিকায়। সেখানে ওগুলো থেকে কিলোপ্রতি ৫০ সেন্ট পাওয়া যায়। পরিত্যক্ত পোশাকের সিংহভাগই পাওয়া যায় জার্মানি থেকে। কোম্পানি সংগৃহীত পোশাকের ৬০ শতাংশ বিক্রি করতে পারে। বাকি ৪০ শতাংশ পোশাক যা কেউই কিনতে চায়না সেগুলো রিসাইকেল করা হয় কিংবা ওগুলো ইনস্যুলেশন বা ম্যাট্রেস তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়। কয়েক দশক ধরে বোয়ের কোম্পানি উলের সোয়েটার ও লিটিংয়ের পোশাক ইতালির প্রাটোতে চালান করছে। সেখানে মেশিনে সেই উল বা নিট থেকে সুতা বের করে আনা হচ্ছে এবং সেগুলো দিয়ে আবার নতুন পোশাক তৈরি হচ্ছে। সুতি কাপড় ও পলিয়েস্টারের পোশাক সেভাবে রিসাইকেল করা যায় না। অন্যভাবে করতে হয়। আগামী ১০ বছরের মধ্যে পোশাকের রিসাইক্লিং ব্যাপকভাবে হবে বলে মনে করা হচ্ছে। কিছু কিছু কোম্পানি আছে যেগুলো পোশাক ভাড়া দেয়। এগুলোর সংখ্যা বিশ্বের ফ্যাশন বাজারে ১ শতাংশের ১০ ভাগেরও কম। তবে সংখ্যাটা দ্রুত বাড়ছে। তত্ত্বগতভাবে পোশাক ভাড়ায় খাটানো অধিকতর টেকসই ব্যবস্থা। একই পোশাক যদি একাধিক লোক ব্যবহার করে তাহলে কাপড়ের সার্বিক সংখ্যা বা পরিমাণ কমে যাবে। তামা রিসাইক্লিং প্রতিষ্ঠানও বটে। ১৯১৬ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তুঙ্গে থাকাকালে যখন এটি নির্মিত হয় তখন জার্মান আর্টিলারির গোলার জন্য তামার সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। জার্মানরা তখন তামা বের করে নেয়ার জন্য গির্জার টাওয়ারগুলো থেকে ব্রোঞ্জের ঘণ্টা টেনে নামায়। ওই দিন থেকে কারখানাটি শুধুমাত্র রিসাইক্লিংয়ের কাজ করে আসছে। তামার সঙ্গে প্লাস্টিকের পার্থক্য হচ্ছে তামা একটা নিখাঁদ সার্কুলার পদার্থ। এটা অনির্দিষ্টকাল ধরে রিসাইকেল করা যায়। এতে এর গুণগত মান নষ্ট হয় না। লুনেন কারখানা এখনও বিপুল পরিমাণ তামা প্রক্রিয়াজাত করে চলছে। এগুলো বেশিরভাগই পাইপ ও ক্যাবল। তবে এমনও বর্জ্য এখানে রিসাইকেল করার কথা ভাবা হচ্ছে যেগুলোতে তামার মাত্রা অনেক কম। যেমন নষ্ট ক্যামেরা, ল্যাপটপ, সেলফোন ইত্যাদি। জাতিসংঘের ২০১৭ সালের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী যাবতীয় ইলেকট্রনিক বর্জ্যরে মাত্র এক-পঞ্চমাংশ রিসাইকেল করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের মতো অতি শিল্পায়িত দেশ কয়েক বিলিয়ন টন বর্জ্যরে ওপর বসে আসে। অরুবিস যুক্তরাষ্ট্র থেকে জাহাজে করে ইলেকট্রনিক বর্জ্যরে চালান নিয়ে আসে। এসব বর্জ্য থেকে এ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিক পুনরুদ্ধার করে। অরুবিস বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে। তবে আমেরিকায়ও অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে যেমন ধরুন এ্যাপল এখন খদ্দেরদের পুরনো আইফোন তাদের কাছে বিক্রি করতে উৎসাহিত করছে। টেক্সাসে একটি বুদ্ধিমান রোবট সেগুলো ভেঙ্গে নতুন ডিভাইস তৈরির উপাদান আহরণ করে। তবে মনে রাখতে হবে ব্যাপক বিসাইক্লিংয়ের মধ্য দিয়ে যা পাওয়া যাবে তারও একটা সীমা আছে। অরুবিসে পুনর্প্রক্রিয়াজাত তামা প্রতিষ্ঠানটির মোট উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশ মাত্র। বাকিটা আসে খনি থেকে। বিশ্বে তামার উৎপাদন গত ৫০ বছরে ৪ গুণ বেড়েছে এবং এখনও বাড়ছে। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যে প্রযুক্তি দরকার তাতে প্রচুর পরিমাণ তামার প্রয়োজন। একটিমাত্র উইন্ড টার্বাইন বানানোর জন্য ৩৩ টন তামার প্রয়োজন হয়। চাহিদা বাড়ছে। সেই বাড়তি চাহিদার শুধু রিসাইক্লিংয়ের দ্বারা পূরণ করা সম্ভব নয়। সুতরাং সার্কুলার অর্থনীতির জন্য অন্যান্য কৌশলও প্রয়োজন। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে উত্তরণ সার্কুলার অর্থনীতি গড়ে তোলার অপরিহার্য পদক্ষেপ। ইতোমধ্যে সৌরবিদ্যুত, বায়ুবিদ্যুত প্রভৃতি নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে, বিশ্বব্যাপী অনেক অগ্রগতি ঘটেছে। এগুলো ছাড়াও আছে জিও থার্মাল বিদ্যুত। আইসল্যান্ডের লাভা ক্ষেত্রের নিচে জমে থাকা ম্যাগমা থেকে সৃষ্ট তাপ কাজে লাগিয়ে বিদ্যুত উৎপাদিত হচ্ছে। হেলিসিও কেন্দ্রটি সে দেশের বৃহত্তম এবং বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম জিও থার্মাল কেন্দ্র যা থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতে ঘরবাড়ি আলোকিত হচ্ছে এবং সেগুলোকে উষ্ণ রাখার জন্য তাপও যোগাচ্ছে। প্লাস্টিক মানবজাতির শত্রু নয়। তবে সমুদ্র ও অন্যান্য স্থানে জমে ওঠা প্লাস্টিকের বর্জ্য বৈশ্বিক সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। প্লাস্টিক দামে সস্তা ও টেকসই বলে প্লাস্টিক সামগ্রীর উৎপাদন অনেক বেশি। তবে অধিকাংশ প্লাস্টিকের রাসায়নিক গঠনই এমন যে সেগুলো সহজে জীবাণু বিয়োজ্য (biodegradable) নয়। সে কারণে সেগুলো পরিবেশের ক্ষতির এক মস্ত কারণ। প্লাস্টিক স্থল, জলপথ ও সাগরের দূষণ ঘটায়। প্রতিবছর উপকূলী জনগোষ্ঠীর তরফ থেকে ৮৮ লাখ টন প্লাস্টিক সাগরে প্রবেশ করে। সামুদ্রিক প্রাণীরা প্লাস্টিক খেয়ে এবং প্লাস্টিকের রাসায়নিক উপাদানের সংস্পর্শে এসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানবদেহের ওপরও প্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। হরমোনের বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপ প্লাস্টিকের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০১৮ সালে সারা বিশ্বে প্রায় ৩৮ কোটি টন প্লাস্টিক উৎপাদিত হয়েছে। ১৯৫০-এর দশক থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে প্রায় ৬৩০ কোটি টন প্লাস্টিক উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে ৯ শতাংশ প্লাস্টিক রিসাইকেল করা হয়েছে এবং ১২ শতাংশ দহন করা হয়েছে। ফলে বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক পরিবেশে প্রবেশ করে মানুষসহ গোটা প্রাণী সমাজের ক্ষতি করছে। ৯০ শতাংশ সামুদ্রিক পাখির শরীরে প্লাস্টিকের বর্জ্য পাওয়া গেছে। প্রতি বছর গোটা বিশ্বে প্রায় ২৭ কোটি ৫০ লাখ প্লাস্টিকের বর্জ্য তৈরি হয় যার মধ্যে ৪৮ লাখ থেকে ১ কোটি ২৭ লাখ টন সাগরে গিয়ে জমে। প্লাস্টিকের দূষণ জলবায়ু পরিবর্তনেরও অন্যতম কারণ। এক রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৯ সালে প্লাস্টিকের উৎপাদন ও দহনের ফলে ৮৫ কোটি টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড বায়ুম-লে গিয়ে মিশেছে। এই ধারা চলতে থাকলে ২০৩০ সালে ওই সংখ্যাটা দাঁড়াবে ১৩৪ কোটি টন। সুতরাং প্লাস্টিকের বর্জ্য ও দূষণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে হবে। এটা শুধু যে পরিবেশের জন্য ভাল হবে তাই নয়, আপনার অর্থেরও সাশ্রয় হবে। কোন প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে হবে? সবার আগে আগে প্লাস্টিকের ব্যাগের কথা। পেপার বা প্লাস্টিকের ব্যাগের কথা ভুলে গিয়ে শপিংয়ের জন্য ব্যবহার করতে হবে টোট ব্যাগ বার বার ব্যবহার করা যায়। রেস্তরাঁ, কাফেতে অর্ডার দেয়ার সময় স্ট্র, প্লাস্টিকের কফি কাপ বর্জন করার চেষ্টা করতে হবে। পানি রাখার জন্য প্লাস্টিকের কন্টেনারের বদলে স্টিলের কন্টেনার, প্লাস্টিকের পানির বোতলের বদলে স্টেইনলেস স্টিলের পানির বোতলসহ যত ধরনের প্লাস্টিক সামগ্রী আছে অধিকাংশই বর্জন করতে বা ব্যবহার কমিয়ে দিতে হবে। বাড়ির পেছন দিকের খালি জায়গা থাকলে সেখানে খাবার বর্জ্য তরিতরকারির খোসা ইত্যাদি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিলে কম্পোস্ট সারে পরিণত হবে। এতে প্লাস্টিকের ব্যাগের আবর্জনা জমে উঠবে না। কৃষির ধারা বদলাতে হবে সার্কুলার অর্থনীতিতে কৃষির প্রচলিত ধারা চলবে না। একে বদলে দিতে হবে যেখানে কৃত্রিম সার, কীটনাশকের ব্যবহার হবে না। এ বাাপারে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করছে নিউজার্সির নিউইয়ার্কে এরোফার্মে পরিচালিত বিশ্বের সর্ববৃহৎ ইনডোর ভার্টিকাল ফার্ম। এর লক্ষ্য হচ্ছে নগরীগুলোর কেন্দ্রস্থলে সারা বছর সবজির উৎপাদন করা এবং তা লাভজনকভাবে করা। ফার্মে রিসাইকেল করা প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে তৈরি পুনর্ব্যবহার্য সাবস্ট্রেটে পাতাবহুল সবুজ সবজি ফলানো হচ্ছে। তল থেকে সবজি গাছের শিকড়গুলোতে বাষ্পের আকারে পানি লাগিয়ে দেয়া হয়। এতে বাইরে আবাদ করলে যে পরিমাণ পানি লাগত তার ৯৫ শতাংশই সাশ্রয় হয়। এখানে কোন কীটনাশকের ব্যবহার নেই। প্রয়োজন যখন হয় তখনই কেবল পুষ্টি উপাদান ও সার দেয়া হয়। আলোর যে ব্যবস্থা আছ তাতে সবজির জন্য যে সুনির্দিষ্ট ওয়েভলেন্থ প্রয়োজন সেটাই দেয়া হয়। কোম্পানি জানায় যে বাইরে সবজি চাষে যে ফলন পাওয়া যায় এই ব্যবস্থায় পাওয়া যায় তার ৩৯০ গুণ বেশি ফলন। এভাবেই গড়ে উঠবে সার্কুলার অর্থনীতি যেখানে সম্পদের অকারণ ও বাহুল্য ব্যবহার হবে না। অথচ ফলন মিলবে ভাল। আবার এমনও হতে পারে যে একটি প্রতিষ্ঠানের পরিত্যক্ত জিনিস অন্য প্রতিষ্ঠানের কাজে লাগছে। কোপেনহেগেনে পরস্পর থেকে একেবারেই ভিন্ন ধরনের ১১টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজাররা এক ব্যতিক্রমী রকমের বন্ধন গড়ে তুলেছেন। তারা এক প্রতিষ্ঠানের পরিত্যক্ত জিনিস বা বর্জ্য অন্য প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার করেছেন। এসব প্রতিষ্ঠানে অন্যতম হলো নভো নরডিক্স যা বিশ্বব্যাপী যত ইনসুলিন সরবরাহ করা হয় তার অর্ধেক উৎপাদন করে থাকে। এই নভো নরডিস্ক ও তার সহ-প্রতিষ্ঠান নভোজাইমস মিলে একত্রে ৩ লাখ ৩০ হাজার টন পরিত্যক্ত ঈস্ট যুগিয়ে থাকে। এই পরিত্যক্ত ঈস্ট এরপর ট্রাকে করে একটি বায়োএনার্জি কারখানায় নেয়া হয়। সেখানে মাইক্রোর এই পরিত্যক্ত ঈস্টকে এমন পরিমাণ বায়োগ্যাসে রূপান্তরিত করে যে তা দিয়ে ৬ হাজার বাড়িঘরের গ্যাসের চাহিদা মেটানো ছাড়াও প্রায় ৫০ হাজার একর জমিতে ব্যবহারের মতো পর্যাপ্ত সার পাওয়া যায়। এভাবে সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী পানি, জ্বালানি বা উপকরণের মতো ২২ ধরনের বর্জ্য আদান প্রদানের এক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে ‘কালুন্দবর্গ সিমবায়োসিস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি যে ছক বেঁধে পরিকল্পনা করে গড়ে উঠেছে তা নয়। গড়ে উঠেছে চার দশক ধরে ধাপে ধাপে। প্রথমে একটি কোম্পানি কালুন্দবর্গে আসে কতটা এই কারণে যে তেল শোধনাগার থেকে বর্জ্য গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে এবং এই গ্যাস জ্বালানির সস্তা উৎস। পরে কোম্পানিটি নিকটবর্তী কয়লাচালিত বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে জিপসাম সংগ্রহ করে। বিদ্যুত কেন্দ্রটি নির্গত ধোঁয়া থেকে সালফার ডাই-অক্সাইড বের করে নিয়ে তারপর জিপসাম তৈরি করে। এখন কালুন্দবর্গ সিমবায়োসিস এই প্রক্রিয়া কার্বন নির্গমন বছরে ৬ লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন হ্রাস করছে এবং অংশীদার প্রতিষ্ঠানগুলোর ২ কোটি ৭০ লাখ ডলার সাশ্রয় করছে। জার্মানির ওয়েস্ট ফালিয়া এক ধরনের হ্যামের জন্য বিখ্যাত। সেখানে শূকরও আছে প্রচুর। এসব শূকরের মলমূত্র এক বড় ধরনের পরিবেশগত সমস্যা। শূকরের মলমূত্র ক্ষেতে ব্যবহৃত হচ্ছে সার হিসাবে। ওসব ক্ষেতে এই সারের পরিমাণ এত বেশি জমে উঠেছে যে ওই সমস্ত জমি থেকে নাইট্রেট চুইয়ে নেমে এসে জার্মানির প্রায় এক-চতুর্থাংশ এলাকার ভূগর্ভের পানির দূষণ ঘটাচ্ছে। শূকরের গোবর নিয়ে এই সমস্যার শিল্প পরিসরে সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তৈরি করা হয়েছে একটি কারখানা। শূকরের খামারের গোবর এখানে এনে মাইক্রোবের সহায়তায় প্রথমে বায়োগ্যাস তৈরি করা হয়। সেই বায়োগ্যাস দিয়ে চালানো হয় জেনারেটর। জেনারেটর কারখানাটিকে বিদ্যুত যোগায়। বাকি যে বিদ্যুত উদ্বৃত্ত থাকে তা জাতীয় গ্রিডে বিক্রি করে। বায়োগ্যাস তৈরি হওয়ার পর গোবরের যে উপজাত থাকে দ্রুতগতির সেন্ট্রিফিউজ ও উত্তপ্ত চুল্লীর সাহায্যে তা থেকে পিঙ্গলবর্ণের তরল পদার্থ বের করে নেয়া হয় যা নাইট্রোজেন ও পটাশিয়াম সমৃদ্ধ। এ ছাড়াও বের করে আনা হয় বাদামী ছাই যার ৩৫ শতাংশই ফসফরাস। এসব উপজাতের সবই বিক্রয়যোগ্য। কারখানায় কোন বর্জ্য তৈরি হয় না। একটা সময় ছিল যখন প্রত্যেক কৃষকই সার্কুলার অর্থনীতি চালাত। সে তত সংখ্যক গবাদিপশুই রাখত যাদের খাবার সংস্থান তার জমি থেকে করা সম্ভব হতো। আর এসব গবাদিপশু থেকে সেই পরিমাণ গোবরই পাওয়া যেত যা সেই কৃষকের জমি ধারণ করতে পারত। শিল্প-পরিসরে গবাদিপশু পালন সেই বৃত্তটি ভেঙ্গে দেয়। আজ শিল্প পরিসরেও সার্কুলার অর্থনীতি পুনর্প্রবর্তনের স্বপ্ন দেখেছেন ম্যাকডরফ ও ব্রাউনগার্ট তাদের ক্র্যাডেল টু ক্র্যাডল গ্রন্থে। তাদের দৃষ্টিকল্প অনুযায়ী ধারণা হিসাবেও আবর্জনার অস্তিত্ব থাকাবে না। উৎপাদিত সমস্ত কিছুই সুপরিকল্পিভাবে হয় টেকনিক্যাল নিউট্রিয়েন্ট নয়ত বায়োলজিক্যাল নিউট্রিয়েন্ট হবে। টেকনিকাল নিউট্রিয়েন্ট বিরামহীনভাবে রিসাইকেল করা যাবে আর বায়োলজিক্যাল নিউট্রিয়েন্ট নিরাপদে খাওয়া যাবে কিংবা তা কম্পোস্ট সারে পরিণত হবে। সেই ধারণা থেকেই ইবেন বেয়ার ও তার অংশীদার গ্যাভিন ম্যাকইনটায়ার ইকোভেটিভ ডিজাইন’ নামে একটি কোম্পানি খুলেছেন। তাদের কোম্পানির উৎপাদিত প্রথম পণ্য হলো প্যাকেজিং পণ্য। তারা শণের আঁশ বা কাঠের কুচির সঙ্গে সামান্য পরিমাণ মাইসেলিয়ামের ছত্রাক যোগ করে এবং আঠা দিয়ে ভাল করে মিলিয়ে মিশিয়ে ফেলেন। তারা লক্ষ্য করেন মিশ্রিত এই জিনিসটি ছাঁচে দিয়ে যে কোন আকারে বৃদ্ধি করা যায়। ডিহাইড্রেট করা হলেই এর বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়। এই পণ্যটি দিয়ে কাজ হয়ে যাওয়ার পর সেটিকে কম্পোস্ট হিসেবে ব্যবহার করা যায়। বিগত দশকে ইকোভেটিভ কোম্পানি ১০ লাখ পাউন্ডেরও বেশি প্যাকেজিংয়ের পণ্য তৈরি করেছে যার মধ্যে আছে প্যাকিং কার, কসমেটিক্সের ডিসপ্লে মোল্ড ইত্যাদি। হালে এই কোম্পানি আরও বৃহত্তর কিছু তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে সেগুলো এমন পণ্য যার শতভাগই মাশরুম। মাটিতে মাইসেলিয়াম জালের স্তরে স্তরে জন্মে। কিন্তু বাতাসের সংস্পর্শে এলেই তা মাশরুমের রূপ নিয়ে গড়ে উঠতে থাকে। ইকোভেটিভ মাইসেলিয়ামের এই কৌশলটিকে কাজে লাগিয়ে ভিন্ন কিছু তৈরির উদ্যোগ নেয়। তৈরি করে সুলেস, ভেগান লেদারসহ নানা ধরনের জিনিস যা মাইসেলিয়াম দিয়ে তৈরি। ভেগান লেদার দিয়ে হ্যান্ডব্যাগও বানানো হচ্ছে। এই হ্যান্ডব্যাগ পরিত্যক্ত হলে জমির কম্পোস্ট সার হিসেবে ব্যবহৃত হবে। এটি একটি দৃষ্টান্ত মাত্র। ভবিষ্যতে এভাবেই বেশিরভাগ উৎপাদিত পণ্য হবে বায়োলজিক্যাল, যা এই ধরিত্রী পরবর্তীকালে হজম করে নিতে পারবে। সুতরাং সার্কুলার অর্থনীতি এখন আর নিছক স্বপ্ন নয়। এটা বাস্তবে রূপ নেয়ার প্রবল সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে। যদিও প্রকৃতির সম্পদরাজি আমরা যেভাবে ব্যবহার করছি ২০৫০ সাল নাগাদ তা দ্বিগুণে পৌঁছাতে পারে। ওদিকে কার্বন নির্গমনও বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। কিন্তু এই পৃথিবীকে ও নিজেদের বাঁচাতে হলে সার্কুলার অর্থনীতিতে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। তবে সেই অর্থনীতি গড়ার জন্য শিল্প বিপ্লবের মতো প্রবল ও ব্যাপক পরিবর্তন দরকার এবং সেই অর্থনীতি গড়ে উঠলেই কেবল আবর্জনা ও জঞ্জাল থেকে মুক্ত হতে পারবে আমাদের এই পৃথিবী। (সমাপ্ত) সূত্র : ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক
×